দেবাশিস পাঠক: তিন-তিনটে বই, লেখক (Nanigopal Debnath) একজনই। লেখক বহুপ্রজ নন। পেশাগত পরিচয়ে শিক্ষক। এখন ক্লাসরুম-যাপন থেকে অবসরলাভের পর কলম আঁকড়ে ধরেছেন। তারই ফসল আলোচ্য পুস্তকত্রয়ী।
প্রথমেই একটি গল্প সংকলন। নাম ‘একটিও গল্প নয়’। এক ডজন গল্প সন্নিবেশিত হয়েছে গ্রন্থটিতে।
প্রতিটি গল্পে লেখকের শিক্ষকসত্তার উপস্থিতি স্পষ্ট। বেশ বোঝা যায়, শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকেই গল্পগুলির সৃজন। যেমন, সংকলনের প্রথম গল্পটি। নাম ‘ইংলিশ-মিডিয়াম’। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া নাতি, বদলে যাওয়া ছেলে, জেনেরেশান গ্যাপের গল্প। পরিণতিতে একেবারে মোটা তুলি দিয়ে সাদা-কালোর পৃথগীভবন।
চেনা ছকে নয়া প্রজন্মের মূল্যবোধের অবনমনের ছবি। আর একটি গল্প, নাম ‘এই প্রথম চোখে জল’।
রাতুল-সুচিত্রার গল্প। পারিবারিক জীবন। ঝগড়াঝাটি। চাওয়া না-পাওয়া। একেবারে চেনা মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প। কোথাও আতিশয্য নেই। অতিরঞ্জন নেই। কাহিনির শেষে রাতুলের জন্য জীবনে প্রথমবারের জন্য সুচিত্র কাঁদে। সেই জলে পাঠকের সংবেদনশীল মন ভিজে যায়। ‘এ কেমন মা?’ কেন্দ্রবিন্দুতে ব্রজহরির দ্বিতীয় পত্নী রূপসী। এর মধ্যে ঢুকে পড়ে রূপসীর প্রেমিক মানিক। মানিককে দুশ্চরিত্র বলে তুলে ধরেন গল্পকার। সে মা ও মেয়ে দু’জনকেই নিজের জালে জড়াতে চায়। রূপসীর মেয়ে শর্মিষ্ঠা তার স্যারের পরামর্শমতো মানিক আর রূপসীকে উচিত শিক্ষা দেয়। তারপর নিজের কেরিয়ার গড়ায় মন দেয়। ‘বৈশালীর ইচ্ছা’ এক কিশোরীর অপূর্ণ মনোবাসনার গল্প। বৈশালীর মতোই হারাধন আশা-নিরাশার বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকে ‘একজন নতুন লেখকের আত্মকথা’ গল্পে। ভাল কিংবা মন্দ, সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা, কোনও নির্দিষ্ট পরিণতিতেই পৌঁছতে পারে না সে।
গল্পগুলো ভীষণ সাদামাঠা। রোমাঞ্চিত হওয়ার বাঁকগুলো বিবৃতি প্রদানের ঢঙে বলা। ছোট গল্পের ব্যাকারণ মেনে এগুলোর নির্মিতি নয়। সেজন্যই চেকভ-মপাঁসার মোচড়— এগুলোতে মেলে না। যা পাওয়া যায় সেটা হল এক প্রবীণ দাওয়ায় বসে তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলে চলেছেন, সেই ধরনটা। গল্প এখানে লেখা হয় না। বলার ঢঙে বিধৃত হয়। তাই আলঙ্কারিক বাক্যবিন্যাস এই গল্পগুলোতে অনুপস্থিত। লেখক একেবারে সরাসরি বলেন, ‘একজন নতুন লেখকের আত্মকথা’তে যেমনটা বলেছেন, ‘‘বহু নব্য লেখকের এই পরিণতি হয়। বা ভবিতব্যও বলা যায়। আমি হারাধন সেই আশঙ্কাতেই আছি। দেখি কী হয়?’’
এই গল্প সংকলনের শেষ গল্প ‘সেয়ানে সেয়ানে’। সেখানে একটা গল্পের ভেতর আর একটা গল্প ঢুকে পড়ে। কিন্তু কেন্দ্রবিন্দুতে লেপ্টে থাকে একটাই কথা— যেমন বুনো ওল তেমনই বাঘা তেতুঁল। পাত্রপক্ষ ও কন্যাপক্ষ, কেউই কারোকে এই গল্পগুলোতে ছাড়ে না। কেউই হার মানে না।
গল্প বলার ধরনে সারল্য যদি সম্পদ হয় তবে এই বইয়ের বারোটি গল্প বেশ আড্ডার আসরে বৈঠকি মেজাজে বলার জন্য আদরণীয় হতে পারে। কিন্তু সাহিত্যের ভিয়েনে রসের কড়াইয়ে এই গল্পগুলো টগবগে ফুটন্ত তেলে ওঠে আর নামে, থই পায় না। সাহিত্য সমালোচকের কাছে গল্পগুলি তাই সমভাবে আদৃত না-ও হতে পারে। তখনই গ্রন্থটির শিরোনাম ভিন্ন অর্থবাহী হয়ে ওঠে।
লেখক ননীগোপাল দেবনাথের (Nanigopal Debnath) উপন্যাস ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ একইভাবে সংজ্ঞার বেষ্টনীতে ধরা দেয়নি। সাহিত্য সমালোচকদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, উপন্যাসে বহু চরিত্রের সমাবেশ ও বহু ঘটনার সন্নিবেশ অন্যতম চরিত্রলক্ষণ। সেই মাপকাঠিতে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ উপন্যাস রূপে বিবেচিত হওয়ার দাবি করতে পারে না। ঠিক যেভাবে ‘একটিও গল্প নয়’-এর গল্পগুলি ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’-এর আঙ্গিক মেনে ছোট গল্প হয়ে ওঠে না। গল্পগুলিতে যেমন বৈঠকি মেজাজে কথকের বাচনভঙ্গি মুদ্রিত অক্ষরে ধরা পড়ে, তেমনভাবেই ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ গ্রন্থে একজন ইতিহাস শিক্ষকের ইতিহাস চেতনার মুখোমুখি হয় পাঠক ছাত্রসুলভ ভাবে আবিষ্ট হয়ে। পাঠকের তুলাদণ্ড তাঁর হাতে থাকে না।
গল্পের আসরে বক্তৃতা পরিবেশনে যেমন আসরের তাল কাটে, ঠিক তেমনই উপন্যাসকার যখন হরিহর হয়ে প্রায় এগারো পাতা জুড়ে একটা বিরাট সংলাপ ফেঁদে শুধু এটুকু বোঝাতে যায় যে ‘মানুষের মাঝেই স্বর্গ-নরক, মানুষেতেই সুরাসুর’ তখন মাস্টার মশাইয়ের লেকচারের সামনে পড়ে পাঠকের ছাত্রদশা বেগতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়।
‘সবার উপরে মানুষ সত্য’র প্রথম খণ্ডের উপজীব্য মুঘল জমানা। দ্বিতীয় খণ্ডের বিষয়বস্তু ঔপনিবেশিক শাসন। দু’টি খণ্ড পড়ার পর পাঠকের মনে হতেই পারে, উপন্যাস হিসেবে উপস্থাপিত না হয়ে এই দুটি খণ্ডের বিষয়-ভাবনা প্রবন্ধের আকারে পরিবেশিত হলে বোধ হয় ভাল হত।
এই ভাবনার ভুবনের প্রসৃতিতেই ননীগোপাল দেবনাথের (Nanigopal Debnath) লেখা বইগুলোর দুর্বলতা এবং আকর্ষণবিন্দু। দুটিই একই কেন্দ্রে সমাপতিত।
আরও পড়ুন: শিক্ষকদের শিক্ষক