স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, শিক্ষা পূর্ণতার বিকাশ।
এই পূর্ণতা আসলে আমাদের ভিতরেই অবস্থিত। আমরা সেই পূর্ণতাকে জানতে পারি না আমাদের অজ্ঞানতার জন্য। শিক্ষা সেই অন্তরের পূর্ণতার প্রকাশ ঘটায়। আমরা অসম্পূর্ণ মানুষ শিক্ষার মাধ্যমে তাই প্রতিনিয়ত মোমবাতির মতো জ্বলতে জ্বলতে পুড়তে পুড়তে পূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করি। শিক্ষা আমাদের সেই পূর্ণতাকে প্রাপ্ত করতে সাহায্য করে। আমরা স্কুলে ভর্তি হই, আমরা কলেজে পড়ি, আমরা সার্টিফিকেট পাই, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে নিজেদের শিক্ষিত তকমা লাগিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করি সমাজে। স্বামীজি তাঁর শিকাগো বক্তৃতায় উচ্চারিত করলেন যে ভারত এমন এক শিক্ষার ভাণ্ডার, যে শিক্ষা গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে এক নয়া বেদান্তের আলো। শিক্ষা এবং ধর্মকে তিনি যুক্ত করেছিলেন বৈজ্ঞানিকভাবে কুসংস্কারমুক্ত মন নিয়ে এবং সামাজিক, এমনকী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির এমন একটা অবস্থান থেকে তিনি দেখলেন যেখানে ভারতের অতীত ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদ, সর্বধর্মসমন্বয়ের পুনরাবিষ্কার করলেন যেন তিনি।
আরও পড়ুন-উচ্চমাধ্যমিকে ফর্ম পূরণ সহজ করা হচ্ছে, আধার নম্বর বাধ্যতামূলক নয়
আজ এত বছর পর যখন শিকাগো বক্তৃতার ঐতিহাসিক দিনটি এসে উপনীত হয় আমাদের সামনে, তখন মনে হয় শিকাগো বক্তৃতার অন্তস্তলে নিহিত বার্তা যদি আমরা এই দিনটির অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে আর একবার স্মরণ করি, তবে হয়ত চলার পথে নদীর দু-ধারে জমে থাকা পলিমাটিগুলোকে সরানোর চেষ্টা শুরু করা যেতে পারে, আবার নদীকে খরস্রোতা করার দায়িত্ব আমরা নিতে পারি। আসলে শিক্ষা মানে কেতাবি শিক্ষা নয়, শিক্ষা মানে নিছক দশটা বই পড়া নয়, শিক্ষা মানে স্বামী বিবেকানন্দের কাছে ছিল যে একটা যথার্থ মানুষ হওয়ার শিক্ষা, যথার্থ নাগরিক হওয়ার শিক্ষা, তাই তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলনের কথা যখন বলেছিলেন, তখন একদিকে যেমন তিনি পাশ্চাত্ত্যের যে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, উন্নত শিক্ষার উপকরণ গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন না, ঠিক তেমনভাবেই তিনি prachyer শিক্ষার যে ঐতিহ্য সেটা সংস্কৃত সাহিত্য এবং গবেষণা থেকে শুরু করে উপনিষদের অন্তরতত্ত্ব অনুধাবন পর্যন্ত সবকিছুই তিনি মনে করেছিলেন আজ প্রাসঙ্গিক।
আরও পড়ুন-সংবিধান বদল করে আরও ৫ বছর শীর্ষ পদে থাকার ছক জিনপিঙের
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন যে, এই শিক্ষাকেই আমাদের সবথেকে বড় মেরুদণ্ড হিসেবে দেখতে হবে। বাঙালির হৃতগৌরবকে ফিরে পেতে গেলে, আমাদের শিক্ষার পথে হাঁটতে হবে। কলকাতা রেনেসাঁ নগরী, ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই শহর নবজাগরণের পথ দেখিয়েছিল। সেই ব্রিটিশ রাজধানীর কলকাতা ১৯১১ সালে কীভাবে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হল, তারপর কীভাবে দিনের পর দিন বঞ্চিত হয়েছে বাংলা তার ইতিহাস সর্বজনবিদিত। বাঙালি তার মেধার উৎকর্ষ কিন্তু আজও খোয়ায়নি। এখনও পর্যন্ত গোটা দেশে নোবেল পুরস্কার বিজেতার সংখ্যাও কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে গর্ব করার মতো। এই বাংলায় শিক্ষার যে চালচিত্র, আজ যারা ‘গেল গেল’ রব তুলছেন, তাঁদের নিজেদের দায়িত্ব কতটা অতীতে ছিল তারা কিন্তু সে-কথাটা বিস্মৃত হয়ে, শুধুমাত্র সংকীর্ণ রাজনীতির জন্য প্রতিপক্ষ হিসেবে এখন মুষ্টিযুদ্ধে অবতীর্ণ। এই রাজনৈতিক কোন্দল কিন্তু শিক্ষার উৎকর্ষকে বাড়াতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ বাম শাসনে শিক্ষার যে রাজনীতীকরণ হয়েছে, শিক্ষা সেল নামক একটি বস্তু তৈরি করে অধ্যাপক নিয়োগ থেকে শুরু করে যেভাবে প্রাথমিক শিক্ষক এবং বিভিন্ন স্তরে, কলেজের স্তরে শিক্ষক সংঘঠনের মাধ্যমে রাজনীতি হয়েছে, তার তো আমরা, একটা প্রজন্ম সাক্ষী। কীভাবে অধ্যাপক নিয়োগ হত, কারা অধ্যাপক হতেন, কারা হতে পারতেন না, সেই ‘have’ এবং ‘have not’-এর মার্কসবাদী শ্রেণিতত্ত্ব কিন্তু সবথেকে বেশি প্রবল হয়ে ধরা দিয়েছিল এই পশ্চিমবঙ্গে।
আরও পড়ুন-হ্যারি ও মেগানের কথাও নতুন রাজা চার্লসের মুখে
আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে শিক্ষার চাবিকাঠি নিয়ন্ত্রিত হত এবং পায়ে শিকল-বাঁধা তোতাপাখি তৈরি করে ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করার জন্য একটা দীর্ঘ কয়েক দশক অতিবাহিত হয়েছে। তাতে ছাঁচে-ঢালা তোতাপাখির জন্ম হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার উৎকর্ষ কি তাতে আসে? সত্যি কথা বলতে কী, স্বামীজির এই শিকাগো বক্তৃতার যে বহুত্ববাদ, এই যে পরমতসহিষ্ণুতা, সর্বধর্মের সমন্বয়ের কথা, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে যে দেওয়ালটি বাঙালিকে নানানভাবে প্রভাবিত করেছে সামাজিক আর রাজনৈতিক হেজেমনি তৈরি করেছে, তারা কী দায়িত্ব পালন করেছিলেন! আজ সেই ফাঁক দিয়ে এক উগ্র হিন্দুত্ববাদের শক্তির প্রবেশ ঘটেছে, কেননা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা যদি সবথেকে বেশি কেউ দেখিয়ে থাকেন এই রাজ্যে, তবে সেটা কিন্তু কমিউনিস্টরাই করেছেন। অথচ স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতায় নাস্তিকতার পরিসর পর্যন্ত স্বীকার করা হয়েছে। ভারতীয় হিন্দুধর্মে নাস্তিক দর্শনকেও হিন্দুধর্মের মধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-টানা তল্লাশি, উদ্ধার বিপুল টাকা, বাংলায় ব্যবসা বন্ধ করে দিতে চাইছে ইডি : ফিরহাদ
অথচ কমিউনিস্টরা রাহুল সাংকৃত্যায়ন থেকে নানান সময়ে পি সি যোশী পর্যন্ত যাঁরা এইধরনের প্রাচীন আধ্যাত্ববাদের বিশ্লেষণ করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের গুরুত্ব কম দিয়ে, যাঁরা কঠোর রাজনীতির শ্রেণিতত্ত্বের নামে কঠোর রাজনীতীকরণকে সবথেকে বড় হাতিয়ার করেছিলেন এবং তাতে কিন্তু যথার্থ শিক্ষার স্বরূপ নিগৃহীত হয়েছিল, তাঁদের কিন্তু দীর্ঘ কয়েক দশকে চূড়ান্ত অবহেলার শিকার হতে হয়েছিল। এমনকী দামোদর দাশ কোশাম্বী যিনি হিন্দুধর্ম নিয়ে সারা জীবন ধরে গণিত এবং হিন্দুধর্ম নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন অথচ তিনি কিন্তু ঘোরতর আস্তিক ছিলেন না। আজ সেই কোশাম্বীকে নিয়ে মার্কসবাদী দল কতটুকু আলোচনা করে, ক’টা সভা-সমাবেশ হয়? সুতরাং এখন এই শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করে শুধু শাসক দলকে গালিগালাজ করেই দায়িত্বটা শেষ হয়ে যায় না। আজ তাই মনে হচ্ছে এই শিকাগো বক্তৃতার স্মরণের দিনে আমাদের আবার ফিরে আসা উচিত স্বামীজির দরজায়, এবং যেমনটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে আমাদের শিক্ষার স্বরূপকে বুঝতে হবে এবং তার জন্য যা যা করার সেটা আমাদেরই করতে হবে। সবকিছুই সরকার করবে আর আমরা হব বেনিফিশিয়ারি, এই মানসিকতা থেকেও বোধহয় বেরোনোর সময় এসেছে। স্বামীজির জীবনের একটা দীর্ঘ সময় এই শিক্ষাকে নিয়েই তো, এই শিক্ষাই ছিল তাঁর পরম উপজীব্য বিষয়।
আরও পড়ুন-ঐতিহাসিক চা-বাগান কর্মী সম্মেলন, আজ অভিষেকের সভা
সেই কোন ছোটবেলায় তিনি অল্ডাক্স হুক্সলেকে চিঠি লিখেছিলেন শিক্ষা নিয়ে এবং অনেক প্রশ্ন করেছিলেন, তার জবাব দিয়েছিলেন হুক্সলে। এর থেকে বোঝা যায় কেমন শিক্ষাপিপাসু ছিলেন তিনি। আর আজ তাই কেতাবি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতিকে বোঝা এবং জানা শিক্ষাকে যুক্ত করতে শিকাগো বক্তৃতা বিশেষভাবে অনুধাবন প্রয়োজন। আমি দেখেছি শিকাগো বক্তৃতাটি কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি প্রিয় গ্রন্থ। সবসময় ওঁর কাছে থাকে এবং সুযোগ পেলে তিনি বইটা কিন্তু পড়েন। রাজনীতির ধুলোঝড়ে অনেক সময় অনেক মানুষের প্রকৃত পরিচয় হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। রাজ্যের স্বার্থে, বাঙালির স্বার্থে, শিক্ষার উৎকর্ষ বিকাশের স্বার্থে আসুন আমরা আর একবার স্বামীজির শিকাগো বক্তৃতার মূল দর্শনটিকে স্মরণ করি কায়মনচিত্তে।