১৬১০ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সাবর্ণ রায়চৌধুরির বাড়ির দুর্গাপুজো। পুজো শুরু হয়েছিল প্রায় ৩৫ পুরুষ আগে। শুরু করেছিলেন লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়। তিনিই পরবর্তীতে সাবর্ণ রায়চৌধুরি নামে পরিচিত হন।
লক্ষ্মীকান্তর বাবা জিয়া গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন খ্যাতনামা সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। তিনি থাকতেন সেকালের কালীক্ষেত্র অধুনা কালীঘাট অঞ্চলে। ১৫৭০-এ মারা যান জিয়ার পত্নী পদ্মাবতী দেবী। পুত্রসন্তান লক্ষ্মীকান্তের জন্ম দিতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। পত্মী বিয়োগের পর জিয়া সংসারের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েন। কামদেব ব্রহ্মচারী নাম গ্রহণ করে সন্ন্যাস নিয়ে তিনি বারণসীতে চলে যান। লক্ষ্মীকান্ত কালীঘাটের পুরোহিতের কাছে মানুষ হতে থাকেন।
আরও পড়ুন-চিন্ময়ী রূপে কুমারী পুজো
বারাণসীতেই কামদেব ব্রহ্মচারীর সঙ্গে দেখা হয় বাদশাহ আকবরের সেনাপতি অম্বরের রানা মান সিংহের। মান সিংহ কামদেব ব্রহ্মচারীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
কামদেব ব্রহ্মচারীর পার্থিব বিষয় বাসনা ছিল না। তিনি বহু অনুরোধ উপরোধ সত্ত্বেও মান সিংহের কাছ থেকে কিছু নেননি। শেষ পর্যন্ত মান সিংহ গুরুদক্ষিণা হিসাবে লক্ষ্মীকান্তকে নিষ্কর জায়গীর পাইয়ে দেন। এই নিষ্কর জায়গীর প্রদানের জন্য মান সিংহ রাজি করিয়েছিলেন বাদশাহ জাহাঙ্গিরকে। জায়গীর প্রদানের ঘটনাটা ঘটেছিল ১৬০৮ সালে।
উত্তরে হাভেলি শহর, অধুনা হালিশহর, থেকে শুরু করে আজকের কলকাতার দক্ষিণে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত সুবিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল সেই জায়গীর।
মুঘল বাদশাহ লক্ষ্মীকান্তর দলিল দস্তাবেজ সামলানো আর হিসাবপত্র রক্ষণাবেক্ষণ দেখে মুগ্ধ হন। তাঁকে প্রথমে মজুমদার, পরে রায়, তারও পরে চৌধুরি উপাধি প্রদান করা হয়।
আরও পড়ুন-৬ রাজ্যের ৭ কেন্দ্রে উপনির্বাচন ৩ নভেম্বর
জায়গীরদার হওয়ার দু’বছর পর, ১৬১০ সালে লক্ষ্মীকান্ত ও তাঁর স্ত্রী ভগবতী দেবী ঠিক করেন বড়িশাতে দুর্গাপুজো শুরু করবেন। বড়িশাই ছিল তাঁদের জায়গীরের অধীনে বৃহত্তম পরগনা।
এই সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বাড়ির পুজোতেই প্রথম দেখা গেল সপরিবারে দুর্গা একচালায় অধিষ্ঠান করছেন, পূজিতা হচ্ছেন। সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ সমেত একচালাতেই পুজো পেলেন মা দুর্গা এই সাবর্ণ রায়চৌধুরির বড়িশার বাড়িতে।
২০২২-এ সেই পুজো ৪১৩ বছরে পদার্পণ করল। এখন সাবর্ণ রায়চৌধুরিদের ছটি বাড়িতে দুর্গা পূজিতা হন। আটচালা বাড়ি, বড় বাড়ি, মেজ বাড়ি, মাঝের বাড়ি, কালীকিঙ্কর বাড়ি আর বেনাকি বাড়ি। সব ক’টিই বড়িশাতে। এছাড়া আরও দুটো বাড়িতে পালিত হয় দুর্গা-উৎসব। বিরাটি বাড়ি ও পাঠানপুর বাড়িতে।
আরও পড়ুন-তেহরান থেকে চিনগামী বিমানে বোমাতঙ্ক
মহাকবি বিদ্যাপতির দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনীতে যা যা বিধানের কথা লেখা আছে সেগুলোর সব ক’টি মেনেই এই বাড়িগুলোতে পুজো হয়। এখন শুধু যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বন্ধ হয়েছে বলিপ্রথা। আটটি বাড়িতেই এখন অনুষ্ঠিত হয় প্রতীকী বলি।
পাঠানপুর বাড়িতে যে পূজানুষ্ঠান হয় সেটাতে ব্যবহৃত হয় জাহাঙ্গিরের মোহর। জাহাঙ্গির মোহরগুলো লক্ষ্মীকান্তকে দিয়েছিলেন। ১৬০৮ থেকে ১৭৫৭, এই দেড়শো বছর ধরে সাবর্ণ রায়চৌধুরিদের বাড়িতে গোঁড়ামির ছোঁয়া থাকেনি দুর্গাপুজোয়। জাহাঙ্গির যেমন জায়গীর দেওয়ার ব্যাপারে হিন্দু-মুসলমান বিচার করতেন না, সে কথা মাথায় রেখেই এ বাড়ির পুজোতে ধর্মনিরপেক্ষ চারিত্র বজায় রাখার পরম্পরা বজায় থেকেছে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাবর্ণ রায়চৌধুরিদের সব প্রজা শাকসবজি, ফলমূল, ফুল যা কিছু আনতেন বা আনেন, তা দেবীকে নিবেদন করা হয়। আজ হয়তো ‘প্রজা’ বলে কেউ নেই সাবর্ণ রায়চৌধুরিদের, কিন্তু আটটা বাড়ির প্রতিবেশীরা ধর্মপরিচয় নির্বিশেষে উপহার উপচার নিয়ে আসেন মা দুর্গার জন্য। সবই দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। এই পরম্পরায় কোনও ছেদ পড়েনি।
আরও পড়ুন-বাংলা সিনেমায় দুর্গাপুজো
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাবর্ণ রায়চৌধুরিদের সঙ্গে মুঘল বাদশাহদের সম্পর্ক ছিল কমপক্ষে ৪৮৬ বছর ধরে। লক্ষ্মীকান্তর পূর্বপুরুষ পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে হুমায়ুনের যোগাযোগ ছিল। তিনি হুমায়ুনের পক্ষাবলম্বন করে শেরশাহর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এজন্য তাঁকে শক্তি খান উপাধি প্রদান করা হয়। হালিশহরে ৮৫টি গ্রামের জায়গীরদারী পান তিনি।
আজও সাবর্ণ রায়চৌধুরিদের বড় বাড়িতে জাহাঙ্গিরের দেওয়া হিরের আংটি, শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের দেওয়া তরবারি, শাহ আলমের উপহার রৌপ্যমুদ্রা, বাবর ও জাহাঙ্গিরের দেওয়া সুগন্ধী আর খাবারে বিষ মেশানো আছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য পাত্র, এ-সবকিছু সংরক্ষিত আছে।
এই মুঘল সংযোগ একটা কথাই মনে করিয়ে দেয়।
কলকাতার দুর্গাপুজোয় হিন্দি হিন্দুত্বের স্পর্শরহিত একটা ধর্মনিরপেক্ষ গরিমা আছে। সেটা বজায় রাখার দায় আমাদেরই।