প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল যে, ক্ষুধা ও অপুষ্টিকে (Hunger and malnutrition-India) একের থেকে অন্যকে আলাদা করা যায় না। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের পিছিয়ে পড়ার সাম্প্রতিক রিপোর্ট নিয়ে নানা আলাপ-আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে। এরই পাশাপাশি দারিদ্র বৃদ্ধি এবং শিশু অপুষ্টির রিপোর্টও যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ক্ষুধা সূচক অনুযায়ী ভারত পরপর তিনবছর ৯৪ থেকে ১০১, তারপর ১০৭-এ নেমে এসেছে। নেপাল, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের চেয়েও ভারত পিছনে। সম্প্রতি প্রকাশিত দুই পরিসংখ্যান একথাই বলছে যে, এদেশে বহুমাত্রিক দারিদ্র কমেছে, কিন্তু পরিপার্শ্বের তুলনায় ক্ষুধা ও অপুষ্টির দাপট কমেনি, বরং বেড়েছে। শিশু-অপুষ্টির সমস্যা ভারতে ব্যাপকভাবে আছে এবং তা বেশ গভীর সমস্যার কারণ। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকাশিত রিপোর্ট থেকেই তা স্পষ্ট হয়।
এ-বিষয়ে আলোকপাত করতে গেলে দু’একটি বিষয় আমাদের জেনে নেওয়া দরকার। যেমন, রাষ্ট্রপুঞ্জের সহস্রাব্দের লক্ষ্য অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবী ক্ষুধাহীন হবে। সেই লক্ষ্য অনুযায়ী বিশ্ব কতটা এগলো তার পরিমাপ করতে ২০০০ সাল থেকে প্রায় প্রতি বছরই ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’ প্রকাশ করছে আয়ারল্যান্ড ও জামার্নির দুই অসরকারি সংস্থা। এই সূচক নির্ণয় করতে যে চারটি মাপকাঠি ব্যবহার করা হয়, সেগুলি হল— জনসংখ্যার কত শতাংশ প্রয়োজনের তুলনায় কম পুষ্টি পাচ্ছে, যার অর্থ, প্রয়োজনের তুলনায় কত কম ক্যালরি গ্রহণ করছে। দ্বিতীয় মাপকাঠি হল, পাঁচ বছর বা তার কম বয়সি শিশুদের মধ্যে কত শতাংশের ওজন নির্দিষ্ট উচ্চতার তুলনায় কম, তৃতীয়টি হল— পাঁচ বছর বয়সি বা তার কম বয়সি শিশুদের মধ্যে কত শতাংশের উচ্চতা নির্দিষ্ট বয়সের তুলনায় কম, আর চার নম্বরটি হল শিশুমৃত্যুর হার।
নির্দিষ্ট উচ্চতার তুলনায় ওজন কম হলে তাকে ওয়েস্টিং বলে। আর নির্দিষ্ট বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম হলে তাকে স্টান্টিং বলে। এক্ষেত্রে পাঁচ বছর বা তার কম বয়সিদেরই ধরা হয়।
আরও পড়ুন-বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসের উঁচাই
সাম্প্রতিক সরকারি (এনএফএইচএস ২০২০-’২১) রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতীয় শিশুদের ৩৫.৫ শতাংশ স্টান্টেড (বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম) আর ১৯.৩ শতাংশ ওয়েস্টেড (উচ্চতার তুলনায় ওজন কম)। উল্লেখ্য যে, শতাংশের হিসেবে এত বেশি ওয়েস্টেড শিশু বিশ্বের আর কোনও দেশে নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ওয়েস্টেড শিশুর অনুপাত ১৫ শতাংশের বেশি হলেই তা ‘অ্যালার্মিং’। দেখা যাবে যে, গরিব পরিবারেই এই দুই সমস্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশি। অর্থনৈতিক শ্রেণি বিভাগ অনুযায়ী এই বৈষম্য বিশ্বের কম দেশেই দেখা যায়।
শিশু অপুষ্টির কথা মাথায় রেখেই ১৯৭৫ সালে ‘ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভলপমেন্ট স্কিম’ বা আইসিডিএস প্রকল্পটি আনে ভারত সরকার। সবচেয়ে পুরনো এই প্রকল্প। ০-৬ বছরের শিশুদের মধ্যাহ্নভোজনে একটি সুষম আহার জোগানোই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। দেশের প্রায় ২৪ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে এই খাবার দেওয়া হয় শিশু, গর্ভবতী আর স্তন্যদায়ী মায়েদের। কেন্দ্র ও রাজ্য মিলে এর খরচ বহন করে। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে কেন্দ্র খরচ করে ৯০ শতাংশ এবং রাজ্যগুলি খরচ করে ১০ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গ-সহ বেশ কিছু রাজ্যে এই হিসেব হল ৫০ : ৫০। বাজেটের তথ্য বলছে, ২০১৯-’২০ সালে এই বরাদ্দ ১৯১৪-’১৫-র বরাদ্দের প্রায় সমান সমান থেকে গিয়েছে। জনসংখ্যা ও মূল্যবৃদ্ধির হিসেব ধরলে আসলে বরাদ্দ কমেছে। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসেই এই বরাদ্দ প্রায় অর্ধেক করে দেন। এইভাবে বরাদ্দ কমানোর ফলে কোপ পড়েছে শিশুদের খাবারে। ডিম দেওয়া প্রায় উঠে গিয়েছে। শিশুদের সুষম খাবার দেওয়ার ব্যবস্থাটি ভয়ানকভাবে দুর্বল হয়ে গিয়েছে।
‘মিড ডে মিল’ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও অবস্থাটি দুর্বল (Hunger and malnutrition-India) থেকে দুর্বলতর হয়েছে। একে বরাদ্দ কম, তারপরেও বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ হয় না। ‘পোষণ’ অভিযানের নামে ২০২১ সালে বরাদ্দ হল ৩৭০০ কোটি টাকা। আসলে খরচ করা হয়েছিল সাঁইত্রিশ শতাংশ মাত্র। এরপর ২০২১ সালে এল ‘প্রধানমন্ত্রী পোষণ অভিযান’। এই ছাতার তলায় আনা হল ‘মিড ডে মিল’ প্রকল্পকে। শুনতে যতই ভাল লাগুক অবস্থা বদলাচ্ছে না।
সরকার এ-কথা বেশ ভালভাবেই জানে যে, ভারতে শিশুদের অপুষ্টির হার যথেষ্ট বেশি। সরকারি তথ্য থেকেও আমরা তা জানতে পারি। সরকারি সহায়তা ছাড়া গরিব পরিবারগুলির পক্ষে সুষম আহার জুগিয়ে শিশুপুষ্টির সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সরকার সেটাও জানে। দায় গ্রহণের অঙ্গিকার করলেও, দায় পালনের সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। অতিমারির কারণে সাধারণ মানুষের আয় কমে যাওয়ার পরেও।
দারিদ্র বাড়ছে। সরকার হিসেব না দিলেও সরকারি ফাঁক-ফোকর থেকে নানা তথ্য বেরিয়ে পড়েছে। সেই হিসেবেও ২২-২৩ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছেন। প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। এই সীমার আশেপাশেও রয়েছেন বহু মানুষ। তাই দারিদ্র-ক্ষুধা-অপুষ্টি— এদেশের (Hunger and malnutrition-India) মৌলিক সমস্যা হয়ে রয়ে গিয়েছে।
ক্ষুধা সূচকে পিছিয়ে পড়ার খবরে শাসকরা লজ্জিত নন। লজ্জাবোধ তাঁদের ধাতেই নেই। কেন্দ্রীয় সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়েছে যে, তারা এই রিপোর্টের ফলাফলকে স্বীকার করছে না। যে-প্রক্রিয়ায় এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়, তার সঙ্গে সরকার একমত হতে পারছে না। প্রতিবছরই সরকারের এহেন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। এটা নাকি ভারতকে কালিমালিপ্ত করার চক্রান্ত! এর উত্তর পাওয়া সত্ত্বেও সরকারের পক্ষে একই যুক্তি বহাল আছে। শিশু অপুষ্টি ও গ্রামীণ দারিদ্র ভয়ঙ্কর আকার নিচ্ছে। একে অস্বীকার করার অর্থ হল— নিজেরাই নিজেদের পতন ডেকে আনা। আজকের সরকার সেই পথেই চলছে।