গুরু ব্রহ্ম
ভারতের শিক্ষা পদ্ধতি ছিল সনাতনী। বৈদিক যুগে গুরুই ছিল ব্রহ্ম। এই গুরুবাদী শিক্ষা পদ্ধতিতে যিনিই শিক্ষক তিনিই গুরু। আবার তিনিই ব্রহ্ম। পৃথিবীটাকে দেখা-বোঝা-চেনা শুরু হয়েছিল গুরুর হাত ধরে। সেসময় শিক্ষার বিষয় ছিল ভারতীয় গণিত, বিজ্ঞান, ন্যায়, নীতি। কোথাও কোথাও মহাকাশবিদ্যাকেও শিক্ষার বিষয় হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তবে বৈদিক যুগ থেকেই শুনে শুনে শিক্ষারীতি প্রচলিত ছিল। গুরু বলতেন, শিষ্য শুনতেন। তৈরি হত জ্ঞানশিক্ষার এক আবর্ত। গুরুর সঙ্গে শিষ্যের সম্পর্ক ছিল বোঝাপড়ার, সম্মানের, আনুগত্যের, স্বীকৃতি।
গুরুর পথ অনুসরণ করবে বলে শিক্ষার্থীরা থাকত আশ্রমে। তাদের জীবনচর্চা ছিল আজকের দিনের প্রায়োগিক শিক্ষা।
এই জীবনচর্চা থেকেই শুরু হত শিক্ষার বিভিন্ন অধ্যায়। বছর পাঁচের শিশুকে হাতে ধরে অক্ষর শেখাতেন গুরু। আর অনুষ্ঠান করে শিক্ষা শুরু করাতেন উপনয়নের মধ্যে দিয়ে, শুরু হত আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। অভিষেক হত শিক্ষা দুনিয়ায় প্রবেশের। বারো বছর ধরে চলতো এই শিক্ষাপাঠ। সমাবর্তনের মধ্যে দিয়ে শিষ্যকে ফিরিয়ে দেওয়া হত তার গার্হস্থ্য জীবনে।
বঙ্গভূমে শিক্ষা টোল
আমাদের এ রাজ্যে টোলের শিক্ষারীতি দৃষ্টি কেড়েছিল রবীন্দ্রনাথের। তিনি বিশ্বাস করতেন পুঁথি পড়াটাই বড় জিনিস নয়। টোলের চারিদিকে অধ্যাপনার হাওয়া বইছে। গুরু নিজেও এখানে শিক্ষার্থী। শিখছেন পরিবেশ থেকে, টোল থেকে, প্রকৃতি থেকে। জীবনযাত্রা এখানে পাঠক্রম। নিতান্তই সাধাসিধে এই জীবনে বিলাসিতা মনকে স্পর্শ করে না। বরং স্বভাবের সঙ্গে মিশে যায়। এই টোল-সংস্কৃতির পীঠকেন্দ্র ছিল নদীয়ার নবদ্বীপ এবং উত্তর কলকাতা। ষোলোর শতকের নবদ্বীপের টোলগুলিতে ছাত্ররা আসত দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে। আয়ুর্বেদ, কাব্য, ন্যায়, দর্শন সবই পড়ানো হত। সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষার মাধ্যমে এটা ছিল পণ্ডিত তৈরির আঁতুড়ঘর। আর তৎকালীন রাজপরিবারগুলি ছিল এদের পৃষ্ঠপোষক। মধ্যযুগেও বাংলার সংস্কৃত উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি টোল হয়ে উঠেছিল, উত্তর ভারতে যার নাম ছিল চতুষ্পাঠী— চার বেদ পাঠের প্রতিষ্ঠান। বাংলার কিছু টোলে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলংকার ও পৌরাণিককাব্য পড়ানো হত। আরেক ধরনের টোল ছিল প্রধানত স্মৃতি নির্ভর। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টোল ছিল ন্যায়শাস্ত্রকেন্দ্রিক।
শ্রুতি-মধুর
মধ্যযুগের এই শিক্ষারীতি ছিল মূলত মৌখিক। অদ্ভুতভাবে বিতর্ককেও শিক্ষা পদ্ধতির অংশ হিসেবে ধরা হত। দুজন শিক্ষক যখন কোনও মত নিয়ে তর্ক করতেন, ছাত্র-ছাত্রীদের তা শোনার অধিকার ছিল। বিতর্কের কোনও অংশ যদি শিক্ষার্থীর জটিল বলে মনে হত, তবে তারা তা আবার শিক্ষকের কাছে বুঝে নিতেন। সেসময় পুঁথির প্রচলন ছিল ঠিকই, কিন্ত সেই পুঁথি লিখতেন শিক্ষক। অবশ্য পুঁথি লেখাও তখন শিক্ষাদানের মর্যাদা পেত। শিক্ষা ছিল তখন অবৈতনিক।
বিশ্ব জুড়ে পাঠশালা
গুরুগৃহ, আশ্রম, টোল হয়ে শিক্ষা পৌঁছাল প্রকৃতিতে। এখানে প্রকৃতিই শিক্ষক, আর ছাত্র রবীন্দ্রনাথ। সর্বকালের সেরা বাঙ্গালি শিক্ষক। শিখেছেন প্রকৃতি থেকে, তাঁর সৃষ্টি বিলিয়ে দিয়েছেন প্রকৃতিকেই। আমরা সবাই কোনও না কোনওভাবেই তাঁর ছাত্র। এমন শিক্ষকই মানচিত্রের ভৌগোলিক সীমরেখা ভেঙেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার রূপ বদলেছে। সরকার শিক্ষাপদ্ধতিতে ঢুকে পড়েছে নিঃশব্দে, দায় ও দায়িত্ব পালনের জন্য। সকলের জন্য বিনা পয়সায় প্রাথমিক শিক্ষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে দেশের সংবিধান। শিক্ষার গনতন্ত্রীকরণ হয়েছে। তবে রাজীব গান্ধীর আমলে উচ্চশিক্ষার বেসরকারীকরণ দোলা দিয়ে গেছে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থাকে। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হইচই যে হয়নি এমন নয়।
আলোর পথযাত্রী
শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে শিক্ষকের রূপ, এসেছে প্রযুক্তি! মানুষ ভাবতে শুরু করেছে শিক্ষা আর জ্ঞান নির্ভর নয় তথ্য নির্ভর। প্রযুক্তি আর তথ্য মিলেমিশে শিক্ষার নতুন পরিসর তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে শিক্ষকের ভূমিকা নিয়েও। অথচ আমাদের দেশেই মহান শিক্ষকেরা জাতির জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়েছে চেতনা ও আত্ম-উপলব্ধির মধ্য দিয়ে।
রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, এপিজে আবদুল কালাম এঁরা শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন জাতির মধ্যে। রাধাকৃষ্ণন শিক্ষক হিসেবে পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উপরে বেশি বিশ্বাস রেখেছিলেন। আর কলকাতার সিমলা স্ট্রিটের এই শিক্ষক সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্যে কিছু করার তাগিদ অনুভব করেছিলেন। শিক্ষক হিসেবে স্বামীজি শুধু বিশ্ব হিন্দু সভায় চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছেন এমন নয়, এদেশের যুব সমাজকেও অনুপ্রাণিত করেছেন।
শিক্ষক গৌতম বুদ্ধ শিখিয়েছেন ত্যাগের ব্রত। বাল্মীকি আর বেদব্যাস শিক্ষা দিয়েছেন মহাকাব্যের আধারে। পুঁথিগত শিক্ষা না থাকলেও জ্ঞানচক্ষুর পর্দা খুলে দিয়েছেন পরমহংসদেব, দেখা পেয়েছেন ঈশ্বরের। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যে শিক্ষক লড়াই করেছেন তিনি শঙ্করাচার্য। শিক্ষক স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী আধুনিক ভারত গড়ে তোলার শিক্ষা দিলেন। আর তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চাণক্য শুধু অর্থশাস্ত্র নয়, দর্শন, চিন্তাবিজ্ঞান শেখালেন বিশ্ববাসীকে। শিক্ষক আর্যভট্টের শূন্যতত্ত্ব বদলে দিল এই পৃথিবীর হিসেব-নিকেশ। সাবিত্রী বাই ফুলে ভারতের প্রথম মহিলা বিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা শিক্ষক, ভেঙে দিলেন সমস্ত সামাজিক মিথ। মেয়েদের শিক্ষা আর সন্মান রক্ষার লড়াইয়ে বাজি রাখলেন নিজের জীবনকে— শিক্ষকতার পেশাকে।
মহাকাব্যের শিক্ষাগুরু
শিক্ষক ছাত্রের সম্পর্কের টানাপোড়েন পুরাণ মহাকাব্য থেকে শুরু। অর্জুনকে গাণ্ডীবচর্চায় বিশেষ শিক্ষা দিলেন গুরু দ্রোণাচার্য। অর্জুন শিখলেন ব্রহ্মাস্ত্র বিদ্যা। হিন্দুপুরাণে সূর্য দেবতার কাছে শিক্ষা চাইলেন হনুমান। জ্ঞানশিক্ষার পর গুরুদক্ষিণা নিতে প্রত্যাখ্যান করলেন, গুরু বোঝালেন শিক্ষাদানের আনন্দ। কৃষ্ণ এবং বলরামের শিক্ষক সন্দীপানি, তিনি শেখালেন জীবনদর্শন এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুর কোনও বিকল্প নেই। পরশুরাম তাঁর সব মিথ বিশ্বাস ভেঙে দিয়ে ভীষ্মকে শিক্ষা দিলেন, মেনে নিলেন ছাত্র হিসেবে। মহাকাব্যের মহানায়ক রামচন্দ্র শিক্ষাগুরু হিসেবে পেলেন বশিষ্ঠকে।
শিক্ষা দুনিয়ায় দখলদারি
হিন্দু পুরাণের ভারতবর্ষে শিক্ষা পণ্য নয়! বরং মুক্ত, অবৈতনিক দায়িত্বশীল এক প্রক্রিয়া। নয়ের দশকে মুক্ত বাণিজ্য অর্থনীতির পরে এ-দেশে এ-রাজ্যে যেমন আছড়ে পড়েছে ভুবনায়নের ঢেউ। তেমনি সেই ভেবে আন্দলিত হয়েছে শিক্ষক শিক্ষাব্যবস্থা আর সমাজ। আটের দশকের টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা শিক্ষাপদ্ধতিকে সেভাবে নাড়া দিতে না পারলেও, স্যাটেলাইট আর ইন্টারনেট এসে দখলদারি বসিয়েছে শিক্ষার আঙ্গিনায়। শুরু হয়েছে তথ্য পাওয়ার তথ্য দেওয়ার প্রতিযোগিতা। জ্ঞানের দুনিয়া থেকে যা অনেক দূরে। এর মধ্যেই সমাজ বদলেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমাদের মতো ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত দেশগুলির কাছে তথ্যই ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিশ্বাস করতে শিখেছিলাম এ সমাজ হবে তথ্য সমাজ! আর শিক্ষা হবে তথ্যমূলক। শিক্ষকের দায়িত্ব তথ্য পৌঁছে দেওয়া, সেই তথ্যের বিশ্লেষণ করা। হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো ভাবনার রূপান্তর হল, আরও একধাপ এগিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম জ্ঞান সমাজে। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধু তথ্য নয় জ্ঞানই উপজীব্য। শিক্ষকের দায়িত্ব শুধু তথ্য দেওয়া নয়, জ্ঞানের প্রচার ও প্রসার ঘটানো।
পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে
প্রবল ইন্টারনেটের ঝড় উঠল। অফুরান তথ্য ভাণ্ডার এখন শিক্ষক-ছাত্রের হাতের মুঠোয়। মহাকাশ থেকে মহানদী, আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে ভায়োলট বিপ্লব সবই হাতের মুঠোয়, দরকার শুধু একটা ক্লিক। চার দেওয়ালের ভিতরে শিক্ষক যে তথ্য দিতে যে সময় নেয়, তার আগেই গুগল (Google) সেই তথ্য পৌঁছে দেয় নিমেষে। অজানা তথ্যের সন্ধানে শিক্ষক ও ছাত্র দুজনেই ছোটে গুগল (Google) গুরুর কাছে। মুক্ত তথ্য ভাণ্ডার হওয়ায় মান্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, প্রশ্ন ওঠে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতায়। এখন আর তথ্যের জন্য শিক্ষার জন্য ছুটতে হয় না গুরুগৃহে। গুগলের (Google) হাত ধরে পাড়ি দেওয়া যায় সাতসমুদ্র তেরোনদী। টেলিগ্রাম, ইউটিউব এরা তো সদাজাগ্রত কখন আসবে শিক্ষার্থীরা, বাড়বে ভিউ আর লাইক। শিক্ষকও ছুটে যাচ্ছেন এই প্লাটফর্মে, আপলোড করছেন তাঁর জ্ঞান। দেশকালের গন্ডি ভেঙে আঞ্চলিক শিক্ষক হয়ে উঠছেন সর্বজনীন। পুরুলিয়ার শিক্ষক তাঁর গবেষণা আপলোড করছেন সানফ্রানসিসকো, সেন্ট পিটার্সবার্গ, মস্কো, ক্যালিফোর্নিয়ায় বসে পড়ছে একদল ছাত্র। এ তো শিক্ষকের গ্রহণযোগ্যতা নয় স্বীকৃতিও।
শিক্ষক জেনারেটেড কন্টেন্ট
তবে কি শিক্ষার আরেক নাম তথ্য না জ্ঞান? যদি আগামী পৃথিবীতে তথ্যই জ্ঞান হয় তবে হারিয়ে যাবে শিক্ষকরা। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সক্রেটিসের জন্যে, অ্যারিস্টটলের জন্য, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্য। যাঁদের মনন ঋদ্ধ করত শিক্ষাজগৎকে। আগামী দশকেও শিক্ষক থাকবেন, গুগলও (Google) থাকবে! শিক্ষার্থীরা ছুটবে শিক্ষকের কাছে নীতিশিক্ষার জন্য, জ্ঞানের জন্য। অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাবেন শিক্ষক আর তাঁর সঙ্গী হবে গুগল। শিক্ষকহীন শিক্ষাপৃথিবী হয়ে উঠবে আমাদের অলীক কল্পনা। প্রযুক্তি প্রসারিত হবে শিক্ষাপদ্ধতি পাল্টাবে, এভাবেই গুগলময় (Google) পৃথিবীতে বহময় নদীর মতো বয়ে চলবে শিক্ষাব্যবস্থা। আলো জ্বালবে আমাদের মনের অন্ধকারে। ইউজার জেনারেটেড কন্টেন্ট নয়, শিক্ষক জেনারেটেড কন্টেন্টই হবে আমাদের পাঠের বিষয়।
করোনা দিয়েছে দোলা
গুগল-গুরু (Google) আধিপত্য বিস্তার করেছে ঠিকই কিন্তু শিক্ষককে টলাতে পারেনি তার আসন থেকে। টেকনো-গুরুকে মেনে নিয়েছে অনেকেই, কিন্তু মনে নিতে পারেনি। এখন তথ্য সংগ্রহের জন্যে পাড়ি দিতে হয় না সাগরপারে। প্রযুক্তির সেতু বেয়ে সব তথ্য পৌঁছে যায় মুঠো ফোনের অন্দর মহলে।
করোনাকালে বদলে গেল শিক্ষার পরিসর। স্কুল-কলেজের ক্লাস রুম হয়ে উঠল ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম। চোখে আঙুল দিয়ে অনলাইন শিখিয়ে দিল, বুঝিয়ে দিল শিক্ষকের গুরুত্ব। ক্লাস রুমের চার দেওয়ালের গন্ধ, শিক্ষকের স্নেহ আর বন্ধুদের ভালবাসা শিক্ষার আবশ্যিক শর্ত হয়ে উঠল। গুগল-গুরু তথ্য দিতে পারে ভূরি-ভূরি কিন্তু স্বপ্ন দেখাতে পারে না। শিক্ষক পারেন স্বপ্ন দেখাতে। পারেন স্বপ্ন দেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে। স্বপ্নের সেই পানসিতরী একদিন সাগরে-মহাসাগরে ময়ূরপঙ্খি নৌকা হয়ে পড়ি দেয় দূরে বহুদূরে— অন্ধকারে আলোর মশাল নিয়ে। সব ছাত্রই শিক্ষকের আলোর পথযাত্রী হয়ে ছুটে চলে।
আরও পড়ুন: আমরা মাথা নোয়াব না !