মহুয়া মল্লিক: পরি মুখভার করে ভাতের থালা থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। ওর মা সনকা উনুন পরিষ্কার করতে করতে সেদিকে একবার তাকিয়ে নিল। তারপর হাতের কাজ না থামিয়েই বলল, “কীরে পরি, খাচ্ছিস না যে? একটু আগেই যে বললি খিদে লেগেছে?”
পরী উত্তর দেয় না। মুখ গোঁজ করে বসে থাকে। একথালা মোটা চালের ভাতের পাশে একটু সজনেপাতা ভাজা আর একটুখানি আলুসেদ্ধ। এই দিয়ে খেতে ইচ্ছা করে বুঝি? বিশেষ করে আজ আকাশটা কেমন আইসক্রিমের মতো, রোদ্দুরটাও নরমসরম। আর সেইসঙ্গে ভেসে আসা মাইকের গান— সবকিছু ঝলমলে করে দিয়েছে। আজকের দিনেও এইরকম খেতে হবে? সজনেপাতাটাও তেলে ভাজা না, জল দিয়ে সিদ্ধ করে তারপর অল্প তেলে নেড়েচেড়ে দিয়েছে মা। আলুসেদ্ধতেও শুধু নুন। ভাতের থালা ঠেলে উঠে যেতে ইচ্ছা করে পরির। কিন্তু সে মাকে তো চেনে, রেগে গেলে মায়ের চিকন-শ্যামলা মুখে গনগন করে যেন আগুন জ্বলে ওঠে। ভয়ে ভয়ে পরি ভাত ভেঙে খেতে শুরু করল।
আরও পড়ুন-তিন জেলার তিন পত্রিকা
সনকা আড়চোখে দেখছিল মেয়েকে। আজ পঞ্চমী, মায়ের পুজো শুরু। বাচ্চা মেয়ে, ওর তো দুটো ভালমন্দ খেতে ইচ্ছা হতেই পারে। কিন্তু সনকারই বা সাধ কোথায়? এই এক বছর ধরে সংসারটা যে কীভাবে সে টানছে, সে-ই জানে। পরির বাবা অসময়ে চলে গিয়ে তাকে শুধু নিঃস্ব করে গেছে তা-ই নয়, অকুল পাথারে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে। সনকা চোখের কোণে আসা জলটা তর্জনীর ডগায় মুছে নিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
পরির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে সনকার দুচোখ লেগে গিয়েছিল। পরি জিজ্ঞাসা করছে, “পরির মা তো পরিই হয় তাই না মা?” ঘুম জড়ানো গলায় সনকা উত্তর দেয়, “তা কেন? পরির মা তো সনকা।”
“ধ্যাত তুমি কিছু জান না মা। আমাদের অজন্তা মিস তো বলেছেন, পরির মা পরিই হয়। গত সপ্তাহে যেদিন খুব বৃষ্টি হল, আমাদের ইস্কুলে ডিম-মেশানো খিচুড়ি খাওয়াল, সেদিন টিফিনের পর আমরা কেউ পড়তে চাইনি। অজন্তা মিস তখন পরির গল্প বললেন। তখনই তো বললেন পরির মা-ও পরি।”
আরও পড়ুন-সূর্যষষ্ঠীব্রত ছট
হাই তুলতে তুলতে সনকা জিজ্ঞাসা করে, “তুই কোন পরির কথা বলছিস মা?”
“গল্পের বইয়ের পরির কথা বলছি গো মা। যারা চাঁদের দেশে থাকে। রাতের বেলায় জ্যোৎস্নায় ডানা মেলে আমাদের কাছে নেমে আসে।”
“অ তাই বল।” মাঝরাতে পরির বকবকানিতে বিরক্ত হয়ে ওঠে সনকা। কিন্তু বাপমরা মেয়েটাকে কিছু বলতেও ইচ্ছা করে না। কাল সকাল সকাল উঠে ঘরের কাজ সেরে সামন্তদের বাড়ি ছুটতে হবে। নাড়ু, নিমকি বানিয়ে দিয়ে আসতে হবে। গামলা-গামলা নিমকি ভাজতে হবে, একা সে পেরে উঠবে না বলে আরেকজন থাকবে তার সঙ্গে। দুপুরের খাওয়াটা ওখানেই জুটে যাবে। বড়লোকের বাড়ি, খাবারদাবার ভালই থাকবে। সনকা ঠিক করেছে, সে না খেয়ে খাবারটা বাড়ি নিয়ে চলে আসবে। একটু ভালমন্দ পরির মুখে তুলে দিতে পারবে। মেয়েকে বুকের কাছে লেপ্টে নিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করে।
আরও পড়ুন-তদন্ত শেষ হবে কবে, প্রশ্ন আদালতের
পরি আবার কলকল করে ওঠে, “বিন্তি না অজন্তা মিসকে জিজ্ঞাসা করেছিল পরির মা কি পরি? মিস বললেন হ্যাঁ পরির মা পরি। আর এ-ও বললেন পরিদের অনেক ক্ষমতা, চাইলেই মানুষের ভাল করতে পারে। তখন ক্লাসের সবাই আমাকে দেখে হাসতে থাকে। আর বলে, পরি তো নিজের ভালই করতে পারে না। অঙ্কে গোল্লা পায়, ও আবার সবার ভাল কীভাবে করবে?”
সনকার ঘুম চলে গেছে। উত্তেজনায় উঠে বসে সে। “তোর বন্ধুগুলো তো আচ্ছা বদমাশ! এইসব বলে? দাঁড়া ইস্কুল খুলুক। হেডদিদিমণিকে নালিশ করব।”
“মা শোনই না আগে। মিস ওদের বকে দিয়েছেন। বলেছেন পরির মাথা খুব সাফ। সেবার ওর বাবা চলে গেলেন তাই রেজাল্ট খারাপ করেছিল। এবার অঙ্কে আর গোল্লা পাবে না। মিস আরও বললেন, পরি তো এখন খুব ছোট। যখন বড় হবে, তখন মানুষের মঙ্গল করার ক্ষমতাটা ওর মধ্যে আসবে।”
আরও পড়ুন-বাংলাদেশে ৭০০ নতুন পুজো হয়েছে: মন্ত্রী
তারপরই মায়ের গলা জড়িয়ে ফিসফিস করে বলে, “মা তুমি তো বড় পরি। তুমি তো চাইলেই সব ভাল করতে পার তাই না?”
সনকা শিউরে ওঠে মেয়ের কথায়। অন্ধকারেও বুঝতে পারে দুচোখে প্রত্যাশা নিয়ে দশ বছরের মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। কীই বা ক্ষমতা সনকার? সামান্য একজন মানুষ সে, ব্যাটাছেলেরা বলে মেয়েমানুষ।
“জানিস আমি পরি, রেতের বেলায় আমার ফিনফিনে ডানা দুটি মেলে জ্যোৎস্নায় উড়ে বেড়াই। কখনও আবার চাঁদের দেশে উড়ে যাই। চাঁদের বুড়ি একমনে চরকায় সুতো কাটে। আমায় দেখে দুখানি পাথরের গেলাস ভরে গোলাপ পাপড়ি ছড়ানো ঠান্ডা শরবত নিয়ে আসে। শরবত খেতে খেতে চাঁদের বুড়ি আমার সঙ্গে কত গল্প করে।”
একপাল কচিকাঁচা এ কথা শুনে হিহি করে হেসে ওঠে— “এ পাগলি তোর ডানা কই? দেখা দেখি তোর ডানা দুটো।”
আরও পড়ুন-সোশ্যাল মিডিয়া এখন জঙ্গিদের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, উদ্বেগ জয়শঙ্করের
একদলা থুতু ছিটিয়ে সনকা বলে ওঠে, “ডানা দেখবি, এই দ্যাখ পিঠের মধ্যে ভাঁজ করা আছে। দ্যাখ না দ্যখা।” ছেলের দল হাসতেই থাকে। নদীর ঘাটে একদল বউ এসেছে। সনকাকে দেখতে দেখতে তাদের দীর্ঘশ্বাস পড়ে, “বরটা যেতে তবু সামলে ছিল, মেয়েটা গেল বছর চলে যেতে সনকাটা একেবারে পাগল হয়ে গেল।”
প্রকাণ্ড বট গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে তখন শতছিন্ন কাপড় পরা সনকা এঁকে বেঁকে নিজের পিঠটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে ডানাজোড়া খুঁজছিল।
মাথার যন্ত্রণাটা যখন থাকে না, সনকা ভাবে, মেয়েটা কেন চেয়েছিল সনকাও পরি হয়ে যাক? পরির অসীম ক্ষমতা বলে! সে কি চাইত মা তার বাবাকে ফিরিয়ে আনুক? সে কি চাইত পাতের পাশে একটু মাছ? ঘরের মধ্যে খুশির আলো? সে কি বিশ্বাস করত, তার মা পরি হলেই চারদিকে ভাল ভাল ঘটনা ঘটবে?
আরও পড়ুন-এবার রাজ্যে দুয়ারে কোভিড টিকাকরণ!
সনকা আজ বেশ ভাল আছে। স্নান করে, পাটভাঙা একটা শাড়ি পরেছে। চুলে তেল দিয়ে জট ছাড়িয়ে খোঁপা করেছে। সে জানে একটু একটু করে সে পরি হয়ে উঠেছে। এখন চাইলেই সে অনেক কিছু করতে পারে। ঘাটের সেই সিঁড়িটায় সে এসে বসে। এখানেই তো সেদিন পরি মাছ ধরতে নেমেছিল। হঠাৎ আসা জোয়ারের জলে অজস্র মাছ দেখে বড়দের সঙ্গে সে-ও এক-পা এক-পা করে নেমে পড়েছিল। সিঁড়ির এই জায়গাটা থেকেই পরিকে টেনে নিয়েছিল জল। আজ সনকা শুধু পরির মা নয়, পরি হয়ে উঠেছে। আজ কি জলের সঙ্গে লড়াই করে মেয়েকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাটুকু করবে না? সনকা আরও নিচে নেমে যায়। কালো জল তার পায়ের পাতা ছোঁয়। আরও নেমে যায়, পা ডুবে যায়, তারপর জঙ্ঘা, তারপর কোমর। জলে হাতড়াতে থাকে পাগলিনী মা, আজ সে পরিকে বুকে জড়িয়ে বাড়ি ফিরবেই।
আরও পড়ুন-শীতের কাঁপুনি, সাহায্যের আর্তি কিয়েভের মেয়রের
মেয়েটা সনকার বুকের মাঝে থরথর করে কাঁপছে। একটু আগের বিভীষিকা সে ভুলতে পারছে না। একটা মানুষরূপী হায়না তাকে ভুলিয়েভালিয়ে এই নদীর পাড়ে নিয়ে এসেছিল। বাঁধানো সিঁড়িতে শুইয়ে তাকে ছিঁড়ে খেতে শুরু করার মুহূর্তে সনকা জল থেকে উঠে এসে আসুরিক শক্তিতে লাফিয়ে পড়েছিল। চুলের মুঠি ধরে লোকটার মাথা বাঁধানো সিঁড়িতে ঠুকতে শুরু করেছিল যতক্ষণ না লোকটা বেহুঁশ হয়ে যায়।
মেয়েটার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে সনকা বলে, “আমি পরি, তুইও আজ থেকে আমার পরি। ভয় কী মা? আজ থেকে তোকেও পরি হওয়ার মন্ত্র শিখিয়ে দেব। দেখবি কেউ তোর আর ক্ষতি করতে পারবে না। বরং তুই সবার ভাল করবি।”
মেয়েটা কী বুঝল জানে না, তবে তার মা’টা মরে যাবার পরে সে বড্ড একা হয়ে গেছে। আগে মায়ের সঙ্গে ট্রেনে ভিক্ষা করে তবু দিন কেটে যেত। মা মরে যেতে ট্রেনে চেপে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে এখানে চলে এসেছিল দু’দিন আগে। নতুন একটা মা পেয়ে তার ভালই হল। সনকাকে সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
আরও পড়ুন-পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতি, দুই নতুন অঞ্চল সভাপতি
“ও সনকা, এ কাকে নিয়ে এলি রে কাঁখে করে?”
মানদা বুড়ির শকুনের নজর, ঠিক দেখে ফেলেছে। সনকা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক, সাবধানী গলায় উত্তর দিল, “ও তো আরেক পরি, আমার বোনের মেয়ে। এখন থেকে আমার কাছেই থাকবে।”
অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল সনকার। তার নতুন পরি অঘোরে ঘুমচ্ছে। মেয়েটা তার পরির থেকে একটু ছোটই হবে। লন্ঠনের আলোটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েটার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল সনকা। নরম মায়ার জড়ানো মুখ। ঠিক যেন ছবিতে দেখা পরির মতো!
আলোটা কমিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে সনকা। চুপচাপ দাওয়ায় বসে থাকে। কতক্ষণ এভাবে বসেছিল জানে না, সজনে গাছের ডালে ঝটাপটির আওয়াজে চোখ তুলে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল সনকা। তার পরি ছোট ছোট দুটি ডানা মেলে তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। সনকা এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায়। নিজের ডানা দুটি মেলতে চায়, তারা মায়ে-মেয়েতে আজ আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়াবে।
ঘরের ভিতর থেকে ক্ষীণ স্বরে ভেসে আসে, “মা…” সনকা ঘুরে দাঁড়ায়। এখন তার ডানা মেলে ওড়ার সময় কই? তার নতুন পরি যে ডাকে। ভিতরে ঢুকতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায় সনকা, সজনে গাছের ডাল ছেড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে তার পরি। যেতে যেতে হাসি হাসি মুখে হাত নাড়ছে। সনকা আর দাঁড়ায় না, পরিরা এক জায়গায় আটকে গেলে সবার ভাল কীভাবে করবে!