গত ২৮ জুন, ২০২২, কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক দ্বারা বন সুরক্ষা আইন ১৯৮০-র নতুন বিধি বা নিয়মাবলি প্রকাশ করার পর অরণ্য ও অরণ্যবাসীর পারস্পরিক পবিত্র ও নিষ্পাপ সম্পর্কের মধ্যে যে যন্ত্রণাময় দূরত্ব তৈরি হয়েছে, যেভাবে আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাঁদের রুজি রোজগার থেকে শুরু করে তাঁদের আচার, সংস্কৃতি, বিশ্বাসের ওপর নির্মম কুঠারাঘাত করা হয়েছে তারপর সাম্প্রতিক সময়কালে ভারতবর্ষের আদিবাসীদের প্রতি বিজেপির কুম্ভীরাশ্রু সত্যিই হাসির খোরাক ছাড়া আর কিছু ভাবতে বাধ্য করে না।
আরও পড়ুন-ফাইভ জি চালু করতে তৈরি রাজ্য
যে বিজেপি সরকার আদিবাসীদের শত শত বছরের অধিকার হরণ করে তাঁদের নিত্যজীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে এক স্বৈরাচারী কালা আইন বলবৎ করে, তারাই এখন ঘোলা জলে মাছ ধরতে মেকি আদিবাসীপ্রেমী সাজতে চাইছে। লজ্জা লাগে এদের উলঙ্গ দ্বিচারিতার নিদর্শনে, মুখ আর মুখোশের পার্থক্যে এরা সহজ সরল আদিবাসীদের বোকা বানাতে নিজেদের গায়ের চামড়া গন্ডারের ন্যায় করে নিয়েছে যাতে নির্লজ্জভাবে নিজের বিবেককে দাসত্বে বন্দি করা যায়। যে শাসক দলের সরকারের কর্পোরেট বেসড ‘উন্নয়নের’ বদান্যতায় অরণ্যবাসী আদিবাসীরা আজ নিজেদের অধিকার হারিয়ে ওড়িশা থেকে শুরু করে তেলেঙ্গানা, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ সহ সারা ভারতবর্ষ জুড়ে ভিটেমাটি ছাড়া হওয়ার সম্মুখীন, রুজি রোজগার হারিয়ে বেঘোরে মরার পথে, সেই শাসক দল বিজেপিই নাকি সম্মান রক্ষা করবে অরণ্যবাসী আদিবাসীদের!! ওড়িশার মাটিতে বেদান্তর মতো কর্পোরেট সংস্থার হাতে সেখানকার আদিবাসীদের নিজস্ব সম্পদ তুলে দেওয়ার পর ড্যামেজ কন্ট্রোল রাষ্ট্রপতি হিসেবে দ্রৌপদী মুর্মুর দিল্লি পৌঁছনোর প্রক্রিয়াটা কিন্তু এই আদিবাসীদের, অরণ্যবাসীদের সর্বস্ব হারানো রক্তভেজা পিচ্ছিল পথের অবদান ছিল, অবদান ছিল আদিবাসীদের চিরতরে অরণ্যের ওপর, নিজেদের বাসভূমির ওপর অধিকার হারানোর নির্মমতার, শাসকদল বিজেপির আদিবাসীপ্রেমের কোনও বাস্তবতা বা গল্প নয়।
আরও পড়ুন-বাঁশবেড়িয়ায় প্রস্তুতি তুঙ্গে
আজ আদিবাসী গ্রামসভা তার চিরাচরিত অরণ্যের অধিকার হারিয়েছে, ধামসা মাদলের সংস্কৃতিকে পিষে মারার অধিকার পেয়েছে পে লোডার, বুলডোজার, জেসিবি, অটোমেটিক করাতের উল্লাস। বেলাগাম অরণ্যভূমি ধ্বংসের মাধ্যমে অরণ্যবাসী আদিবাসীদের প্রাপ্য হক প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে তাঁদের বঞ্চিত করে কংক্রিটের ‘উন্নয়ন’-এর একতরফা লাইসেন্স কর্পোরেটদের হাতে নামমাত্র মূল্যে তুলে দেওয়া আসলে যে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের আদিবাসী বিরোধী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ তা আজ জলের মতো পরিষ্কার। তাঁদের চিরকালের আরণ্যক পাহাড়ি বাসভূমিতে, তাঁদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় মাতৃভূমিতে পরবাসী পরজীবী করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে তাঁদের কোমর ভেঙে দিয়েছে তা ভারতের আদিবাসী সমাজ ভালমতো বুঝতে পেরেছিল বলেই তাঁরা সমস্বরে সারা ভারত জুড়ে আওয়াজ তুলেছিলেন “শাসকের লোলুপ হানাদারি আমাদের একান্ত আপন ঝরনা, পানি, পবন, পাতা সবকিছু ধ্বংস করে দেবে। এই কালা কানুন আমাদের বীরসা মুণ্ডা, রিন্ডো মাঝির মতো মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করবে।” না, কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা শোনেনি। পরাক্রমশালী শাসক যখন শোষকের ভূমিকা নেয় তখন অসহায় প্রজার পক্ষে বিচারের বাণীও নীরবে নিভৃতে কাঁদে, আদিবাসীদের আর্তনাদও সেভাবেই অরণ্যে রোদন হয়ে চাপা পড়ে গিয়েছে, সবকিছু কেড়ে নিয়ে তাঁদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রপতি ভবনের দরজার চাবি, যা দিয়ে ভারতবর্ষের আদিবাসীদের ভগ্নাংশ উন্নতির আশা করাও অন্যায় ও অযৌক্তিক।
আরও পড়ুন-থিমের চমকে তৈরি কাটোয়া
তাই এই বিজেপির মুখে যখন আদিবাসীদের অধিকার ও সম্মান রক্ষার কথা শুনতে পাওয়া যায় তখন সত্যিই অবাক হতে হয়। যাদের রচিত কালা আইনের কালা জাদুতে আজ সমগ্র আদিবাসী সমাজ বিপর্যস্ত, ত্রস্ত, আতঙ্কিত, সেই বিজেপি নাকি রক্ষা করবে আদিবাসীদের সম্মান,অধিকার!! ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে রাষ্ট্রপতি ভবনের ললিপপ হাতে ধরিয়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া সমাজের মানুষদের যে বারবার বোকা বানানো যায় না এটা বিজেপির নেতৃত্ব খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন, সময় হয়ে এসেছে, আর তো মাত্র ষোলো-সতেরো মাসের ব্যবধান। আদিবাসীদের ওপর অন্যায় অবিচারের বদলা নেওয়ার পালা শেষে এক আদিবাসীর মাধ্যমেই ভারতবর্ষের বুকে নতুন ভোরের সূর্যোদয় হবে দিল্লির বুকে। অপেক্ষা এখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের।