ওঁ দুর্গে দুর্গে রক্ষণী স্বহা!!!
শরতের আকাশ। কাশফুলের হাওয়া। যেন আগমনের সুর আকাশে বাতাসে। করোনার কোপ গত ২ বছর কেড়ে নিয়েছিল বাংলা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের যাবতীয় আনন্দ-উচ্ছ্বাস। ফের স্বমহিমায় মহিষাসুরমর্দিনী। করোনা বিদায় না নিলেও, জীবনহানির হার কম। সেটাই ভরসা। তাই পুজোর (Durga Puja) প্রস্তুতি তুঙ্গে।
এবার শারদোৎসব মাথায় নতুন মুকুট নিয়ে হাজির। গতবছর ১৫ ডিসেম্বর এই পুজােকে ইউনস্কাে আন্তর্জাতিক উৎসবের স্বীকৃতি দিয়েছে। অধরা ঐতিহ্যের তালিকাভুক্তির স্বীকৃতির পোশাকি নাম List of Intangible Haritage। স্বভাবতই জাতিধর্ম নির্বিশেষে এই উৎসবে অন্য মাত্রা যোগ হয়েছে এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। কোনও সন্দেহ নেই দুর্গােপুজোকে ‘কার্নিভাল’ সম্মানপ্রাপ্তির মস্তবড় কৃতিত্ব মা-মাটির-মানুষের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এ-ব্যাপারে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য নানা উন্নয়ন কর্মসূূচি। কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী থেকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, প্রায় ১০০র বেশি সমাজকল্যাণমুখী প্রকল্প। অন্যদিকে খেলাধুলা, সংস্কৃতি এবং নানা উৎসবে মানুষের পাশে থাকার বার্তা নিয়ে বাংলা জুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন মমতা। এটাই তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। ২০১১ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর এই কর্মধারা রাজ্যবাসী দেখছেন।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এবং অঞ্চলে সারা বছর ধরে নানা উৎসব পালিত হয়। মহারাষ্ট্রে গণেশ চতুর্থী, কেরলে ওনাম, বিহারে ছটপুজো, তামিলনাড়ুতে পুুঙ্গল প্রভৃতি বেশ কিছু উৎসবের কথা উল্লেখ করা যায়। কেরল এবং তামিলনাড়ু এবং বিহারের উল্লেখিত উৎসব প্রত্যক্ষ করার সুযোগ এই প্রতিবেদকের হয়েছে। কিন্তু কোনও সংকোচ না রেখেই বলা যায়, দুর্গোৎসবের (Durga Puja) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উৎসবগুলির কোনও তুলনাই চলে না।
মুম্বইয়ের এক নামী ড্রেস মেটিরিয়ালের ব্যবসায়ী কয়েক বছর আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘‘দুর্গাপুজোর সময় কলকাতা তথা বাংলায় যেভাবে জামাকাপড় বিক্রি হয়, দেশের কোনও অঞ্চলে কোনও উৎসবে এত টাকার লেনদেন হয় না।” কাঁথির মণ্ডপকর্মীর কথায়, ‘সারা বছর ধরে আমরা তাকিয়ে থাকি বাঙালির সেরা উৎসবের দিকে। এইসময় কাজ করে, যে রোজগার হয়, সেটাই বলতে পারেন আমাদের বোনাস। দু’বছর করোনায় আমরা যে কী করুণ অবস্থায় থেকেছি তা বলে বোঝানো যাবে না।’ এক অর্থনৈতিক সমীক্ষায় জেনেছি, দুর্গাপুজোকে (Durga Puja) কেন্দ্র করে এ-রাজ্যে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়।
‘রিও কার্নিভাল’ ধারে এবং ভারে বিশ্বে একনম্বর। ব্রাজিলের এই কর্নিভাল দেখতে বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা আসে। লক্ষ লক্ষ মানুষ মুগ্ধ চোখে রিও কার্নিভাল উপভোগ করে। মূলত রঙিন শোভাযাত্রা ৭ দিনের সেই উৎবের আকর্ষণ। ১৮০টি দেশের ৬৩১টি উৎসব, শিল্পকলা এবং কলাকে এ পর্যন্ত ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের দেশেরও বিভিন্ন বিকাশের ১৩টি অনুষ্ঠান/উৎসব/শিল্পকলা আগে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে দুর্গাপুজোর ইউনেস্কাের স্বীকৃতি দেশে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে।
চার দশক ধরে বাম সরকার দুর্গাপুজো থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছিল। বাম নেতারা বিশেষ করে সিপিএমের কর্তাব্যক্তিদের সক্রিয়ভাবে পুুজোতে অংশ নিতে দেখা যায়নি। এমনকী সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বাম আমলে ‘দুর্গাপুজো’ শব্দটি ব্যবহার করা হত না। সেখানে ‘শারদ উৎসব’ শব্দটি লেখা হত। কলকাতার বড় বড় পুজোগুলি নিজেদের উদ্যোগে জাঁকজমক করত।
আরও পড়ুন: দলবদল রুখতে বিধানসভায় আস্থাভোটের পথেই কি সোরেন?
বস্তুত কলকাতার দুর্গাপুজোর ফেস্টিভাল থেকে কার্নিভালে রূপান্তর ২০১৫ সালে। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর থেকে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জগতে বাংলাকে ঘিরে নিজের নানা স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টায় মেতে ওঠেন মমতা। এই বছর মমতার উদ্যোগে সরকারি সহাযোগিতায় কলকাতায় সব পুজো একসঙ্গে ‘বিসর্জনের শোভাযাত্রার সূচনা হয়। পরে পোশাকি নাম দেওয়া হয় ‘দুর্গাপুজো ইমারসন কার্নিভাল’। সরকার ঘোষণা করে, ‘বিশ্ববাংলা শারদসম্মান’। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী রচনা করেন ‘থিম সং’। এই নানান শোভাযাত্রা এখন দারুণ জনপ্রিয়। রাজ্যের বাইরেও বহু মানুষ দেখতে আসেন।
২০১৮ সালে ১০ হাজার টাকা করে দুর্গাপুজো-পিছু আর্থিক অনুদান দেওয়া হয় রাজ্যের ২৮,০০০ ক্লাবকে। সরকার এই অনুদান ক্রমশ বাড়াতে থাকে। ২০১৯ সালে ৩০ হাজার করে টাকা পায় একই সংখ্যায় ক্লাব। ২০২০ এবং ২০২১ সাল অর্থাৎ করোনাকালে অর্থের পরিমাণ বেড়ে ৫০ হাজার হয়। এই বছর মুখ্যমন্ত্রী আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ বাড়িয়ে প্রায় ৪৩ হাজার পুজোর জন্য পুজো-পিছু ৬০ হাজার করেছেন। এইভাবে বাংলার সবচেয়ে বড় উৎসবে উৎসাহ বাড়িয়েছেন মা-মাটি-মানুষের সরকারের কর্ণধার। স্বভাবতই এ বছর ইউনেস্কো-পুরস্কার গোটা বিশ্বে দুর্গাপুজোর মর্যাদা বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে।
শত্রুদের তো ছিদ্র খোঁজার শেষ নেই। তাদের প্রশ্ন, কেন এই দান-খয়রাতি? হ্যাঁ, মানছি আর্থিক দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ খুব ভাল জায়গায় নেই। কেন্দ্রীয় সরকার চরম বিমাতৃসুলভ আচরণ করে চলেছে। প্রাপ্য টাকা রাজ্য পাচ্ছে না। দু’চার কোটি নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা। তা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো জনমুখী প্রকল্প চালু আছে।
দুর্গাপুজোকে আর্থিক অনুদানে সাহায্য দেওয়া মানে, লক্ষ লক্ষ প্রান্তিক মানুষকে সাহায্য করা। তাদের পক্ষে দাঁড়ানো। এই উৎসবকে ঘিরে বহু মানুষ পরিশ্রম দিয়ে অর্থ আয় করেন। ছোটখাটো ব্যবসায়ীদেরও মুখে হাসি ফোটে। ব্রিটিশ আমলেও অর্থ সাহায্য দেওয়া হত, দেশের সবচেয়ে বড় উৎসবে। কীভাবে? একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। হুগলি জেলার কোন্নগরে ঘোষাল বাড়ির দুর্গাপুজোর বয়েস এ বছর ৫৬৭-তে পা দিল। ২৫০ বছরেরও আগে ব্রিটিশ সরকার ৭৫০ টাকা করে এই পুজোর অনুদান দেওয়া চালু করেছিল। ব্রিটিশ প্রশাসনের যুক্তি ছিল, তৎকালীন বারোয়ারি পুজো বলতে সেরকম বিশেষ কিছুই ছিল না। জমিদারবাড়ির পুজোগুলি যাতে বারোয়ারির মতো চেহারা নেয়, সেটাই ছিল তাদের পরিকল্পনা। অর্থাৎ পুজোর ক’দিন পল্লিবাসী একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করবে। আনন্দ-অনুষ্ঠানে অংশ নেবে। মমতার উদ্যোগেও রয়েছে সেই পরিকল্পনার ছাপ। সুতরাং বিরোধীরা যতই সমালোচনা করুক, মুখ্যমন্ত্রীর কাজে কোনও ভুল আছে মনে হয় না।