যোধাবাইয়ের অনুরোধে সেনাপতির পুজোর শুরু ৪১৫ বছর আগে বারাসত শিবের কোঠায়

দিল্লির রাজমাতা সম্রাট আকবরের স্ত্রী যোধাবাইয়ের নামে সঙ্কল্প করে বাংলার তৎকালীন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে কীভাবে শুরু হয় পুজোর, তা এক কৌতূহলোদ্দীপক ইতিহাস।

Must read

অনীশ ঘোষ, বারাসত: ৪১৫ বছর আগে, ১৬০৭ সালে দিল্লির মসনদে তখন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির। সে বছরই বারাসতের দক্ষিণপাড়া শিবের কোঠায় শুরু বাংলার বারো ভুঁইয়ার অন্যতম যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রধান সেনাপতি শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির ঐতিহাসিক দুর্গাপুজো। দিল্লির রাজমাতা সম্রাট আকবরের স্ত্রী যোধাবাইয়ের নামে সঙ্কল্প করে বাংলার তৎকালীন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে কীভাবে শুরু হয় পুজোর, তা এক কৌতূহলোদ্দীপক ইতিহাস।

আরও পড়ুন-পঞ্চানন্দর দুর্গোৎসবে আজও আকর্ষণ কাচ বসানো নাটমন্দির

সম্রাট আকবর বাংলার বারো ভুঁইয়াদের সকলকে বশে আনলেও যশোরের রানা প্রতাপকে বাগে আনতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর পর বাবার ইচ্ছাপূরণে জাহাঙ্গির বাংলার সুবেদার করে পাঠান মামা মান সিংহকে। প্রতাপাদিত্যের মূল শক্তি ছিলেন তাঁর সেনাপতি, প্রধান অমাত্য ও উপদেষ্টা শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। গুপ্তচরের মাধ্যমে প্রতাপের বলভরসা, দুর্গের গুপ্তপথ ইত্যাদি সব হদিশ জানার পর একদিন রাতের অন্ধকারে প্রতাপের দুর্গ আক্রমণ করেন মান সিংহ। দীর্ঘ লড়াইয়ে হারিয়ে প্রতাপাদিত্য ও সেনাপতি শঙ্করকে বন্দি করে দিল্লি নিয়ে যান তিনি। বন্দি অবস্থায় বারাণসীতে মৃত্যু হয় প্রতাপাদিত্যের। জাহাঙ্গিরের নির্দেশে যাবজ্জীবন কারাবাস হয় শঙ্করের। এর কিছুদিন পরই ছিল সে বছরের দুর্গাপুজো।

আরও পড়ুন-হাওড়ায় পরিবেশবান্ধব বিসর্জন

মহালয়ার ভোরে পিতৃপুরুষের তর্পণের অনুমতি চান জেলবন্দি শঙ্কর। জাহাঙ্গির সে আবেদন নাকচ করে দিলে প্রতিবাদে জেলে আমরণ অনশন শুরু করেন শঙ্কর। যোধাবাই তখন ছেলেকে বলেন শঙ্করকে তর্পণের অনুমতি দিতে। যমুনায় দাঁড়িয়ে শঙ্কর যখন তর্পণের মন্ত্রোচ্চারণ করছেন, বোরখার আড়াল থেকে শুনে মুগ্ধ হন যোধাবাই। সেই রাতেই তিনি স্বপ্নে দুর্গার চিন্ময়ী রূপ দেখেন। পরের দিন জাহাঙ্গিরকে বলেন শঙ্করকে মুক্তি দিতে। জেলে গিয়ে শঙ্করের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে অনুরোধ করেন বাড়ি ফিরে দুর্গাপুজোর আয়োজন করার। শঙ্কর ছিলেন শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি দুর্গাপুজোয় রাজি হচ্ছিলেন না। শেষে রানি বলেন তাঁর নামে সঙ্কল্প করে পুজো করতে। পুজোর সব খরচ তিনিই বহন করবেন বলেও জানান। দিল্লি থেকে সুদূর বারাসতে এসে পুজোয় অঞ্জলি দেওয়ার ইচ্ছাও জানান রানি। এর পর আর না করতে পারেননি শঙ্কর।

আরও পড়ুন-দূষণ পর্ষদের বিধি মেনে বিসর্জন

যদিও অসুস্থতার কারণে শেষ পর্যন্ত যোধাবাইয়ের পুজোয় আসা হয়নি, তবে দুঃখপ্রকাশ করে তাঁর একটি চিঠি আসে শঙ্করের কাছে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বারাসতে ফিরে দুর্গাপুজো শুরু করেন সেনাপতি শঙ্কর। পুরুষানুক্রমে চলে আসা পুজোর বয়স হল ৪১৫ বছর। শঙ্করের বংশের দ্বাদশ পুরুষ এখন পুজোর দায়িত্বে। পরবর্তীকালে যোধাবাইয়ের বদলে এলাকার অধিবাসীদের নামে পুজোর সঙ্কল্প চালু হয়। রীতি মেনে কাঠামো পুজো হয় জন্মাষ্টমীর দিন। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বোধন। পাঁঠাবলির রীতি বদলে এখন হয় চালকুমড়ো আর আখবলি। সপ্তমীতে বলির হাঁড়িকাঠটি স্থাপনের আগেই এলাকার প্রতিটি বিধবা মহিলা অন্নগ্রহণ সেরে ফেলেন। নবমীতে হাড়িকাঠ উঠে যাওয়ার পরই তাঁরা ফের অন্নগ্রহণ করেন। মাঝে শুধু ফলাহার। এক সময় এই পুজোয় এসেছেন পরিবারের জ্ঞাতি সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, মহানায়ক উত্তমকুমার প্রমুখ বিশিষ্টজন। সেনাপতির বাড়ির এই প্রাচীন পুজোয় জাঁকজমক নেই, আছে নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা। আছে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের উপস্থিতি।

Latest article