দেশের মধ্যে এই কলকাতাতেই প্রথম তৈরি হয়েছিল নার্সিং প্রশিক্ষণের কেন্দ্র। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের দুই শততম জন্মবার্ষিকী অতিক্রম করার পর এই কলকাতাতেই ঘোষিত হল প্র্যাক্টিশনার সিস্টার তৈরির কথা। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আরও অগ্রগমন সুনিশ্চিত। লিখছেন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের সামাজিক ইতিহাসের গবেষক সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়
আরও পড়ুন- বিধানসভার গরিমা নষ্ট করছেন রাজ্যপাল, ধনকড়কে কড়া প্রতিক্রিয়া অধ্যক্ষের
গত বছর অর্থাৎ ২০২০তে ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হল। সেবিকা বা নার্সদের কথা উঠলেই চলে আসে তাঁর নাম। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (১৮৫৪-১৮৫৬) আর্তদের সেবায় তাঁর অবদান আজ কিংবদন্তি। আধুনিক নার্সিংয়ের তিনিই জননী। শুধু যে সেবার মাধ্যমে নিজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তাই নয়, তিনিই গড়ে তুলেছিলেন নার্সিং শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান। তাঁর জন্মভূমি ব্রিটেনেই ১৮৬০ সালে গড়ে উঠেছিল সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তার অর্ধ শতাব্দী পরে ১৯১৬ সালে ব্রিটেনে গড়ে ওঠে রয়্যাল কলেজ অফ নার্সিং। ২৭ মার্চ, ১৯১৬তে কলেজ অফ নার্সিং নামে গড়ে ওঠার সময়ে এর সদস্য ছিল মোটে ৩৪ জন। আর আজ শতবর্ষ পার করা এই প্রতিষ্ঠান পৃথিবীতে নার্সিং নিয়ে ভাবনাচিন্তার ক্ষেত্রে এক দিশারি।
ভারতে নার্সিং পরিষেবার বিকাশ ব্রিটিশ আমলে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এদেশে নার্সিং পেশার গুরুত্ব উপলব্ধি করে গড়ে তোলা হয় ‘ক্যালকাটা হসপিটালস নার্সেস ইনস্টিটিউশন’। এই সংস্থাই জোগান দিত মেডিক্যাল কলেজে ইউরোপীয় ওয়ার্ডের নার্সদের। তখনও যে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে খুব সাহায্য পাওয়া যেত এমন নয়। প্রথম সরকারি সাহায্য মেলে প্রথম ভাইসরয় ক্যানিংয়ের আমলে। তাঁর স্ত্রী লেডি ক্যানিং এবং তদানীন্তন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ, দু’জনের মিলিত উদ্যোগে। ১৮৭৩ সালে গড়ে ওঠে আর একটা প্রতিষ্ঠান ‘লেডি নার্সেস অফ কানিংহাম’। এটির উদ্দেশ্য ছিল উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য নার্স তৈরি করা। পরে এই দুটো প্রতিষ্ঠানকে এক ছাতার তলায় আনার চেষ্টা হয়। নার্সিংয়ের গুরুত্ব ক্রমেই ব্রিটিশ শাসক উপলব্ধি করতে থাকে। বড়লাট কার্জনের আমলে এই বিষয়ে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সেটির নাম ছিল ‘স্কিম ফর দ্য প্রভিশন অফ ট্রেনড নার্সেস ফর অ্যাটেনডেন্স অন ইউরোপিয়ানস ইন ইন্ডিয়া’।
আরও পড়ুন- মহান শিক্ষক ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন প্রজ্ঞার দীপ্তিতে এক অনন্য জীবনের আলেখ্য
এসব কিছুর পেছনে ব্রিটিশদের লক্ষ্য ছিল ভারতে আসা ব্রিটিশ সিভিলিয়ন এবং মিলিটারিদের স্বার্থরক্ষা। এই সময় ভারতে যাঁদের এই পেশায় আসতে দেখা যেত তাঁরা ছিলেন হয় ইউরোপীয় না হয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। ভারতীয়দের এই পেশায় আসা শুরু বেশ কিছুটা পরে। সমসাময়িক বাংলা সাময়িকপত্রে প্রকাশিত লেখাপত্রেও এই বিষয়ে ভারতীয়দের আগ্রহের খবর পাওয়া যায়। ১৮৯৭ সালে গড়ে ওঠে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল। সেখানে নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। এর দু’বছর পরে ১৮৯৯ সালে নার্সিংয়ের মান উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে গড়ে ওঠে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অফ নার্সেস। তারই অনুসরণে ভারতে ১৯০৮সালে তৈরি হয় ‘ট্রেন্ড নার্সেস আসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’।
তারপরে একশো বছর কেটে গেছে। কিন্তু নার্সদের গুরুত্ববৃদ্ধি নিয়ে খুব একটা বেশি ভাবনাচিন্তা এদেশে অন্তত করা হয়নি। অথচ, এই ১০০ বছরে আন্তর্জাতিক পরিসরে নার্সদের গুরুত্ব প্রবলভাবে বেড়েছে। বিশেষ ভাবে ভাবনাচিন্তা চলেছে এই পেশাকে নিয়ে। অতিমারির পরিবেশে সেই ভাবনাচিন্তা আলাদা মাত্রা পেয়েছে। ফলে, পেশা হিসেবে নার্সিং বিবর্তিত ও গুরুত্বের নিরিখে বিবর্ধিত রূপ পরিগ্রহ করেছে।
এটা সবচেয়ে বেশি হয়েছে ইংল্যান্ডে, যেখান থেকে এই পেশা এদেশে এসেছিল।
১৯৮০-র দশকের শেষের দিক থেকে, অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠার ছয় দশক পর রয়্যাল কলেজ অফ নার্সিং ‘নার্সিং প্র্যাকটিশনার’ নামে এক নতুন দায়িত্বপূর্ণ পদের জন্য প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। এর প্রথম ব্যাচ পাশ করে বেরোয় ১৯৯২তে। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে ইংল্যান্ডের পাশাপাশি আমেরিকাতেও প্র্যাকটিশনার নার্সদের নিয়ে আগ্রহ দেখা দেয়। সেই সূত্রে বেশকিছু লেখালেখি এবং গবেষণা চলে। এক কথায়, আজ থেকে তিরিশ বছর আগেই ইংল্যান্ড আমেরিকায় প্র্যাকটিশনার নার্সদের ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা শুরু হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ভারতে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি।
প্র্যাকটিশনার নার্সদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয় একটাই বিষয়ে। সেটা হল, নার্সিং পেশার মানুষদের এমন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান যাতে তাঁরা রোগীর ভালমন্দ বিচারের ক্ষেত্রে একটা নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন। এখানে দুটো কথা স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার। এক, এ ব্যাপারে চিকিৎসা পরিষেবার মানের সঙ্গে কখনও আপস করা হয় না। কারণ, স্পষ্টভাবে বলা আছে যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সদের অন্তত অনার্স স্তরের স্নাতক হিসেবে উত্তীর্ণ হতে হয়। আর দুই, এই প্র্যাকটিশনার নার্সরা কখনওই ডাক্তারের সর্বাঙ্গীণ বিকল্প নয়।
প্র্যাকটিশনার নার্সদের গুরুত্ব এখানেই যে তাঁরা তাঁদের অধীত বিদ্যা এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে রোগীর কল্যাণ করার কাজে মতামত দেওয়ার সুযোগ পাবেন এবং এই ধরনের মতামত দিয়েই তাঁদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাচ্ছে না। ওই মতামতের ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সেটার দায়িত্বও তাঁদেরই নিতে হবে।
সাম্প্রতিককালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্র্যাকটিশনার নার্সের পদ সৃষ্টির কথা ঘোষণা করেছেন। এদেশে ভাল নার্সদের স্বাস্থ্য পরিষেবায় কাজে লাগানোর ব্যাপারে এরকম আধুনিক ভাবনাচিন্তার প্রয়োগ পরিচয় আমরা এই প্রথম পেলাম। এতে যে শুধু নার্সরা তাঁদের যোগ্য মর্যাদা পাবেন তা নয়, রোগীকল্যাণের ক্ষেত্রেও এ এক বিরাট পদক্ষেপ। সামগ্রিকভাবে রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতিকল্পে এক আধুনিক ভাবনাকে এখানে প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, সেকথা বলাই বাহুল্য।