ইতিহাস অনুসারে, পৃথিবীর নানা প্রান্তে শস্যদেবী পূজিতা হতেন নানা নামে। প্রাচীন ক্রিটে তিনি ছিলেন রহ্য়া। তাঁরই ফ্রিজীয় প্রতিরূপ সিবিলি। আসিরীয় সভ্যতায় তিনিই ইসতার। আবার জার্মানিতে তিনিই নের্থাস।
আশ্চর্যজনকভাবে, ভারতবর্ষের বাইরে পূজিতা এই প্রাচীন দেবীগণ শুধু যে শস্যের দেবী, তা নন। রহ্য়া, সিবিলি, ইসতার-রা সিংহবাহিনী।
ইতিহাসবিদ আর প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলেন, ব্যাবিলনীয় মাতৃদেবী ননার সঙ্গে দুর্গার (Goddess Durga) যোগাযোগ সুস্পষ্ট। সমরখন্দ, অর্থাৎ যেখান থেকে মুঘলসম্রাট বাবর এসেছিলেন সেখান থেকে প্রায় ৭০ কিমি দূরে অবস্থিত শহরের নাম ছিল পেনজিকেন্ট। সেখানকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী এই ননা। তিনিও দুর্গার মতোই সিংহবাহিনী।
অর্থাৎ, শুধু সনাতন ভারত-ভাবনাতেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শস্যের দেবী হয়ে বুভুক্ষের দুর্গতি মিটিয়ে দেন। এবং সর্বত্রই তিনি সিংহবাহিনী দুর্গারই রূপান্তর। কেবল স্থানভেদে নামভেদ। সুতরাং, শুধু দেবলোকে নন, শুধু পুরাণকারের কল্পনাতেই নন, সর্বত্র দুর্গতিনাশিনী হিসেবে দেবী দুর্গা পূজিতা হন।
পূজিতা হন কখন? শরতে আর বসন্তে। বেদে এই দুটি ঋতুকেই যমদংষ্ট্রাকাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যমের দাঁতের মুখে পড়ে মানুষ এই দুই ঋতুতে। রোগ ব্যাধির প্রকোপ বাড়ে। মহামারীর সৌজন্যে মৃত্যু ছড়ায়। সেই দুর্গতিনাশের আশাতেই শস্যরূপিণী দানবদলনী দেবীর আরাধনায় মাতে মানুষ। উৎসব পালিত হয় দিকে দিকে। শ্রীশ্রীচণ্ডীর স্তোত্রে দেবতাদের প্রার্থনামন্ত্র। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতা’। অর্থাৎ যে মহাদেবী সকল প্রাণীতে বিষ্ণুমায়া বলে কথিত, দেবতারা প্রণতি জ্ঞাপন করছেন তাঁর প্রতি। বরাহপুরাণ অনুসারে, বিষ্ণুমায়া আর কেউ নন, তিনি জল আর শস্যের দেবী। খিদে তেষ্টা মেটানোর অনিবার্য প্রশ্রয়দাত্রী। সেই কারণেই তিনি জীবনের আশ্রয়। সর্বপ্রকার দুর্গতিহারিণী। জীবনদাত্রী, আনন্দময়ী।
খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম-সপ্তম শতাব্দীর সময়কার কথা। এশিয়া মাইনরের আনাতোলিয়ার ফ্রিজীয় জাতি গুহার ভেতর সিংহবাহনা এক দেবীর পুজো করত। তাদের ভাষায় তারা সেই দেবীকে ডাকত ‘গদান মা’ নামে। ভাষাচার্য সুকুমার সেন বলছেন, সংস্কৃতে যদি ‘গদান মা’ শব্দটিকে অনুবাদ করা হয়, তবে সেটির অর্থ দাঁড়ায় ‘ক্ষমা’। ক্ষমা আর সহিষ্ণুতার অর্থ হল নিষ্ঠুরতা আর অসহিষ্ণুতার উৎকট উল্লাসের কারণে যে দুর্গতি, তার থেকে মুক্তি।
আরও পড়ুন-গ্লাসগোয় নিয়ম মেনে হয় অষ্টমীর সন্ধিপুজো
এ-জন্য শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবতাদের প্রার্থনা সূক্তে উচ্চকিত এই তাৎপর্য, ‘যা দেবী সর্বভূতেষু ক্ষান্তিরূপেণ সংস্থিতা’। যে ব্রহ্মশক্তি সকল জীবে ক্ষমারূপে অধিষ্ঠিতা, দেবতারা তাঁকেই বারবার প্রণাম জানাচ্ছেন।
পৃথিবীর নিঃসীম বিস্তার, তার রূপ-বৈচিত্র্য ও বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি, তার অন্নদা আর ধনদা রূপ, তার বুকে সংগুপ্ত অনন্ত প্রাণশক্তি, নিরন্তর অসংখ্য রূপে তার প্রকাশ, এই সবকিছু মিলেমিশে যে বিস্ময়জনিত শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়ে তুলেছে মানুষের মনে, সভ্যতার সেই আদিম ঊষালগ্ন থেকে, দেবী দুর্গার ভাবনায় তারই স্পষ্ট প্রতিফলন। শশিভূষণ দাশগুপ্ত এ ব্যাপারে লিখেছেন, “এই শ্রদ্ধার প্রগাঢ়তায়ই মানুষের ধর্মবোধের উদ্বোধন এবং সেই ধর্মবোধকে অবলম্বন করিয়াই পৃথিবীর দেবীমূর্তি।’’
সেই পৃথিবী রূপিণী দেবীই আসলে দুর্গা (Goddess Durga) দুর্গতিনাশিনী। তাঁকে বারবার আসতে হয় অসুর সংহারের সংকল্প নিয়ে। ভিন্ন ভিন্ন রূপে। দেবতারা তাঁকে যুগে যুগান্তরে ডেকেছেন, সেই ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি সৃষ্টির নানা কল্পে এসেছেন। দেবতাদের এই বারংবার তাঁকে ডাকার কারণ একটাই। তাঁদের বারবার স্বর্গসুখ চলে যাওয়া। আর সেই সুখ ফিরে পাওয়ার বাসনা। মনের ভেতর কাম, ক্রোধ, লোভ, লালসার বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রেম, অহিংসা, সহিষ্ণুতা, সাম্য আর মৈত্রীকে আঁকড়ে থাকার ইচ্ছায় ভাটা পড়ে বারবার। প্রকৃতির অশুভ স্রোতে গা ভাসিয়ে সোমরস আর অপ্সরা সংসর্গের মজায় ভেসে যান তাঁরা মাঝে মাঝেই। ফলে ক্ষয়ে যায় তাঁদের বলবীর্য, নিভে যায় তেজ, নষ্ট হয়ে যায় সাহস আর মানসিক শক্তি। সেই সুযোগে বেড়ে ওঠে অসুররা। কঠোর তপস্যা করে তারা অর্জন করে অদম্য বল। অপ্রতিহত সামর্থ্য। আর বলীয়ান হয়েই তারা দেবশক্তির ওপর আক্রমণ শানায়। অবাধ ভোগের নির্বাধ তাণ্ডবে চারিদিকে ত্রাস ছড়ায়। তখনই দরকার পড়ে দুর্গতিনাশিনী নারীশক্তির। ডাক পড়ে দুর্গার। এ কেবল পৌরাণিক আখ্যায়িকাতেই সীমায়িত বিষয় নয়। মানব মনস্তত্ত্বের নিত্য লীলাতেও এর বাস্তবতা স্বীকৃত। ইতিহাসের পরিসরেও এর উপস্থিতি অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। ভারতবর্ষেও এখন সেই শকুনক্রান্তির প্রহর। অসহিষ্ণুতার প্রসৃতি। বুলডোজার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সংখ্যালঘুর বাসস্থান। তাদের এবং দলিতের ঘরের উমারা হচ্ছেন গণধর্ষিতা আর ব্রাহ্মণত্বের অযৌক্তিক উচ্চারণে ধর্ষণকারীর দল পাচ্ছে সংবর্ধনা। ইতিহাস বদলে ঘুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের পরম্পরা। এই দুঃসহ প্রহরে আমাদের একজন দুর্গাকেই (Goddess Durga) যে দরকার। নারীশক্তির হাতেই হবে এসব দুর্জনের নিধন। এসব অত্যাচারীর নিপীড়কের সংহার।
আজ, তাই অষ্টমীর প্রার্থনা, তুমি আবার এসো মা। তোমার মমতাময়ী রূপে দানবদলনের পর্বের পুনঃ সংঘটন ঘটুক। ভারত তার সনাতন ঐতিহ্যে থিতু হোক।
জয় মা।