সংবাদদাতা, কাটোয়া : জমিদারি চালানোর পাশাপাশি সাহিত্যসৃষ্টিতেও নজর কেড়েছিলেন ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। পঞ্চানন্দ ও পাঁচু ঠাকুর ছদ্মনামে শ্লেষ ও ব্যঙ্গের মিশেলে তাঁর লেখা তৎকালীন সমাজের দর্পণ। ওকালতি ছিল তাঁর পেশা। তার আগে কিছুকাল শিক্ষকতাও করেন। একদিন কাজের শেষে সন্ধে পার করে গরুর গাড়িতে কেতুগ্রামের গঙ্গাটিকুরিতে নিজের বাড়ি ফিরছিলেন জমিদার ইন্দ্রনাথ। উদ্ধারণপুর থেকে মেঠো পথে ফেরার সময় নজরে পড়ে এক মহিলা ছেলেমেয়েদের নিয়ে রাস্তায় অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে।
আরও পড়ুন-হাওড়ায় পরিবেশবান্ধব বিসর্জন
কাছে আসতেই মহিলার আকুতি, ‘‘ছেলেমেয়েদের নিয়ে বড় বিপদে পড়েছি। যদি একটা রাতের আশ্রয় দেন।’’ সহৃদয় জমিদার আর্জি মঞ্জুর করে তাঁদের গাড়িতে তুলে বাড়ির সিংদরজায় নামিয়ে দিলেন। অন্দরমহলে গিয়ে কর্মচারীদের ডেকে ওঁদের আপ্যায়নের নির্দেশ দিলেন। তারা এসে জানায়, কোথাও কোনও অতিথি নেই। সেই রাতেই স্বপ্নাদেশ পান ইন্দ্রনাথ, ‘‘আমি মহামায়া। আমার ২ ছেলে গণেশ-কার্তিক আর ২ মেয়ে লক্ষ্মী-সরস্বতীকে নিয়ে তোর কাছে আশ্রয় চেয়েছিলাম। এবার থেকে আমার স্থায়ী আশ্রয়ের বন্দোবস্ত কর।’’ এ কাহিনি ১২৯৭ বঙ্গাব্দের। তখন গঙ্গাটিকুরির জমিদারদের যৌথ পুজো হত। তাতে ইতি টেনে ইন্দ্রনাথ নিজেই আলাদা ঠাকুরদালান তৈরি করে মহামায়ার পুজো শুরু করেন। ঠাকুরদালানের স্থাপত্যশৈলী দেখতে আজও বহু মানুষ গঙ্গাটিকুরি আসেন। কাটোয়ার প্রাচীন ইতিহাস গবেষক রণদেব মুখার্জি জানান, আগ্রা থেকে মিস্ত্রি এনে দামি বেলজিয়াম কাচ দিয়ে ৪ বছর ধরে ১০ লাখ ৭৩ হাজার টাকায় গড়া হয় নাটমন্দির। প্রতিটি খিলানে রয়েছে রাজস্থানি মিনের কাজ।
আরও পড়ুন-দূষণ পর্ষদের বিধি মেনে বিসর্জন
বর্তমান প্রজন্ম শক্তি বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়রা বলছিলেন, ‘‘কাজ অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কয়েক বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষ শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিখ্যাত কারিগরদের দিয়ে কয়েক লক্ষ টাকায় নাটমন্দিরের পুরনো উৎকর্ষ ফিরিয়ে আনেন।’’ সাধারণ নারীর বেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে দুর্গা এখানে ঘরের মেয়ে হিসেবে পূজিত। পুরনো রীতি, আচার আজও বজায়। জমিদারি মুছে গেলেও রুপোর ছাতা সহযোগে পালকিতে ঘট ভরতে যান পরিবারের সদস্যরা। বর্ধমান জেলার প্রাচীন দুর্গাপুজোগুলির মধ্যে গঙ্গাটিকুরির এই ‘পঞ্চানন্দের দুর্গোৎসব’ অন্যতম। দু’দশক আগেও পুজোয় জমিদার বাড়িতে কলকাতার দল থিয়েটার করত।
আরও পড়ুন-বাতাসে আজ বিদায়বেলার ভৈরবী
যাত্রাপালা, কবিগানের আসর বসত। এই বাড়ির বধূ ভরতনাট্যম খ্যাত শিল্পী ও ‘ছন্দনীড়’ ছবির নায়িকা অঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফি-পুজোয় তিনি যোগ দেন। মহেন্দ্র গুপ্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়-সহ বহু বিখ্যাত মানুষ এই নাটমন্দিরে পা রেখেছেন। সিংদরজার মাথায় হরিণের মাথা, বাঘের মুখ, সাবেকি আমলের গ্যাসবাতি, পালকি, আধমণি তালা, পানঘর, মজলিশখানা অতীতের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।