বোধন কথা

আজ মহাষষ্ঠী। শাস্ত্র অনুসারে মা দুর্গার বোধন হয় এদিন। বোধন অর্থাৎ দেবীকে জাগ্রত করার পৌরাণিক প্রথার প্রচলন সেই রামায়ণের সময় থেকে। আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে দেবীর অকালবোধন করেছিলেন রামচন্দ্র। এই দিনটিকে আবার বোধনষষ্ঠীও বলে। বোধন নিয়ে সবিস্তারে জানাচ্ছেন পার্থসারথি গোস্বামী

Must read

হিন্দু পুরাণ অনুসারে মর্ত্যে দুর্গাপুজার প্রচলন করেন রাজা সুরথ। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে জানা যায়, পৃথিবীর রাজা সুরথ যবন জাতির সঙ্গে এক যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে নিজ রাজ্য ও ধনসম্পত্তি হারিয়ে মনের দুঃখে বনবাসী হন। বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তিনি উপস্থিত হলেন ‘মেধা’ ঋষির আশ্রমে। ঘটনাক্রমে ঋষি মেধার কাছে তিনি জানলেন দেবী মহামায়ার প্রভাব, শুনলেন মহামায়ার কথা। এক এক করে ঋষি মেধা বর্ণনা করলেন মধুকৈটভের কাহিনি, শুম্ভ-নিশুম্ভের কাহিনি ও মহিষাসুরের কাহিনি।

আরও পড়ুন-পায়ে পায়ে পাঁচ হাজার পর্ব রান্নাঘর

ঋষি মেধার কাছে মহামায়ার মাহাত্ম্য শোনার পর রাজা সুরথ সমাধি নদীর তীরে দীর্ঘ তিন বৎসর কাল দেবী মহামায়ার কঠিন তপস্যা করেন ও বসন্ত কালে মহামায়া অর্থাৎ দেবী দুর্গার পুজা করেন। সুরথের কঠিন তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী দুর্গা সুরথকে দর্শন দেন ও রাজা সুরথ তাঁর রাজ্য ফিরে পান। রাজা সুরথ বসন্ত কালে দেবী দুর্গার পুজা করেছিলেন বলে সে-পুজা বাসন্তী পুজো নামেও পরিচিত।

আরও পড়ুন-ডায়েটিশিয়ান পেশার দিশা

বর্তমানে শরৎ কালে যে শারদীয়া দুর্গাপুজা হয়ে থাকে, তার উল্লেখ পাওয়া যায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও নানান হিন্দু পুরাণে। রাবণবধের জন্য রামচন্দ্র শরণাপন্ন হন দেবর্ষি ব্রহ্মার নিকট, দেবর্ষি ব্রহ্মা রামচন্দ্রকে পরামর্শ দেন যে, রাবণকে বধ করতে হলে দেবী দুর্গার বোধন করতে হবে। সময়টি ছিল শরৎকাল, যা ছিল সূর্যের দক্ষিণায়ন অর্থাৎ দেবতাদের রাত্রিকাল বা দেবতাদের নিদ্রালাভের সময়, সেই কারণে সেই সময় দেবী দুর্গার পুজা করতে হলে বোধন আবশ্যক। বোধন শব্দটির অর্থ হল জাগ্রত করা, আর অসময়ে এই বোধন করা হয়েছিল বলে রামচন্দ্র কর্তৃক প্রচলিত এই দুর্গাপুজাকে বলা হয় ‘অকালবোধন’। দেবীকে জাগ্রত করার জন্য আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে দেবীর পুজো করা হয়েছিল। ষষ্ঠী তিথি হল চান্দ্রমাসের ষষ্ঠ দিন। পুরাণ অনুসারে দেবী দুর্গা স্বর্গ থেকে এসে একটি বেল গাছে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন, সেই ধারাকে স্মরণ করেই তাই আজও এই শারদীয়া দুর্গাপুজা করার জন্য ষষ্ঠী তিথির সন্ধ্যায় বেল গাছের তলায় বা তাঁর স্বরূপ হিসাবে বেল গাছের ডাল মাটিতে পুঁতে তার তলায় প্রথমে দেবীর বোধন ও অধিবাস করে দেবীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যে প্রথাটি আবার বিল্ববরণ বা বেলবরণ হিসাবেও পরিচিত। মহালয়ার দিন থেকে দেবীপক্ষ শুরু হলেও বেলবরণ প্রথার মধ্য দিয়ে ষষ্ঠীর দিনই সূচনা হয় এই শারদীয়া দুর্গাপুজোর।

আরও পড়ুন-ফের ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল কাবুল, নিহত বহু

এ ছাড়াও মেয়েদের ব্রতকথা ও প্রচলিত ধারণা অনুসারে অদ্যাশক্তি দুর্গা আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন সন্তান কামনায় ষষ্ঠীপুজো করেন ও সন্তান লাভ করেন। বিভিন্ন পুরাণ ও কাব্যে দেবী ষষ্ঠীর উল্লেখ থাকলেও ষষ্ঠী হলেন লৌকিক দেবী, ইনি হলেন প্রজনন শক্তির দেবী। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে মনুর পুত্র রাজা প্রিয়ব্রত ব্রহ্মার নির্দেশে বিবাহ করেন, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। কশ্যপ মুনির সাহায্যে তিনি পুত্রষ্ঠি যজ্ঞ করলেও রাজমহিষী মৃত সন্তান প্রসব করেন। মর্মাহত রাজা মৃত সন্তানকে নিয়ে শ্মশানে উপস্থিত হলে ষষ্ঠীদেবী আবির্ভূত হয়ে নিজ পরিচয় দান করেন। ষষ্ঠী দেবী সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে রাজা স্তব পাঠ করে ষষ্ঠী দেবীকে প্রসন্ন করেন। রাজার আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী রাজাকে বলেন যে, রাজা নিজে যদি ষষ্ঠীর পুজার আয়োজন করেন ও সমগ্র রাজ্যে ষষ্ঠীদেবীর মাহাত্ম্য প্রচার করেন তাহলে তিনি এই মৃত পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দেবেন। দেবীর কথায় আশ্বস্ত হয়ে রাজা ষষ্ঠী দেবীর পুজো করলেন ও সেই থেকে সমস্ত রাজ্যে নির্দেশ দিলেন প্রতি মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে দেবী ষষ্ঠীর পুজা করার জন্য এবং সেই থেকেই লোকসমাজে দেবী ষষ্ঠীর পুজো প্রচলিত হয়। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিকে বলা হয় দুর্গাষষ্ঠী বা বোধনষষ্ঠী। এই দিন সন্তানবতী মায়েরা দূর্বা, ধূপ, আতপচাল, ফল, মিষ্টি প্রভৃতি দিয়ে পুজো করে সারাদিন ভাত বা চালের তৈরি কোনও খাবার না খেয়ে এই ব্রত করেন এবং রাত্রে পুজার পর ব্রতকথা শুনে পুজার প্রসাদ খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করেন। কোথাও কোথাও আবার বলা হয়েছে ষষ্ঠী হলেন দুর্গারই রূপ, ষষ্ঠীমঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে, ‘দুর্গা নামে ষষ্ঠী পুজি আশ্বিনে আনন্দ/যেই বর মাগে পায় তার নাই সন্দ’।

আরও পড়ুন-সব মহিলার সুরক্ষিত-আইনি গর্ভপাতের অধিকার আছে

আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথি সাধারণ ভাবে শারদীয়া দুর্গাপুজোর প্রারম্ভ ধরা হলেও স্থান কাল ও রীতি অনুসারে এর ভিন্নভেদ যে নেই এমনটাও নয়। পশ্চিমবঙ্গের এক সুপ্রাচীন, ঐতিহ্যময় ও মল্লরাজাদের স্মৃতি বিজড়িত শহর হল বিষ্ণুপুর। এক কালের এই মল্ল রাজধানীতে অনেকগুলি দুর্গাপুজো হলেও মল্লরাজার এই দুর্গাপুজো প্রায় ১০২৫ বৎসরের পুরাতন। মা দুর্গা এখানে দেবী মৃন্ময়ী নামে পূজিত হন। আজকের দুর্গাপুজোর পীঠষ্ঠান হিসাবে পরিচিত কলকাতার সৃষ্টির বহু পূর্বেই ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ জগৎমল্ল এই পুজোর প্রবর্তন করেন। এই দুর্গাপুজো নানান দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য হলেও, এই পুজোর প্রধান ও উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হল বাকি সব দুর্গাপুজো ষষ্ঠী দিনে শুরু হলেও এই পুজা শুরু হয় জিতা অষ্টমীর দিন। নিকটবর্তী কৃষ্ণসায়রে বড়ঠাকরুনের পটের স্নান, আগমন ও ৯টি তোপধ্বনির মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় মল্লরাজাদের কুলদেবী মাতা মৃন্ময়ী দেবীর পুজো। অন্যান্য পুজার সময়কাল চার বা পাঁচদিন হলেও মল্লরাজাদের এই দুর্গাপুজা চলে ১৮ দিন ব্যাপী। বলি নারায়ণ মতে চলে এই পুজার আচার আচরণ, সমস্ত নিয়ম ও মন্ত্রপাঠ। মাতা মৃন্ময়ী দেবীর মূর্তি গঙ্গামাটি দিয়ে তৈরি, এখনও পর্যন্ত যে বৎসর রাজ পরিবারের কেউ না কেউ স্বপ্নাদেশ পান সেই বৎসরই হয় দেবীর অঙ্গরাগ। মূর্তিপুজোর পাশাপাশি এখানে প্রচলন আছে পটপুজোর, নিয়ম করে নির্দিষ্ট দিনে মন্দিরে প্রবেশ করে বড়, মেজো ও ছোট ঠাকুরানির পট। মহাকালী হিসাবে বড় ঠাকরুণ, মেজো ঠাকরুণ হিসাবে মহালক্ষ্মী ও দেবী সরস্বতীকে ছোট ঠাকরুন রূপে পুজো করা হয়, সেই হিসাবে হয় মন্ত্রোচ্চারণ।

আরও পড়ুন-চোটে বিশ্বকাপে অনিশ্চিত বুমরা

শোনা যায় শুরুর দিকে মাতা মৃন্ময়ী দেবীর পুজাতে বলিদান প্রথা থাকলেও, মল্লরাজ বীরহাম্বির বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করার পর বন্ধ হয় বলিদান প্রথা। সেই সময় থেকেই শব্দকেই ব্রহ্ম রূপে জ্ঞান করা হয়, তাই শুরু হয় তোপধ্বনি। মহা-অষ্টমীর সন্ধিক্ষণের পর আবার করা হয় তোপধ্বনি, সেই তোপধ্বনির পর শুরু হয় সন্ধিপুজো, সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, আজকের দিনও নিয়ম মেনে মল্লরাজার মহা-অষ্টমীর সন্ধিক্ষণের এই তোপধ্বনি শোনার পর তবেই মল্লভূমের অন্যান্য দুর্গাপুজোয় শুরু হয় সন্ধিপুজা। জনশ্রুতি, পূর্বে মহা-অষ্টমীর এই কামানের গর্জন শোনা যেত বাঁকুড়া ছাড়িয়ে পুরুলিয়া এমনকী বীরভূম জেলার নানা স্থানেও। বর্তমানে রাজতন্ত্র না থাকলেও মৃন্ময়ী দেবীর এই পুজোর গরিমা ও ঐতিহ্য কোনও ভাবেই খর্ব হতে দেন না বর্তমান রাজ পরিবারের সদস্যরা। এ-পুজো শুধু রাজবাড়ি নয়, সমগ্র বাঁকুড়াবাসীর আবেগ ও গরিমা জড়িয়ে এই পুজোর সঙ্গে।

আরও পড়ুন-পুজো কাটুক কাছের মানুষ-এর সঙ্গে

তবে স্থান ও রীতির প্রভেদে থাকলই বা নানান স্থানে নানান আচার বা নানান নিয়ম, সমস্ত বাঙালির কাছেই শারদীয়া দুর্গাপুজো এক অন্য আবেগ। এই পুজো ঘুচিয়ে দেয় সমস্ত বিভেদ ও মতান্তর। জাতপাত উঁচু-নিচু ও ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে দুর্গাপুজো হয়ে ওঠে সকলের উৎসব। সব ভুলে আপামর বাঙালি জানে দুর্গা সবার মা, সেই ভাবনার সুর যেন মিলে যায় স্তবমন্ত্রে,আমরা সকলেই একজোট হয়ে বলে উঠি— ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

Latest article