দোস্তজী (Dostojee)
একটি নির্ভেজাল বাংলা ছবি ‘দোস্তজী’ (Dostojee)। যেটা নিয়ে ট্যুইট করেছিলেন খোদ অমিতাভ বচ্চন। ছবিটি রাতের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছে টলিউড সুপারস্টার প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের। ইতিমধ্যেই পৃথিবীর ২৬টি দেশ ঘুরে, জিতে নিয়েছে ৮টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। তৈরি হয়েছে ব্যাপক উন্মাদনা।
প্রসূন চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত প্রথম ছবি। ১১ নভেম্বর মুক্তি পেয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে। পেয়েছে মোট ২৩টি শো। তার মধ্যে ১৩ নভেম্বর হাউসফুল ছিল ১৮টি। ১৪ নভেম্বর ৭টি এবং ১৫ নভেম্বর ৮টি, ১৬ নভেম্বর ৫টি হলে। সাধারণ দর্শকদের পাশাপাশি প্রশংসায় পঞ্চমুখ বিশিষ্টরাও।
অথচ ছবিটিতে নেই কোনও নক্ষত্র সমাবেশ। দুটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছে মুর্শিদাবাদের দুই খুদে স্কুল পড়ুয়া আসিফ শেখ এবং আরিফ শেখ। ছবিতে তারা পলাশ এবং সফিকুল। একজন হিন্দু, অন্যজন মুসলমান।
কথায় বলে, বন্ধুত্বের জায়গা সবার উপরে। তাই ভিন্নধর্মী দুই বালক হতে পেরেছে একে অপরের দোস্তজী। এদের ঘিরেই দানা বেঁধেছে ছবির কাহিনি।
মুর্শিদাবাদের সীমান্তবর্তী এক গ্রাম। সেখানেই তাদের পাশাপাশি ঘর। দুজন একসঙ্গে স্কুল যায়, পড়তে বসে। দেওয়া-নেওয়া হয় পুজোর প্রসাদ, ইদের সিমুই। অদ্ভুত এক সারল্য মিশে রয়েছে প্রতিদিনের যাপনে। মনের সুখে মাঠেঘাটে খেলে বেড়ায় তারা। দুষ্টুমি করে, বৃষ্টি ভেজে।
পরিবারে আছে অর্থকষ্ট। তাদের কিছু যায় আসে না তাতে। প্রাচুর্যের সরণি বেয়ে নয়, ছোট ছোট প্রাপ্তির মধ্যে দিয়েই তারা খুঁজে নেয় নির্ভেজাল আনন্দ। উপাদান হিসেবে পেয়ে যায় লাটাই ভর্তি সুতো, নীল ঘুড়ি, ফুটবল, কটকটি। চলার পথে ঘটে আলোকালো বাঁকবদল। কখনও তারা কাঁদে, কখনও হাসে। প্রতিটি মুহূর্ত দুজন এইভাবেই উদযাপন করতে ভালবাসে।
১৯৯২ সালের ডিসেম্বর। দেশে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ঘটে যায়। পরের বছর মুম্বই বোমা বিস্ফোরণ। এই দুই ঘটনা পতন ঘটায় স্বাভাবিক ছন্দে। ভিন রাজ্যে থেকে ভেসে আসা বিষাক্ত হাওয়া ছড়িয়ে পড়ে তাদের চিরসবুজ গ্রামে। চিড় ধরে দুই সম্প্রদায়ের সুসম্পর্কে। দানা বাঁধে সন্দেহ, ভয়। দুই বালকের চোখের সামনে অদ্ভুতভাবে বদলে যায় চারপাশটা। বিচলিত হয়ে ওঠে শিশুমন। বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে তারা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যায়।
সবমিলিয়ে ‘দোস্তজী’ (Dostojee) শৈশব, বন্ধুত্ব এবং বন্ধু হারিয়ে ফেলার গল্প।
সীমিত বাজেটে ছবি নির্মাণে সৎ থেকেছেন পরিচালক। মেধা ও মনন দিয়ে দেখভাল করেছেন প্রতিটি বিভাগ। অনর্থক জ্ঞান বিতরণের পথে পা বাড়াননি। মহৎ মহাকাব্য নয়, পর্দা জুড়ে তিনি রচনা করেছেন নিষ্পাপ বন্ধুত্বের আটপৌরে পাঁচালি। তাই তো এই ছবি হতে পেরেছে এতটা মর্মস্পর্শী, পেয়েছে অবিশ্বাস্য সাফল্য। সবমিলিয়ে ‘দোস্তজী’ (Dostojee) তো বটেই, ছবির পরিচালকও যে লম্বা রেসের ঘোড়া, হলফ করে বলাই যায়।
আরও পড়ুন-মেঘালয়ে অভিষেকের ঘোষণা: রাজ্যের ভূমিপুত্রই হবেন মুখ্যমন্ত্রী
ঝিল্লি
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব মাতিয়েছে আগেই। ১১ নভেম্বর থেকে সিনেমা হলে সাড়া জাগিয়েছে গৌতম ঘোষের পুত্র ঈশান ঘোষের ‘ঝিল্লি’। ছবিতে ধরা পড়েছে এক টুকরো অন্য কলকাতা। এই কলকাতা আমাদের খুব চেনা নয়, দূর থেকে দেখা। জায়গাটি বঞ্চিত কোলাহল-মুখর শহর, গগনচুম্বী বহুতল, ঝলমলে শপিং মল, প্রাচুর্যের ছোঁয়া থেকে। সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিনগুজরান করে হতদরিদ্র কিছু মানুষজন। মাথা তুলে ঘুরে বেড়ায় সমাজবিরোধীরা।
অঞ্চলটির নাম ধাপা। যেখানে জড়ো হয় শহরের দুর্গন্ধযুক্ত বর্জ্য পদার্থ। আলোকিত শহরের মাঝে দানা বেঁধে রয়েছে এক টুকরো অন্ধকার। যে পথে সচরাচর পা মাড়ায় না কেউ, সেখানেই দিনের পর দিন কাটিয়েছেন পরিচালক, মিশেছেন মানুষগুলোর সঙ্গে, করেছেন শ্যুটিং। ওই অঞ্চলের জীবনযাপন, সুখদুঃখ অসামান্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন ছবিতে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের রূপান্তরিত করেছেন বিভিন্ন চরিত্রে। তথ্যচিত্রের আদলে তৈরি হয়েছে দেড় ঘণ্টার ছবিটি।
রক্তে সিনেমা। বলা যায়, প্রথম ছবিতেই জাত চিনিয়েছেন পরিচালক। এর আগে তিনি বাবার ‘শঙ্খচিল’ ও ‘রাহগীর’ ছবির সিনেম্যাটোগ্রাফি করেছিলেন।
‘ঝিল্লি’র জন্য শুরুতে পাওয়া যায়নি প্রযোজক। শেষমেষ গৌতম ঘোষ এগিয়ে আসেন, প্রযোজনা করেন। পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব নিয়েছে এসভিএফ।
তারকা, মহাতারকাদের পরিবর্তে অচেনা, কম চেনা মুখের ভিড়। গণেশের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিতান বিশ্বাস, শম্ভু চরিত্রে শম্ভুনাথ দে, গুড্ডু চরিত্রে সায়নদীপ গুহ, বকুল চরিত্রে অরণ্য গুপ্ত, চম্পা চরিত্রে সৌরভ নায়ক। প্রত্যেকেই নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছে সমাজের একেকজন সংগ্রামী প্রান্তিক শ্রেণির প্রতিনিধি। কেউ হাড় গুঁড়ো করার কারখানার শ্রমিক, কেউ করে অন্য কাজ। দুষিত পরিবেশেই তাদের যাপন। বিমানের উড়ান মাঝেমধ্যে স্বপ্ন দেখায়। পরমুহূর্তেই পা পড়ে বাস্তবের কঠোর মাটিতে। অনুধাবন করে, দারিদ্র্যের সঙ্গে তাদের নিত্য সহবাস। শিকড়ের প্রতি রয়েছে গভীর টান। স্বভূমি তাদের কাছে মায়ের মতো। প্রয়োজনে প্রতিবাদী হয়, ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
সেই অর্থে কোনও গল্প নেই। তবে আছে টুকরো টুকরো অসাধারণ কিছু মুহূর্ত। নির্ভেজাল মুহূর্তগুলো একটি সুতোয় বাঁধা পড়ে জন্ম দিয়েছে আস্ত একটা ছবির।
দর্শকদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছেন নতুন প্রজন্মের এই পরিচালক। আশা করি তাঁর নির্ভরযোগ্য উপস্থিতি আগামীদিনে সমৃদ্ধ করবে অন্যধারার বাংলা ছবিকে।