অভিনেতা উত্তমকুমারকে আমরা সবাই চিনি, জানি। আমরা সেই প্রজন্মের মানুষ যাঁরা ওঁকে পেয়েছি যখন উনি একেবারে মধ্যগগনে বিরাজমান! হলে গিয়ে উত্তমবাবুর প্রথম ছবি দেখার অভিজ্ঞতা ‘এন্টনী ফিরিঙ্গি’। পদ্মশ্রী অডিটোরিয়ামে বসে ফিরিঙ্গি উত্তমকুমারকে দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে উঠেছিল ‘নয়’ বছরের মন। আমি যে-পাড়ায় থাকি সেখানে ওই সময় অনেক ফিরিঙ্গি বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান থাকতেন। আমি অনেক খুঁজেও ‘এন্টনী’-রূপী উত্তমকুমারের মতো কাউকে পাইনি। এরপর ধন্যি মেয়ে, জয়জয়ন্তী, রাতের রজনীগন্ধা— একের পর এক রোম্যান্টিক ছবি আমার বয়ঃসন্ধির মন ছেয়ে রেখেছিল। এইসব ছবি কিন্তু হলে গিয়ে দেখা, পরবর্তীতে টেলিভিশনের দৌলতে ওঁর আগের ছবি যেমন নায়ক, চিড়িয়াখানা, সপ্তপদী, আলোছায়া, ভ্রান্তিবিলাস, উত্তরফাল্গুনী, জতুগৃহ দেখি। নায়ক ও চিড়িয়াখানা সত্যজিৎ রায়ের ছবি হিসেবেই গণ্য, কিন্তু উত্তমবাবুকে যেভাবে পরিচালক ব্যবহার করেছিলেন তাতে মনে হয় এই ছবির জন্য আর কেউ নয় উনিই আদর্শ। শোনা যায় নায়ক দেখে কিংবদন্তি হলিউড অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলর ওঁর সঙ্গে আলাপ করার ও কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন।
আরও পড়ুন-রোগীর পরিবারের নিগ্রহে ইনটার্নদের প্রতিবাদে কর্মবিরতি
নায়ক বা অভিনেতা হিসেবে উত্তমবাবু অনন্য এ কথা বলা সত্যের পুনরাবৃত্তি ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু উনি অর্থাৎ অরুণ চট্টোপাধ্যায় ওরফে উত্তমকুমারই যে ছিলেন ইন্ডাস্ট্রি সেটা প্রমাণিত সত্য পঞ্চাশ দশকের মধ্যভাগ থেকে আমৃত্যু। কারণ তিনি শুধু অভিনেতা নন, উত্তমবাবু প্রযোজক, পরিচালক, সংগীত পরিচালক, নানা রূপে ইন্ডাস্ট্রিতে আধিপত্য কায়েম করেছিলেন।
আরও পড়ুন-অ্যাকশন-প্যাকড জগদ্ধাত্রী
প্রযোজক হিসেবে ওঁর সাফল্য অভূতপূর্ব। ১৯৫৭ সালে ওঁর আলোছায়া প্রোডাকশন ব্যানারে তৈরি হয় হারানো সুর ও তারপর সপ্তপদী। দুটি ছবিই পরিচালক অজয় করের এবং দুটিই বক্স অফিস এবং সমালোচকদের কাছে সমাদৃত হয়। জীবনের শুরুতে সাত-সাতটি ফ্লপ ছবির পর সাফল্য আসে যাঁর জীবনে তিনি প্রযোজক হওয়ার পর পরিচালক ও কাহিনি নির্বাচনে এতটাই দক্ষ হয়ে ওঠেন যে তাঁর ছবি সপ্তপদী জাতীয় পুরস্কারও অর্জন করে। ১৯৬৩ সালে ওঁর প্রযোজনা সংস্থার নাম পরিবর্তিত হয়। এবার নাম : উত্তমকুমার ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেড। এতদিনে উনি বাংলা সিনেমার বাদশা এ নিয়ে আর কোনও দ্বন্দ্বের অবকাশ ছিল না। নতুন প্রযোজনা সংস্থার ব্যানারে তৈরি হয় ভ্রান্তিবিলাস, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শেক্সপিয়ারের কমেডি অফ এররস অবলম্বনে লেখা নাটক থেকে। উত্তমবাবু নাটকের মঞ্চে অভিনয় শুধু শুরুই করেননি, নাটক ওঁর জীবনের অনেকটা জুড়েও ছিল। নাট্যচর্চার ফলস্বরূপ তাঁর বিষয় নির্বাচন, বুদ্ধিমত্তা এবং সংস্কৃতি-চেতনা দুটোরই পরিচয় বহন করে।
নাটকের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছোট থেকেই এবং তা চিরকালীন। নিজের বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন নাট্যচর্চার দল সুহৃদ সমাজ। নাটকই ছিল অভিনেতা হয়ে ওঠার উৎস। ১৯৫৩ সালে যখন ওঁর ভালই নামডাক, পোর্ট ট্রাস্টের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, সেই সময় আবার পেশাদারি নাটক শ্যামলী শুরু করেন স্টার থিয়েটারের ব্যানারে। শ্যামলীর ৪৮০টি শো পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে অভিনীত হয়।
আরও পড়ুন-ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়া রুখতে পদক্ষেপ
এই নাটকের গল্প নিয়ে সিনেমা তৈরি করেন অজয় কর। একই নামে। কথিত আছে এই নাটক দেখে বাংলার কিংবদন্তী বিধানচন্দ্র রায় উত্তমবাবুকে শ্যামল নামে ডাকা শুরু করেন। সত্তরের দশকে উনি আবার ফিরে আসেন নাটকের জগতে। ওঁর ফাউন্ডেশন শিল্পী সংসদের মাধ্যমে তিনটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। চারণকবি মুকুন্দ দাস, শাজাহান ও চরিত্রহীন। উনি কিন্তু নিজে অভিনয় করেননি। আলিবাবা নাটকে ছিল ওঁর উপস্থিতি।
আরও পড়ুন-সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবি খারিজ করল শীর্ষ আদালত
ভ্রান্তিবিলাস এতটাই জনপ্রিয় হয় ওঠে যে তিন-তিনটি হিন্দি ছবির প্রেরণা হিসেবে কাজ করে : দু দুনি চার, আঙ্গুর ও সিরকুস। এরপর আসে উত্তরফাল্গুনী, জতুগৃহ ও গৃহদাহ। উত্তরফাল্গুনী আবার প্রযোজক হিসেবে ওঁকে এনে দেয় জাতীয় পুরস্কারের শিরোপা ও সেই সঙ্গে ১৯৬৬ সালে ছবিটি রিমেক হয় হিন্দিতে মমতা নামে। বাংলা এবং হিন্দি দুটি ছবিতেই নায়িকা ছিলেন সুচিত্রা সেন। প্রযোজক হিসেবে ওঁর দক্ষতা এই ছবিটি পুনরায় কায়েম করে। ওঁর প্রযোজক সত্তা ও অভিনেতা সত্তা যে ভিন্ন ছিল, তা এই ছবির বিষয় ও কাস্টিং স্বাক্ষরিত করে। আর প্রযোজনার ক্ষেত্রে রিস্ক নিতে উনি পিছপা হতেন না। নিজের প্রযোজিত ছবিতে উনি নেই এবং সেই সময়ে পুরোপুরি নায়িকাভিত্তিক ছবি করার সাহস ও উদ্যম উনি দেখিয়েছিলেন এবং ছবিটি শুধু পুরস্কৃত হয় তা নয়, জনপ্রিয়তাও কম পায়নি। শুধু হিন্দি নয় তামিল ও মালয়ালম ভাষাতেও পরে রিমেক হয় এই ছবি। জতুগৃহ ও গৃহদাহ— দুটি ছবির কাহিনিই সাহিত্যভিত্তিক এবং আজও সমাদৃত।
আরও পড়ুন-জওহরলাল নেহরুর কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্ধৃতি
উত্তমবাবুর মধ্যে যেমন নাট্যচেতনা ছিল, সাহিত্যচর্চাও যে উনি করতেন সেটি ওঁর ছবির কাহিনি নির্বাচনে স্পষ্ট। হলিউডের জনপ্রিয় ছবিও উনি দেখতেন এবং বহু ক্ষেত্রে সেখান থেকেও অনুপ্রাণিত ছবিতে উনি অসাধারণ পারফরম্যান্স দিয়েছেন। সাউন্ড অফ মিউজিকের ক্রিস্টোফার প্লামার অভিনীত ক্যাপ্টেন ভন ট্র্যাপ আর জয়জয়ন্তীর উত্তমকুমার অভিনীত সঞ্জয় রায় দুজনে এক চরিত্র কিন্তু আলাদা। উত্তমবাবু চরিত্রটি আদ্যন্ত বাঙালি করে তুলেছিলেন, ফলে কখনওই মনে হয়নি এই ছবি কপি, একেবারে অরিজিনাল গল্পই মনে হয়েছে। রাতের রজনীগন্ধার ক্ষেত্রেও রোমান হলিডের গ্রেগরি পেকের চরিত্রায়ণ ও উত্তমবাবুর উপস্থাপনা স্বতন্ত্র। এই ক্ষমতা ওঁর মধ্যে ছিল, যে কোনও চরিত্রকে উনি আত্মস্থ করতে পারতেন, আর সেই সঙ্গে ওঁর সংস্কৃতিমনস্কতা, সাহিত্য ও সিনেমাচর্চাও ছিল দুর্দান্ত।
আরও পড়ুন-সাতমাস মেলেনি বেতন, বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন বিজেপি রাজ্যের সাত শ্রমিক
প্রযোজক হিসেবেই শুধু নয় উত্তমবাবুর পরিচালকসত্তাও প্রখর ছিল। শুধু একটি বছর, বন পলাশীর পদাবলী ও কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী ওঁর পরিচালনায় সফল ছবি। শেষ ছবিটি ওঁর মৃত্যুর পর মুক্তি পায়। বন পলাশীর পদাবলীর কাহিনি রমাপদ চৌধুরির এবং এর চিত্রনাট্য উত্তমকুমার ও জয়দেব বসু যৌথভাবে লিখেছিলেন। ছবিটি শিল্পী সংসদের ব্যানারে মুক্তি পেলেও প্রযোজক ছিলেন মহানায়ক নিজেই! স্বয়ং অভিনয় করলেও প্রযোজক হিসেবে নামী স্টার কাস্ট নিয়েছিলেন। সুপ্রিয়া দেবী তো ছিলেনই, ছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, মলিনা দেবী, বাসবী নন্দী…অর্থাৎ চরিত্রাভিনেতারাও ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী।
আরও পড়ুন-পাচারকাণ্ডে পলাতক এক অভিযুক্তের সঙ্গে ফোনে কথা শুভেন্দুর, বিস্ফোরণ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
প্রযোজক উত্তমকুমার জানতেন ও বুঝতেন সিনেমা অডিয়েন্সের পালস। এবং পরিচালনার সঙ্গে নিজে অভিনয় করছেন সে-খেয়াল ওঁর ছিল ষোল আনা, তাই সব চরিত্রে নিয়েছিলেন দক্ষ অভিনেতা ফলে পরিচালক হিসেবে তাঁদের চালনা করা হত সহজ। এঁদের সঙ্গে ছিল ওঁর সখ্য এবং একটা মনের মিল, তাই ছবির উপস্থাপনা সহজ হয়ে ওঠে। গান ও আবহ সংগীত সম্পর্কেও ওঁর নজর ছিল। শ্যামল মিত্রের সঙ্গে বসে দিনের পর দিন আলোচনার পর তৈরি হয় সেইসব চিরকালীন গান, যা আজও বাজলে মন নেচে ওঠে। গানের মধ্যে দেশজ বাঙালিয়ানা ছিল পুরোপুরি ছবির থিমের সঙ্গে মিল রেখে। গানের মেলোডি, উপস্থাপনা ও সুরে সংস্কৃতির সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান মিলেমিশে এমনভাবে উনি দৃশ্যপট রচনা করেছিলেন যাতে কোথাও তাল না কাটে। যাঁরা তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত তাঁদের সেন্টিমেন্ট মনে রেখে, নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার উপাদান যেভাবে তিনি ‘দেখুক পাড়া পড়শীতে’ গানের দৃশ্যায়নের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন তার থেকে আজকের প্রজন্মেরও অনেক কিছু শেখার আছে।
আরও পড়ুন-স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিককে তুলোধনা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
গানের কথাই যখন হচ্ছে তখন ওঁর সংগীত পরিচালক-সত্তার কথা না বললে নয়। খুব ছোট বয়স থেকেই উত্তমবাবু গান শেখা শুরু করেন। ওঁর গানের গলা এতটাই ভাল ছিল যে নিজের ছবি নবজন্মে (১৯৫৬) উনি নিজে প্লেব্যাক করেন। পরবর্তীতে ওঁর গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ডও বেরোয়। কাল তুমি আলেয়া ছবির সংগীত পরিচালকও উনি। ১৯৬৬-র এই ছবিতে উনি যে-গানে সুরারোপ করেন তা গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও আশা ভোসলের মতো গায়ক-গায়িকা। উত্তমবাবু তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তাঁর হাতে ছবির অভাব নেই, তাও তিনি এক্সপেরিমেন্ট করতে পিছপা ছিলেন না। তাঁর বহুমুখী প্রতিভা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর অভিনেতা ও তারকা-সত্তার আলোয় সেভাবে আলোচিত বা প্রকাশিত হয়নি। বিশেষত প্রযোজক হিসেবে তিনি যে পথ দেখিয়েছিলেন আজ বহু সফল নায়ক-তারকাই অনুসরণ করছেন। তাই উনি যে বাংলা সিনেমার শুধু ধারকবাহক ছিলেন তা-ই নয় বহুক্ষেত্রে পথিকৃৎও বটে। আজ তাঁকে স্মরণ ও অনুসরণের মাধ্যমেই আমরা বাংলা সিনেমাকে পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হব আশা রাখি।