কুমোরটুলির মৃৎশিল্পী মালা পাল। প্রতিমার রূপদান করেন। শুধুমাত্র এটুকুই তাঁর পরিচয় নয়। গত কয়েক বছর ধরে তিনি চালাচ্ছেন একটি স্কুল। কী হয় সেখানে? মাটির মূর্তি গড়া শেখানো হয়। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা মৃৎশিল্পের পাঠ নিতে যায় তাঁর কাছে। কেউ তাঁকে বলে দিদি, কেউ ম্যাডাম। ঠান্ডা মাথায় তিনি শিখিয়ে চলেন খুঁটিনাটি। কীভাবে তৈরি হয় মুখ, কীভাবে হাত, পা, হাতের আঙুল ইত্যাদি। সরল শিক্ষণপদ্ধতি। ছেলেমেয়েরা সহজেই আয়ত্ত করতে পারে। খুশি অভিভাবক অভিভাবিকারাও। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে মালা পালের স্কুলের কথা। প্রথম প্রথম শুনে অবাক হতেন অনেকেই। তাঁদের মুখের উপর মালা বলতেন, নাচ, গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকার স্কুল থাকলে মৃৎশিল্পের স্কুল কেন নয়?
আরও পড়ুন-বোধন কথা
মালা পালের জন্ম হয়েছে একটি মৃৎশিল্প-পরিবারে। বাবা ছিলেন দুলালচন্দ্র পাল। কুমোরটুলির প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী। বাংলার সাজের প্রতিমা তৈরিতে ছিল তাঁর খুব নামডাক। ছোটবেলায় বাবার কাজের প্রতি আকৃষ্ট হন মালা। আলাপচারিতায় তিনি জানান, স্টুডিওয় গিয়ে মন দিয়ে দেখতাম বাবার কাজ। তিনি দুর্গা প্রতিমা তৈরি করতেন। ইচ্ছে হত তাঁর সঙ্গে কাজে হাত লাগাই। বাবাকে বলতাম সেই কথা। কিন্তু বাবা কিছুতেই মাটি ছুঁতে দিতেন না। বলতেন, মেয়েদের জন্য এই কাজ নয়। তুই বাড়ি যা। কোনও কথা না বলে মুখ বুজে বাড়ি চলে আসতাম। আমার দাদা গোবিন্দ পাল। তিনি বর্তমান সময়ের একজন প্রতিষ্ঠিত মৃৎশিল্পী। দাদা জানতেন মাটির কাজের প্রতি আমার আগ্রহের কথা।
আরও পড়ুন-পায়ে পায়ে পাঁচ হাজার পর্ব রান্নাঘর
১৮৮৫ সালে চোখ বুজলেন বাবা। তারপর একদিন মালার কাছে এল কুমোরটুলির ডাক। অবশ্যই দাদার কাছ থেকে। তখন বয়স ১৪-১৫।
মালা জানালেন, হাজির হয়ে যাই দাদার স্টুডিওয়। শুরু করি কাজ। প্রথমদিকে বানাতাম ছোটখাটো জীবজন্তু। তারপর ছোট ছোট ঠাকুর। একটা সময় দুর্গা। এইভাবেই চলছিল। ১৯৮৬ সালে দাদা আমাকে পাঠান দিল্লিতে। ওখানে একটি কর্মশালায় বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ শেখার সুযোগ পাই। মনে পড়ছে, দুটো ছোট ছোট দুর্গা তৈরি করেছিলাম। কয়েক মাস থাকার পর আবার ফিরে আসি কুমোরটুলিতে। দাদার সঙ্গে পুরোদমে কাজ শুরু করি।
তারপর? একটা সময় দাদার আশীর্বাদ নিয়ে মালা স্বাধীন ভাবে কাজ করতে শুরু করেন। কোন সময়ে? মালা একটু ভেবে বলেন, নিজে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করেছি ১৯৯১-’৯২ সাল থেকে। প্রথমে অল্প, পরে বেড়েছে কাজ। ধীরে ধীরে ডানা মেলেছি। বাংলার বাইরে তো বটেই, আমার তৈরি দুর্গা প্রতিমা গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। বাইরে যায় মূলত ছোট ঠাকুর।
আরও পড়ুন-ফের ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল কাবুল, নিহত বহু
ছোট ঠাকুরের পাশাপাশি মালা তৈরি করেন বড় ঠাকুর। কয়েক বছরের মধ্যেই হয়েছে বিশেষ পরিচিতি। কুমোরটুলিতে তাঁকে সবাই এক ডাকে চেনেন। তাঁর তৈরি প্রতিমার জন্য লাইন পড়ে যায় ক্লাব কর্মকর্তাদের। তিনি হাসি মুখে সব সামলান। আছেন কয়েকজন কর্মচারী। সবাই মিলে করেন কাজ। কাজের ফাঁকে রান্না। এইভাবেই চলছে সমস্তকিছু।
হঠাৎ স্কুল খুলতে গেলেন কেন? মা দুর্গাকে সাজাতে সাজাতে উত্তর দিলেন মালা, কুমোরটুলির নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা মৃৎশিল্পের প্রতি খুব একটা আগ্রহী নয়। মাটির কাজের প্রতি তাদের চরম অনীহা। নতুন শিল্পী না এলে অন্ধকারে তলিয়ে যাবে সনাতনী এই শিল্প। এত বছরের ঐতিহ্য কুমোরটুলির। কত বিখ্যাত মৃৎশিল্পী এখানে জন্মেছেন, কাজ করেছেন। সেই পরম্পরা যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তো মস্তবড় ক্ষতি। এইসব সাতপাঁচ ভেবেই একদিন মনে হল, শিখিয়ে পড়িয়ে যদি নতুন নতুন মৃৎশিল্পী তৈরি করা যায়, কেমন হয়? ভাবা মাত্র কথা বলি দাদা-সহ কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁদের উৎসাহেই চালু করি স্কুল। প্রায় ছয় বছর আগে। ৪-৫ জন স্টুডেন্ট নিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে। প্রায় ৩৪। আমি কখনও কাউকে জোর করে ডাকিনি। যার মনে হয়েছে, স্বেচ্ছায় এসেছে। মাটির কাজের প্রতি এইসব ছেলেমেয়েদের আগ্রহ দেখে মনের মধ্যে আনন্দের ঢেউ ওঠে। উপলব্ধি করি, তাহলে সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। আছে আলো। এদের মধ্যে কয়েকজনকেও যদি ঠিকঠাক দাঁড় করিয়ে যেতে পারি, তা হলেই আমার এই উদ্যোগ সার্থক হবে।
আরও পড়ুন-সব মহিলার সুরক্ষিত-আইনি গর্ভপাতের অধিকার আছে
কবে ক্লাস হয়? মালা জানালেন, রবিবার। সারা সপ্তাহ অপেক্ষায় থাকি এই দিনটার জন্য। সবাই খুব মনোযোগ সহকারে শেখার চেষ্টা করে। বর্তমানে মাটি, খড়, রঙের দাম অনেকটাই বেড়েছে। তাই ক্লাসের জন্য মাসে এক হাজার টাকা নিতে হয় স্টুডেন্টদের কাছ থেকে। তিন বছরের কোর্স। কোর্স শেষে শংসাপত্র দেওয়া হয়।
শুরুতে কী কী শেখান? তিনি জানালেন, শুরুতে শেখানো হয় ছোট ছোট জীবজন্তু গড়া। তারপরে ছোট ছোট ঠাকুর। ক্লাসে যেসব জিনিস তৈরি হয় সেগুলো বিক্রি করা হয় না। অনেক সময় ভেঙে ফেলে আবার নতুন জিনিস তৈরি করা হয়। কেউ কেউ ক্লাসের তৈরি মূর্তি নিজেদের কাছে রেখে দেয়। জানেন তো, আমার প্রথম দিকের অনেক ছাত্রই এখন কুমোরটুলিতে কাজ শুরু করেছে। তাদের দেখে খুব আনন্দ হয়। আশা করি আগামীদিনে কুমোরটুলিকে আমি আরও অনেক মৃৎশিল্পী উপহার দিতে পারব।
আরও পড়ুন-চোটে বিশ্বকাপে অনিশ্চিত বুমরা
স্কুল চালানোর পাশাপাশি মৃৎশিল্পী হিসেবেও নিজে কাজ করে চলেছেন মালা। এই বছর ৩৫টা দুর্গা প্রতিমা তৈরি করেছেন। বেশ কয়েকটি গেছে দেশের বাইরে। বাকিগুলো বাংলার বিভিন্ন জেলায়।
প্রায় সমস্ত প্রতিমা চলে গেছে মণ্ডপে। দু-একটি বাদে। চলছে সেইসব প্রতিমা সাজানোর কাজ। সেগুলো মণ্ডপে চলে গেলে শূন্য হয়ে যাবে স্টুডিও। একটু তো মনখারাপ হবেই। পাশাপাশি হবে আনন্দও। কত মানুষ দেখবেন তাঁর তৈরি প্রতিমা। সেইসব প্রতিমা পাবে পুজো। কিছুদিন বাদেই আবার শুরু হবে আগামীর প্রস্তুতি। আগামী পুজোর প্রতিমা এবং আগামী প্রজন্মের মৃৎশিল্পীদের নিয়ে মেতে উঠবেন মালা। তাঁর দিকে তাকিয়ে গোটা কুমোরটুলি।