ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন বিপুল বিদ্যা ও প্রজ্ঞার অধিকারী। তিনি ছিলেন মাতৃভক্তির শেষবিন্দু। তিনিই তো বাংলাভাষার রূপকার। তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য সমাজসংস্কারক। তিনি আইনের দীর্ঘ লড়াইয়ের পথে হিন্দু বিধবাদের দিতে পেরেছিলেন পুনর্বিবাহের অধিকার। তিনি বাংলার শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রসারিত সংস্কার করে ঘটাতে পেরেছিলেন বাঙালির অবিস্মরণীয় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জাগৃতি। এসব কথা এবং তাঁর আরও কীর্তি ও শংসার কথা আমরা কে না জানি! শুনতে শুনতে কান পচেছে। বরং তাঁর ২০২-তম জন্মদিন উপলক্ষে অন্য এক ঈশ্বরচন্দ্রকে আমরা খোলাখুলি জানবার চেষ্টা করছি। মূর্তি ভাঙার জন্য নয়। মূর্তিটিকে পূর্ণতর মর্ত্যরূপ দান করার জন্য। অতি উত্তম সন্দেশ সারা জীবন ধরে খেতে থাকলে স্বাদ মরে যাবেই। অরুচি আসবেই। সুতরাং সন্দেশের বদলে এবার প্যাঁচমারা গরম জিলিপি!
আরও পড়ুন-ও নদী রে
প্রথম প্যাঁচটি মারার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে যিনি রোজ দেখতেন এবং সরাসরি চিনতেন এমন একটি মহাপণ্ডিতের কাছে যাওয়া যাক। তিনি কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য। দুঃখের বিষয় কৃষ্ণকমলকে আজকের অধিকাংশ বাঙালি চেনেন না। তাই তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিচ্ছি। কৃষ্ণকমলের জন্ম ১৮৪০-এ। তিনি ঈশ্বরচন্দ্রের থেকে বিশ বছরের ছোট। এবং তিনি কলকাতার ছেলে, এই শহরেই জন্মেছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের রোজ দেখা হওয়ার কারণ? খুব সিম্পল। কৃষ্ণকমলের মাস্টারমশাই ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। এবার এই ছাত্রের লেখাপড়ার বহরটা একটু বোঝা যাক। তিনি ঈশ্বরচন্দ্রকে বৈদগ্ধ্যে এবং জীবনবীক্ষণে খুব একটা আধুনিক ভাবতেন না। কৃষ্ণকমলের রক্তে ছিল শিক্ষা। তিনি ছিলেন সেই সময়ের প্রখ্যাত পণ্ডিত এবং শিক্ষাব্রতী রামজয় তর্কালঙ্কারের পুত্র। তুলনায় ঈশ্বরচন্দ্রের পারিবারিক চালচিত্র তেমন শক্তপোক্ত নয়।
আরও পড়ুন-সব ছোটদের জন্য
কোনও নামকরা স্কলারের রক্ত নেই তাঁর গায়ে। এবার কৃষ্ণকমল কীভাবে তাল ঠুকলেন প্রথা ও প্রজ্ঞায় সংস্কৃত কলেজে তাঁর পবর্তপ্রমাণ অধ্যাপক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সেটাই তো আসল মজা। আমি কৃষ্ণকমলের বেশ কিছু প্রবন্ধ পড়ে চমকে উঠি। আমার নিজের পড়াশোনার সব অর্বাচীন দেমাক ছিটকে যায়। আমি ভঙ্গকুলীন হয়ে খড়কুটোর মতো ভেসে যাই। টি এস এলিয়ট বলেছেন, যে-মানুষ ফরাসি জানে না, আর রান্না করতে শেখেনি, তার গুহায় ফিরে গিয়ে কাঁচা বা ঝলসানো মাংস খাওয়া উচিত। সভ্য সমাজে তার স্থান নেই। সেই থেকে মাথা হেঁট করে আমি নিজেকে গুহামানব ভাবি এবং শুধুমাত্র ফরাসিবিহীন এবং রান্না-অজ্ঞ গুহামানবীর সঙ্গেই প্রেম করে আরাম পাই। ছোট করে বলি কৃষ্ণকমলের অ্যাকাডেমিক ব্রিলিয়ান্সের সংক্ষিপ্তসার: কৃষ্ণকমল নিজেই লিখে জানাচ্ছেন, তিনি তাঁর শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্রের থেকে সংস্কৃত ভাষাটা কিছুমাত্র কম জানেন না। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের সমস্যাটা হল তিনি ফরাসি দার্শনিক কঁৎ-এর কোনও কিছুই জানেন না। এবং ফরাসির ‘ফ’ জানেন না ঈশ্বরচন্দ্র। এদিকে এলিয়টের মতো কৃষ্ণকমলও বলেছেন, যে ফরাসি জানে না, তার লেখাপড়া পাতে দেবার মতো নয়! মূল ভাষায় কঁৎ-এর পজিটিভিজম পড়েছেন কৃষ্ণকমল। তিনি সেই সময়ের প্রখ্যাত বাঙালি নাস্তিক। ঈশ্বরচন্দ্র তো নাস্তিকতার ভান করেন এবং চিঠির মাথায় ‘দুর্গা সহায়’ লেখেন। আর কৃষ্ণকমল প্রবলপ্রতাপে প্রচার করছেন নাস্তিকতা, নিখাদ ঈশ্বরবিরোধিতা এবং কঁৎ-এর পজিটিভিজম! তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে দর্শন ও সাহিত্য পড়ান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ান। তিনি ওকালতি করেন। তিনি রিপন কলেজের অধ্যক্ষ। তিনি ‘হিন্দুশাস্ত্র’ এবং ‘বাচ্যস্পত্যভিধান’ সংকলনে হাত লাগিয়েছেন। তিনি ‘বিদ্যাম্বুধি’ উপাধি অর্জন করেছেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিশেষ সদস্য।
আরও পড়ুন-ঝুলন গোস্বামীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবেগঘন ট্যুইট মুখ্যমন্ত্রীর
এহেন কৃষ্ণকমল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সন্বন্ধে লিখলেন :বিদ্যাসাগরকে আমি যত ঘনিষ্ঠভাবে জানি, তেমন আর কেহ জানে না। সাহিত্যক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর তাঁহার রাজতক্তের নিকট আর কাহারও আসন হইতে পারে, একথা কল্পনা করিতেও পারিতেন না। তাঁহার এই লিটেরারি জেলাসি সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই। বিদ্যাসাগরের ওই একটি প্রধান দোষ ছিল, তাঁহার ন্যারোনেস (সংকীর্ণতা), তাঁহার বিগোট্রি (গোঁড়ামি), তাঁহার ‘বামুনপণ্ডিতি’ ভাব। এক হিসাবে ক্যাথলিসিটি (সংস্কারমুক্ত উদারতা) তাঁহার ছিল না।
কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য তাঁর শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে এই ইংরেজি বাক্যটি লিখে গেছেন : He could not bear a brother near the throne : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসগর একাই বিরাজ করবেন খ্যাতির রাজসিংহাসনে। কোনও ‘ভাইটি’ এসে কাছে বসবে, এই হঠকারিতা তিনি সহ্য করতেন না। বিদ্যাসাগর সর্বদা নিজেকে হোমরাচোমরা ভাবতেই অভ্যস্ত ছিলেন। এই অহংকার থেকে বেরতে পারেননি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সবে তৈরি করলেন তাঁর সাধের ‘সারস্বত সমাজ’। পিতৃবন্ধু বিদ্যাসাগরকে চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ জানালেন জ্যোতিরিন্দ্র ‘সারস্বত সমাজ’-এর উদ্বোধনে উপস্থিত থাকতে।
আরও পড়ুন-বিভাজনের রাজনীতি করছে বিজেপি
বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে এল এই উত্তর :
আমাদের মতো লোককে পরিত্যাগ করো। হোমরা-চোমরাদের লইয়া কোনও কাজ হইবে না।
আরও একটি উদাহরণ দিই বিদ্যাসাগরের হোমরাচোমরামির। সবে তখন গড়ে উঠেছে শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমোহন বসুর যুগ্ম-স্বপ্নের ‘ভারতসভা’। তাঁরা চাইলেন বিদ্যাসাগরকে সভাপতির পদে। কিন্তু বিদ্যাসাগর কারও সঙ্গে মিলিত হয়ে কাজ করতে চান না। পারেনও না। তাঁর অহং আহত হয়। আত্মগরিমা বিদ্যাসাগরকে বাধ্য করল ‘ভারতসভা’ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে।
শিবনাথ শাস্ত্রী একহাত নিলেন তাঁর ‘আত্মচরিত’-এ। অকপটে জানালেন তাঁর বাবার সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বেশ সাদৃশ্য আছে, স্বভাবের মিল। দু’জনেই চান না বা পারেন না আত্মসমীক্ষা করতে। সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না দু’জনেই। আর দু’জনেই কাজ করতে চান তার ফল কী হতে পারে না ভেবে। এবং আত্মসমীক্ষার পথ এঁদের দু’জনের কেউই মাড়াতে চাননি। শিবনাথ শাস্ত্রীর এই সমালোচনা পড়ে আমি তো থ!
এইবার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবিচারের ব্যাপারে আসা যাক। সোজা কথা হল, বিদ্যাসাগর দু-চোখে দেখতে পারেন না বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে। এঁরা কেউই লিখতে পারেন না ভদ্রলোকের বাংলা। তা হলে কাদের বাংলা পছন্দ করেন বিদ্যাসাগর? যাদের বাংলায় কোনও মৌলিকতা নেই। আছে শুধু বিদ্যাসাগরের বাংলার অন্ধ অনুকরণ। তাদেরই পিঠ চাপড়ে দেন ‘বেশ বেশ’ বলে! যে-তাঁর প্রদর্শিত পথ না নিল, যে তাঁর অনবরত বিগলিতবাষ্পাকুলিতলোচনের মতো ভাষার প্রয়োগ না করিল, তার উপর বিদ্যাসাগর খড়্গহস্ত! বঙ্কিমের পরীক্ষার খাতা দেখলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলা পরীক্ষার খাতা। খাতা দেখে শিউরে উঠলেন ঈশ্বরচন্দ্র। ভদ্রলোকের ছেলে এই বাংলা লিখেছে পরীক্ষার খাতায়? এ-ছেলে তো সংস্কৃত ভাষা মোটেও জানে না। দিলেন বঙ্কিমকে বাংলায় ফেল করিয়ে।
আরও পড়ুন-গাজিয়াবাদ থেকে গ্রেফতার আমির
তবে ঈশ্বরগুপ্তর ওপর রাগের জন্য বিদ্যাসাগরকে একেবারেই দোষ দিচ্ছি না। বিধবাবিবাহের জন্য বিদ্যাসাগরের আন্দোলনকে যে-ভাষায় গালি দিয়েছিলেন ঈশ্বরগুপ্ত এবং তাঁর চেলারা, তা হজম করার শক্তি বিদ্যাসাগরের ছিল না। একটি উদাহরণ দিলাম :
পরাশর প্রমাণেতে বিধি বলে কেউ,
কেউ বলে এ যে দেখি সাগরের ঢেউ,
অনেকেই এত মত লয়েছে বিধান,
অক্ষতযোনির বটে বিবাহ বিধান,
কেহ বলে ক্ষতাক্ষত কেবা আর আছে,
একেবারে তরে যাক যত খুকু আছে।।
এই সময় আরও এক কাণ্ড ঘটালেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। শ্যামাচরণ সরকার, যিনি ল্যাটিন, গ্রিক, ফরাশি, ইংরেজি ও ইটালিয়ানে দশ, একটি বাংলা ব্যাকরণ লিখে বিদ্যাসাগরকে দিলেন। বিদ্যাসাগর শ্যামাচরণের থেকে ছ’বছরের ছোট। অনেক মানুষের সামনে শ্যামাচরণ বিদ্যাসাগরকে উপহার দিলেন তাঁর সদ্য প্রকাশিত বাংলা ব্যাকরণ। আর বিদ্যাসাগর পাতা উল্টে সকলের সামনে বললেন, ছিঃ ছিঃ, এটা তো একেবারেই নিকৃষ্টমানের বই। এই বই ছাপিয়ে বের করলেন! শ্যামাচরণ সেই যে মাথা হেঁট করলেন, আর সেই মাথা তুলতে পারলেন না।
আরও পড়ুন-নেতাদের কথা অমান্য কুর্মিদের, বাতিল ২৫২ ট্রেন
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মনের মধ্যে ঈর্ষা এবং মানুষকে হেয় করার প্রবণতা কম ছিল না। বিদ্যাসাগর চরিত্রের একটি বড় দুর্বলতা মানুষকে রূঢ়ভাবে অপমান করার ক্ষমতা। অধ্যাপক তারানাথ তর্কবাচস্পতির কথা ধরা যাক। তারানাথ ঈশ্বরচন্দ্রের বন্ধু। কিন্তু যেই বন্ধুত্বে চিড় ধরল তখনি বেরিয়ে এল ভিতরের ঈর্ষা ও ক্রোধ এই ভাষায়। তিনি তারানাথ সম্পর্কে তাঁর দুটি লেখায় ‘অতি অল্প হইল’ এবং ‘আবার অতি অল্প হইল’-তে এই ভাষা ব্যবহার করেছেন। আমি পড়ে বিস্মিত হয়েছি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তারানাথ সম্বন্ধে লিখছেন : পণ্ডিতমূর্খ, অতি অপদার্থ, বেহুদা পণ্ডিত, লজ্জাশরম কম, গায়ে মানুষের চামড়া নাই, প্রকৃত বক্কেশ্বর।
আরও পড়ুন-মেসির জোড়া গোল, জিতল আর্জেন্টিনা
এবার আসা যাক মদনমোহন তর্কলঙ্কার এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে। দু’জনেই একেবারে ছেলেবেলা থেকে ক্লাসফ্রেন্ড। সংস্কৃত কলেজের দুই রত্ন। কিন্তু বিদ্যাসাগরের ঈর্ষার শিকার হলেন মদনমোহন। যত বাড়ছে মদনমোহনের খ্যাতি এবং প্রিয়তা অধ্যাপক এবং রসিক স্কলার হিসেবে, ততই ঈর্ষান্বিত হচ্ছেন বিদ্যাসাগর। (এরপর ১৮ পাতায়)
(১৭ পাতার পর)
বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। আর মদনমোহন তর্কালঙ্কার অধ্যাপক। একদিন পাড়ার কিছু মানুষ এসে বিদ্যাসাগরকে বললেন, আমাদের বাড়ির মেয়েরা ছাদে উঠতে পারছে না।
— কেন? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কণ্ঠে অপার বিস্ময়।
— কারণ, একটি ক্লাসের ছেলেরা বাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। যে-ঘর থেকে সরাসরি আমাদের বাড়ির ছাদ দেখা যায়।
— সে কী! অপ্রস্তুত বিদ্যাসাগর।
মুহূর্তে খোঁজ নিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অমুক ঘরে কার ক্লাস চলছে।
— আজ্ঞে, মদনমোহনবাবুর ক্লাস।
ছুটলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সরাসরি ক্লাসে ঢুকে পড়লেন। বললেন, এ কী কথা মদন? তোমার কোনও শাসন নেই? তোমার ক্লাসের ছেলেরা সামনের বাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে. মেয়েরা ছাদে উঠতে পারছে না! কী ছাই পড়াচ্ছ?
ঈশ্বরচন্দ্র সুযোগ পেয়েছেন মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে অপমান করবার, সেই সুযোগ ছাড়লেন না।
মদনমোহন হেসে উত্তর দিলেন, শোনো ঈশ্বর, এটা বসন্তকাল, পড়াচ্ছি কালিদাসের কুমারসম্ভব এবং পড়াচ্ছেন স্বয়ং মদন, এতেও কি ছাত্রদের কিঞ্চিৎ চিত্তচাঞ্চল্য ঘটতে পারে না?
আরও পড়ুন-রানি ভবানীর আমলের চতুর্ভুজা পূজিতা ছিন্নমস্তা রূপে
চমকালেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর। চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন মদনমোহনের দিকে। মদনমোহন, যিনি পাণ্ডিত্যে তাঁর সমান-সমান, কোনও কথা বললেন না। শুরু করলেন তাঁর কালিদাস-ব্যাখ্যা। এবং বিদ্যাসাগর কিছুক্ষণ শুনলেন মুগ্ধ হয়ে।
এরপর মদনমোহন অভিমানে শিক্ষকতা ছেড়ে ১৮৫৫ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি নিলেন। এবং একটি চিঠিতে জানালেন, ‘পরমবান্ধব বিদ্যাসাগর আজ ছ’মাস কাল আমার সাহিত বাক্যালাপ করে নাই, আমি কেবল জীবন্মৃতের ন্যায় হইয়া আছি।’
মদনমোহনকে বেশিদিন জীবন্মৃত থাকতে হল না। মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে তিনি মারা গেলেন মুর্শিদাবাদে! সেদিন ১৮৫৮ সালের ৯ মার্চ। মদনমোহনের অকালমৃত্যুর পিছনে কি ঈশ্বরের অবদান নেই? যাই হোক, মদনমোহন রেখে গেলেন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী! মদনমোহনের মৃত্যুর পর জন্মাল তাঁর অষ্টম কন্যা মালতীমালা।
আরও পড়ুন-চোখের জলে বিদায় ফেডেরারের
অথৈ জলে পড়লেন মদনমোহনের স্ত্রী। শেষ পর্যন্ত মদনমোহনের স্ত্রীকে হাত পাততে হল ঠাকুরপো বিদ্যাসাগরের কাছে।
মদনমোহনের স্ত্রী নৃত্যকালীর মনে পড়ল সেই দুপুরবেলা। খুব খিদে পেয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। তিনি হাঁটতে-হাঁটতে চলে এসেছেন বন্ধু মদনের বাড়িতে। বন্ধু বাড়ি নেই, বিদ্যাসাগর জানেন। মদন তো ক্লাস নিচ্ছেন সংস্কৃত কলেজে। বিদ্যাসাগর মদনের বাড়িতে এসে দেখলেন মদনের স্ত্রী একা বসে ভাত খাচ্ছেন। বললেন, বৌদি, বড্ড খিদে পেয়েছে। কী খাব? নিজের ভাতের থালাটি নৃত্যকালী এগিয়ে দিলেন বিদ্যাসাগরের দিকে। বৌদির এঁটো থালা থেকেই পাশে বসে ভাত খেতে শুরু করেছেন বিদ্যাসাগর। এমন সময়ে হঠাৎ বাড়িতে ঢুকলেন মদনমোহন। সোজা চলে এলেন খাবার ঘরে। দেখলেন বিদ্যাসাগর আর স্ত্রী একই পাত থেকে দিব্য ভাত খাচ্ছেন! রসিকচূড়ামণি মদনমোহন বললেন :
ওহে বিদ্যাসাগর কর কী কর কী,
সব তুমি খেলে, আমি খাব কী!
মদনমোহনের স্ত্রী দেখলেন, পাতে তখন সত্যিই বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। বললেন, তুমি যা আছে, তাই খাও। এঁটো থালাটি স্বামীর হাতে তুলে দিলেন তিনি। মদনমোহন মহা খুশিতে সেই থালা চাটছেন।
এসব কথা মনে পড়লে, নৃত্যকালীর চোখে জল এল। তিনি কি বিদ্যাসাগরের কাছে সামান্য সাহায্যটুকু পাবেন?
বিদ্যাসাগর তখনও হিসেব করছেন, কত টাকা তাঁর কাছে প্রিয় বন্ধু মদনের স্ত্রী পেতে পারেন! ঠিক কতটুকু তাঁকে দেওয়া উচিত?
বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। আর মদনমোহন তর্কালঙ্কার অধ্যাপক। একদিন পাড়ার কিছু মানুষ এসে বিদ্যাসাগরকে বললেন, আমাদের বাড়ির মেয়েরা ছাদে উঠতে পারছে না।
— কেন? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কণ্ঠে অপার বিস্ময়।
— কারণ, একটি ক্লাসের ছেলেরা বাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। যে-ঘর থেকে সরাসরি আমাদের বাড়ির ছাদ দেখা যায়।
— সে কী! অপ্রস্তুত বিদ্যাসাগর।
মুহূর্তে খোঁজ নিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অমুক ঘরে কার ক্লাস চলছে।
আরও পড়ুন-সুরুল রাজবাড়ির পুজো আজও গরিমায় উজ্জ্বল
— আজ্ঞে, মদনমোহনবাবুর ক্লাস।
ছুটলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সরাসরি ক্লাসে ঢুকে পড়লেন। বললেন, এ কী কথা মদন? তোমার কোনও শাসন নেই? তোমার ক্লাসের ছেলেরা সামনের বাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েরা ছাদে উঠতে পারছে না! কী ছাই পড়াচ্ছ?
ঈশ্বরচন্দ্র সুযোগ পেয়েছেন মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে অপমান করবার, সেই সুযোগ ছাড়লেন না।
মদনমোহন হেসে উত্তর দিলেন, শোনো ঈশ্বর, এটা বসন্তকাল, পড়াচ্ছি কালিদাসের কুমারসম্ভব এবং পড়াচ্ছেন স্বয়ং মদন, এতেও কি ছাত্রদের কিঞ্চিৎ চিত্তচাঞ্চল্য ঘটতে পারে না?
চমকালেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর। চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন মদনমোহনের দিকে। মদনমোহন, যিনি পাণ্ডিত্যে তাঁর সমান-সমান, কোনও কথা বললেন না। শুরু করলেন তাঁর কালিদাস-ব্যাখ্যা। এবং বিদ্যাসাগর কিছুক্ষণ শুনলেন মুগ্ধ হয়ে।
এরপর মদনমোহন অভিমানে শিক্ষকতা ছেড়ে ১৮৫৫ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি নিলেন। এবং একটি চিঠিতে জানালেন, ‘পরমবান্ধব বিদ্যাসাগর আজ ছ’মাস কাল আমার সাহিত বাক্যালাপ করে নাই, আমি কেবল জীবন্মৃতের ন্যায় হইয়া আছি।’
মদনমোহনকে বেশিদিন জীবন্মৃত থাকতে হল না। মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে তিনি মারা গেলেন মুর্শিদাবাদে! সেদিন ১৮৫৮ সালের ৯ মার্চ। মদনমোহনের অকালমৃত্যুর পিছনে কি ঈশ্বরের অবদান নেই? যাই হোক, মদনমোহন রেখে গেলেন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী! মদনমোহনের মৃত্যুর পর জন্মাল তাঁর অষ্টম কন্যা মালতীমালা।
আরও পড়ুন-৬৫ ফুট দুর্গার ডাকের সাজ
অথৈ জলে পড়লেন মদনমোহনের স্ত্রী। শেষ পর্যন্ত মদনমোহনের স্ত্রীকে হাত পাততে হল ঠাকুরপো বিদ্যাসাগরের কাছে।
মদনমোহনের স্ত্রী নৃত্যকালীর মনে পড়ল সেই দুপুরবেলা। খুব খিদে পেয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। তিনি হাঁটতে-হাঁটতে চলে এসেছেন বন্ধু মদনের বাড়িতে। বন্ধু বাড়ি নেই, বিদ্যাসাগর জানেন। মদন তো ক্লাস নিচ্ছেন সংস্কৃত কলেজে। বিদ্যাসাগর মদনের বাড়িতে এসে দেখলেন মদনের স্ত্রী একা বসে ভাত খাচ্ছেন। বললেন, বৌদি, বড্ড খিদে পেয়েছে। কী খাব? নিজের ভাতের থালাটি নৃত্যকালী এগিয়ে দিলেন বিদ্যাসাগরের দিকে। বৌদির এঁটো থালা থেকেই পাশে বসে ভাত খেতে শুরু করেছেন বিদ্যাসাগর। এমন সময়ে হঠাৎ বাড়িতে ঢুকলেন মদনমোহন। সোজা চলে এলেন খাবার ঘরে। দেখলেন বিদ্যাসাগর আর স্ত্রী একই পাত থেকে দিব্য ভাত খাচ্ছেন! রসিকচূড়ামণি মদনমোহন বললেন :
ওহে বিদ্যাসাগর কর কী কর কী,
সব তুমি খেলে, আমি খাব কী!
আরও পড়ুন-লিগে খেলবে না মোহনবাগান
মদনমোহনের স্ত্রী দেখলেন, পাতে তখন সত্যিই বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। বললেন, তুমি যা আছে, তাই খাও। এঁটো থালাটি স্বামীর হাতে তুলে দিলেন তিনি। মদনমোহন মহা খুশিতে সেই থালা চাটছেন।
এসব কথা মনে পড়লে, নৃত্যকালীর চোখে জল এল। তিনি কি বিদ্যাসাগরের কাছে সামান্য সাহায্যটুকু পাবেন?
বিদ্যাসাগর তখনও হিসেব করছেন, কত টাকা তাঁর কাছে প্রিয় বন্ধু মদনের স্ত্রী পেতে পারেন! ঠিক কতটুকু তাঁকে দেওয়া উচিত?