স্বামী বিবেকানন্দ আশ্চর্য ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। আলমোড়া থেকে ২৯ জুলাই ১৮৯৭ লেখা চিঠিতে ‘কল্যাণীয়া মিস নোবল’কে তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন, “ভারতের কাজে তোমার এক বিরাট ভবিষ্যৎ রয়েছে।” ভারতে আসার পর গুরু-কর্তৃক মার্গারেটের নামকরণ হল ‘নিবেদিতা’। মার্গারেটের মনে পড়ল তাঁর ভক্তিমতী মা মেরি ইসাবেল-এর কথা। গর্ভস্থ সন্তানের কল্যাণ কামনায় তিনি মার্গারেটকে আগাম নিবেদন করেছিলেন ঈশ্বরের কাছে : সন্তানটি সুস্থভাবে জন্ম নিলে হে ঈশ্বর, এ শিশুটি তোমাকেই দেব। ভগিনী নিবেদিতা তাঁর সারা জীবন দিয়ে মায়ের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে গেছেন, সার্থক করে গেছেন গুরুদেবের নামকরণ। তিনি আক্ষরিক অর্থেই নিবেদিতা— তাঁর আদর্শের প্রতি, তাঁর গুরুর শিক্ষার প্রতি, তাঁর প্রিয় ভারতবর্ষের প্রতি। সার্থক সে নাম। ভারতবর্ষের জন্য আক্ষরিক অর্থেই তিনি নিবেদিতা, সেকথা বাকি সম্পূর্ণ জীবন দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন— দার্জিলিংয়ের নির্জন শ্মশান প্রান্তরে নিবেদিতার যে অনাড়ম্বর স্মৃতিস্তম্ভ তার ভাষায় বলা যেতে পারে, “who gave her all to India.”
আরও পড়ুন-মানুষের অভাব-অভিযোগ শুনে সমস্যা সমাধানে কর্মসূচি মন্ত্রীর
এই সংহত, সত্য বার্তাকেই বিস্তারিত ব্যাখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবাসীর কাছে স্পষ্ট করেছেন, “ভগিনী নিবেদিতা আমাদিগকে যে জীবন দিয়া গিয়াছেন তাহা অতি মহৎ-জীবন; তাঁহার দিক হইতে তিনি কিছুমাত্র ফাঁকি দেন নাই— প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তেই আপনার যাহা সকলের শ্রেষ্ঠ, আপনার যাহা মহত্তম, তাহাই তিনি দান করিয়াছেন, সেজন্য মানুষ যতপ্রকার কৃচ্ছ্রসাধন করিতে পারে, সমস্তই তিনি স্বীকার করিয়াছেন।”
তিনি নিজেকে ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নিবেদিতা’ হিসেবে উল্লেখ করতে ভালবাসতেন। এই আন্তরিক আত্মনিবেদনের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলি, তাঁর এই আত্মপরিচয়ের মধ্যে এক সীমাবদ্ধতা আছে। এবং অদ্যাবধি নিবেদিতাচর্চা অনেকটাই এই সীমাবদ্ধতায় আক্রান্ত। নিবেদিতার বিরল প্রতিভার বিবিধ মুখ নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে তাঁর স্বাধীন চেতনা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, বিশেষত মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল হিসেবে তাঁর প্রথম জীবনের প্রেক্ষাপটকে প্রায়শই যোগ্য গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
আরও পড়ুন-দুই চ্যানেলে নতুন দুই ধারাবাহিক
নিবেদিতা যখন এদেশে এলেন তখন ভারতবর্ষের, বিশেষত বাংলার এক অত্যন্ত ঊর্বর, সবীজ সময়। ব্রিটিশ সরকারের নানাবিধ অবদমন সত্ত্বেও শিক্ষিত ভারতবাসী তখন ক্রমোন্নতির এক-এক শিখর স্পর্শ করছে। বিজ্ঞান-সাহিত্য-শিল্প-রাজনীতি-ধর্মচেতনা সব দিকেই তখন আন্তর্জাতিক মানের ভারতীয় প্রতিভা— কেউ তখন প্রস্ফুটিত, কেউ কেউ আবার অঙ্কুরোদ্গমের পথে। তাঁরা তাঁদের একাগ্র যাত্রাপথে আচম্বিতে সঙ্গী হিসেবে পেলেন এক ভরসাযোগ্য ভগিনীকে— ভগিনী নিবেদিতা।
এই প্রসঙ্গে ভারতের নবজাগরণ সম্পর্কে বহু আলোচিত অভিযোগটির কথা উল্লেখ করে নেওয়া যায়। সমাজের সর্বস্তরকে– আরও নির্দিষ্টভাবে বললে দরিদ্র, অশিক্ষিত পেছিয়ে পড়া শ্রেণিকে, জাতীয় জাগরণে শামিল না করা নিয়ে এই ন্যায্য অভিযোগ। যা-কিছু সক্রিয়তা, সচেতনতা, তর্ক-বিতর্ক সব শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত মহলে সীমাবদ্ধ। এই ত্রুটির উল্লেখ করে আমাদের নবজাগরণকে ইউরোপীয় রেনেসাঁ থেকে খানিকটা পিছিয়ে রাখা হয়। কিন্তু আধুনিক ভারতবর্ষে নিবেদিতার অবদান কখনওই এই সীমাবদ্ধতায় আবিল নয়। তিনি তাঁর সব কাজেই সমাজের সকল স্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়েছেন, পাশে পেয়েছেন।
আরও পড়ুন-কমলাদেবী মহিয়সী এক নারী
নিবেদিতা ভারতীয় সমাজ-সাহিত্যের গভীরে পৌঁছতে চেয়েছেন। প্রবেশ করেছেন ভারতের মহাকাব্য, পুরাণ, লোকগাথা এবং সর্বোপরি বেদ-এ। তাঁর গুরুদেবের পরামর্শ ছিল, “Before flooding India with socialistic or political ideas, first deluge the land with spiritual ideas.” নিবেদিতা তাই এই সব কাহিনিতে বুঁদ হয়ে যান। স্বামীজি ও তাঁর গুরুভাইদের কাছ থেকে, সারদা মায়ের সহচর যোগীন মা-র কাছ থেকে তিনি গল্প সংগ্রহ করেন। সেগুলি বিশ্লেষণ করে পাশ্চাত্য মূল্যবোধের পাশে দাঁড় করান। বৃন্দাবনের গোপাল আর কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণ একই ব্যক্তি কিনা, তিনি প্রশ্ন তোলেন। তাঁর গুরুদেবের মতো তাঁরও মনে হয় সতী, সাবিত্রী, সীতা, দময়ন্তীর কথা আধুনিক ভারতের সামনে তুলে ধরতে হবে। তুলে ধরতে হবে গোটা পৃথিবীর সামনে। তিনি বিশ্বাস করেন, যে জাতি সীতা চরিত্র সৃষ্টি করেছে, নারীর প্রতি সে জাতির যেরূপ শ্রদ্ধা, জগতে তার তুলনা নেই।
আরও পড়ুন-স্বনির্ভর বাংলা
শুধু নিজের ভাষায় গল্প পরিবেশন নয়, তার সঙ্গে নিজের এই ভাবনা ও বিশ্বাসকে মিশিয়েই তাঁর সাড়া জাগানো গ্রন্থ Cradle Tales of Hinduism। এই শেকড় খোঁজার আকুতিতেই তাঁর আর এক বিখ্যাত বই The Web of Indian Life। এখানে কোনও মতামত বা বিচার করার প্রবৃত্তি নেই। ভারতীয় জনজীবনের কাছাকাছি থেকে নিবেদিতা তার বর্ণনা দিয়েছেন স্বাদু গদ্যে। তিনি মনে করতেন তাঁর এই পর্যায়ের বইগুলির উদ্দীষ্ট পাঠক দুই মেরুর। প্রথমত তিনি মিশনারিদের অন্তঃপুরের অপপ্রচার রুখে দিয়ে ভারত সম্পর্কে পাশ্চাত্যের ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে চান। এবং দ্বিতীয়ত সমকালীন ভারতবাসীকে তাঁদের নিজের দেশ সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল করে তোলেন।
আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামের পর আবার বিদ্রোহ, এবার রাজ্যস্তরে সিবিআই থেকে বাঁচতে দলবদলুদের সিন্ডিকেটের হাতে বিজেপি
সত্যিই, সর্বার্থে নিজের জীবন দিয়ে নিবেদিতা আধুনিক ভারতবর্ষের নানা স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর বহুমুখী প্রতিভার বর্ণালি। সার্থক করে গেছেন তাঁর আচার্যের আশীর্বাণী : “অতীতের কল্পনায় ভাসে নাই যারা / অনাগত ভারতের যে-মহামানব, / সেবিকা, বান্ধবী, মাতা— তুমি তার সব।।”