ভরসন্ধ্যায় খবরটা দেখেই চমকে উঠেছিলেন অলোকেশ। রিমোটের বোতাম টিপতেই চ্যানেলে চ্যানেলে বিগ ব্রেকিং, ‘পদযাত্রায় আচমকা হামলা, গুলিবিদ্ধ ইমরান খান।’ মিনিট কয়েকেই স্পষ্ট, ঘটনাস্থল লাহোরের ওয়াজিরাবাদ। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছেন ইমরান, গুলি লেগেছে তাঁর পায়ে। সব চ্যানেলে তথ্য মোটামুটি একই। কিন্তু অলোকেশ ধন্দে, যত বিপত্তি তো আততায়ী-বৃত্তান্ত আর ধারাভাষ্যে! আততায়ী এক নাকি দু’জন? ধরা পড়ার পর কি একজন আততায়ীর মৃত্যু হয়েছে গুলিতে? হামলার খুঁটিনাটি থেকে শুরু করে আগামীর ইঙ্গিত, এমন অনেক প্রশ্নেরই জবাব মিলছিল না ছোট পর্দার সম্প্রচারে। কিন্তু ডিজিটাল মিডিয়ার ধ্বজাধারী দেশি-বিদেশি অগণিত পোর্টাল ততক্ষণে বিচিত্র তথ্যময় প্রতিবেদনে ছয়লাপ। আততায়ীর খুঁটিনাটি থেকে শুরু করে হামলার আঁখো দেখা হাল, ষড়যন্ত্রের সাতকাহন থেকে রাজনৈতিক তাৎপর্যের ধারাভাষ্য সবেতেই এগিয়ে পোর্টাল, পিছিয়ে চ্যানেল।
আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামে আজ থেকে চাটাই পেতে বৈঠক
খাদ্য দফতরে কাজ করতেন বটে। তবে খবরই বরাবর অলোকেশের প্রিয় খাদ্য। হালের সোশ্যাল বা ডিজিটাল মিডিয়ার দাপট শুরুর আগে খবরের কাগজ ও পরে ছোট পর্দায় খবর পরিবেশনের খুঁটিনাটি অলোকেশের নখদর্পণে। দিনরাত খবরের নেশায় বুঁদ মধ্য-ষাটের মানুষটি এ তল্লাটে ‘খবরদাদু’ বলেই মুখে মুখে জনপ্রিয়। বোকা বাক্সের পাশাপাশি মুঠো ফোনেও খবরের আপডেটের সুলুক তিনি বিলক্ষণ জানেন। ডিজিটাল মিডিয়াও তাঁর অজানা নয়। বহুবার কানে এসেছে, ডিজিটাল মিডিয়ার পোর্টাল-দাপটে টিভি নাকি এখন ব্যাকডেটেড! তো ইমরানের উপর আততায়ী হামলার ঘটনায় যাকে বলে হাতে-গরম প্রমাণ। খবরদাদুই ঘোর ধন্দে, চ্যানেলে খবর মিস নেই বটে কিন্তু রীতিমতো চালিয়ে খেলে ছোট পর্দাকে কি সত্যিই দশ গোল দিচ্ছে ডিজিটাল দুনিয়া!
আরও পড়ুন-প্রাক্তন নৌ-কর্মী খুনে গ্রেফতার হল স্ত্রী ও ছেলে
রাতে উত্তর খুঁজে পাননি অলোকেশ। তবে আভাস পেলেন সকালেই। দুধের বুথফেরত মোড়ের চায়ের দোকানে গলা ভিজিয়ে নেওয়াটা তাঁর বরাবরের অভ্যাস। রোজকারের মতোই দৈনিকের এক এক পাতা মুখে চায়ের কাপ হাতে তুফান তুলেছিলেন কয়েকজন। ইমরানের উপর হামলা থেকে শুরু করে পুতিনের হুঁশিয়ারি, তালিকা বেশ লম্বা। তাল কাটল দামি বাইকের আরোহী অফিসমুখো তরুণের টিপ্পনীতে। মোবাইলে মুখ গুঁজে গলা ভেজাতে ভেজাতেই খবর পড়ার ঢঙে একটানা বলে চলেছিল সে। বেরনোর আগে সকালে টিভি খুলে আপডেট দেখেই বেরিয়েছেন অলোকেশ। কিন্তু ইমরান-কাহিনি তো বটেই, অন্য একাধিক খবরের এমন সব ইনপুটও তো তাঁর স্রেফ অজানা! অতঃপর অলোকেশ অকপট, টিভিতে তো এসব বলেনি…! ঠিক তখনই ‘জাদু কি ছড়ি’ ঘোরানোর মতো হাতের মোবাইল ঘুরিয়ে মুখ খুলল সেই তরুণ, ‘‘শুধু টিভিতে মুখ গুঁজে থাকলে চলবে না। মোবাইলে নিউজ আপডেট আর পোর্টালগুলো না দেখলে পিছিয়ে পড়তে হয়।’’
আরও পড়ুন-বিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস নিলেন বিডিও
বাড়ি ফিরে দিনের দ্বিতীয় চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই পরিকল্পনা ছকে ফেলেছিলেন অলোকেশ। নিউজ চ্যানেলগুলোর খবর ভাল করে স্ক্যান করা দরকার। পাশাপাশি চালু পোর্টালগুলোর পরিবেশনাও নজরে রাখা জরুরি। টিভিতে নিউজ চ্যানেলের সম্প্রচার ও মূলত মুঠো ফোনে ডিজিটাল মিডিয়ার রীতিমতো ‘কাঁটে কে টক্করের’ হাল হকিকত সরেজমিনে পরখ করে নিতে চান খবরদাদু। স্মার্ট ফোন কিনে দেওয়ার পর বাবার খবরের খিদে মেটাতে একদিন ছেলে বসে বিভিন্ন কাগজ ও চ্যানেলের পাশাপাশি সাধারণ কয়েকটি নিউজ অ্যাপও ডাউনলোড করে দিয়েছিল। টিভির নিউজ চ্যানেলের মায়াজালে বাঁধা পড়ে এতদিন মোবাইলের সেইসব অ্যাপ বা নিউজ নোটিফিকেশনে তেমন নজরই দেননি অলোকেশ। বিভিন্ন নিউজ পোর্টালের নাম শুনেছেন, কাগজ বা চ্যানেলগুলোরও যে ডিজিটাল উইং আছে তাও জেনেছেন, কিন্তু নেড়েচেড়ে দেখেননি। সেই পোর্টাল আর অ্যাপের দুনিয়ায় ঢুঁ মারতেই চমক! নিউজ চ্যানেল যে খবর থেকে সম্প্রচার চালাচ্ছে লাগাতার, পোর্টালে তারই বহু রূপ। চ্যানেলে হাতে-গরম খবরের সরাসরি সম্প্রচারের আলাদা আকর্ষণ আছে ঠিকই কিন্তু কোনও কোনও পোর্টালেও তো বেশ চলছে সরাসরি সম্প্রচার! সর্বোপরি চ্যানেলের খবরের পরিধি বাঁধা। রাজনীতি, ক্রাইম, অর্থনীতি ও সামাজিক নানা ঘটনার আবর্তেই পাক খেয়ে চলে খবরের ওঠাপড়া। কিন্তু ডিজিটাল মিডিয়া নির্ধারিত গণ্ডির বেড়ায় বাঁধা পড়ে নেই।
আরও পড়ুন-পরিযায়ী শ্রমিকের বাড়িতে ৩৮ লাখ
খবরের অফুরান ভাঁড়ারের জাদুবলেই টিভিকে টেক্কা দেওয়ার পথে ডিজিটাল মিডিয়া। কারণ টার্গেট অডিয়েন্স জনতা জনার্দনের যে দিল মাঙ্গে মোর! অলোকেশের মনে পড়ছিল, এই তো সেদিনও সন্ধ্যায় খবর শুনতে বা বড় কোনও খবরের আপডেট জানতে বৈঠকখানায় টিভির সামনেই ভিড় করে বসত ছেলে-বউমা, নাতি-নাতনিরাও। হাতে হাতেই এখন খবর অঢেল। আর সেই পারিবারিক মজলিশ ভেঙে খান খান।
সেই ছেলেটির কথা আজ খুব মনে পড়ছে অলোকেশের। হেড অফিসে নিত্য যাতায়াত করত। গুদামে মাল মজুতের হিসাবে গরমিল নিয়ে খবর করার জন্য ‘বড়বাবু’র বাইট নিতে বুম হাতে গভীর রাত পর্যন্ত অফিসেই হত্যে দিয়ে পড়েছিল। টিভিতে নিউজ চ্যানেলের খবর সংশ্লিষ্টদের বাইট ছাড়া নেহাতই ফিকে। কিন্তু ডিজিটালের দোসর সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সেই বাইটটাইট এখন অনেকটাই ব্যাকডেটেড। ফেসবুকে বেশ অ্যাক্টিভ অলোকেশ। ট্যুইটার, ইনস্টাগ্রামেও কমবেশি। সেখানে হরবখতই তো নজরে পড়ে রাজনৈতিক নেতা থেকে সেলিব্রিটি, সবাই অকপট। কাজেই বাইটের থোড়াই কেয়ার, সোর্সরা নিজেরাই এখন খবরশিকারি থেকে শুরু করে আমজনতার নাগালে। আর টিভির নিউজ চ্যানেল থেকে অনেক বেশি সুলভ সোশ্যাল মিডিয়া বা ডিজিটাল পোর্টালে। দূরদর্শন হলে তো কথাই নেই, বেসরকারি নিউজ চ্যানেলেও এখনও সব কথা খোলাখুলি বলার চল নেই। ধর্ষণ বা নৃশংস ক্রাইমের খবরই হোক কিংবা সংবেদনশীল কোনও ইস্যুর— পরিবেশনে ভাষার বাঁধুনি থেকে শুরু করে ছবি পরিবেশনেও আগল থাকে একাধিক। আর পারিবারিক গণমাধ্যমের অছিলায় কিছু কিছু খবরের তো নিউজ চ্যানেলে এখনও স্রেফ নো এন্ট্রি। কিন্তু দিনভর পোর্টালের দুনিয়া চষে ফেলে অলোকেশ তো রীতিমতো তাজ্জব! সোশ্যাল মিডিয়ায় খোলামেলা কথা ও ছবির বহর দেখে নিজেই কতবার মুখ ফিরিয়েছেন। কিন্তু পোর্টাল তো আরও এককাঠি সরেস! রাজনীতি থেকে সমাজ বা অর্থনীতির কোনও এলাকাই এখানে আলোচনায় ব্রাত্য নয়। নিখাদ যৌনতা থেকে শুরু করে তামাম ‘অন্দর কি বাত’ও এই মিডিয়ায় চলে খুল্লম খুল্লা। গোপনীয়তার নেই মালিকানা। পাল্লা দেয় সাধ্যি কী নিউজ চ্যানেলের! হালের দৈনন্দিনে রাখঢাকের বালাই বড় কম। যে কথা আগে চার দেওয়ালের ঘেরাটোপেই বন্দি থেকে যেত অনন্তকাল, এখন তাও অনায়াসেই এসে পড়ে ওপেন ফোরামে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এখন যে কোনও বিষয়ই খোলামেলা আলোচনার তালিকায়। টপিক সর্বজনীনই হোক কিংবা নেহাতই ব্যক্তিগত। অলোকেশের চোখে এটাও বোধহয় এক ধরনের জেনারেশন গ্যাপ! তাই এতদিন যা গোপনীয় বা প্রকাশ্যে আলোচনার বিষয় নয় বলে জেনে এসেছেন, সেসবের প্রতি এই প্রজন্মের অ্যাপ্রোচ দেখছেন স্রেফ উল্টো। তাদের জানার আগ্রহ সীমাহীন, আলোচনা বা বিতর্কেরও। আবার ছক ভাঙা পথে এগোতেও দিব্যি তৈরি তারা। রাজনীতি, অর্থনীতির খবরে অনাগ্রহ অনেকের থাকতেই পারে। কিন্তু সোশ্যাল বা ডিজিটাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে থাকা আরও বিচিত্র বিষয়ে তো জেনারেশন ওয়াইয়ের আগ্রহ অনাবিল। টিভির পর্দায় নিউজ চ্যানেলের সম্প্রসারণে সেই খোরাক কোথায়! কাজেই নেটিজেন মাত্রই এখন সোশ্যালই হোক বা ডিজিটাল— মিডিয়ার বিপুল টার্গেট অডিয়েন্সের শরিক। পরিণতি, ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ার শরিক বনে গিয়েছেন ৫০ শতাংশেরও বেশি নেটিজেন। আগামী বছর তিনেকে যা দাঁড়াবে ৬৮ শতাংশ ছুঁইছুঁই। মনে রাখতে হবে, ডিজিটাল মিডিয়ার উপভোক্তারাও সোশ্যাল মিডিয়ার এই অডিয়েন্সেই শামিল। তুলনায় টিভির পর্দার অনুষ্ঠানের দর্শক বেড়েছে মাত্র ১০ শতাংশের কাছাকাছি, নিউজ চ্যানেল যার অন্যতম শরিক। সিগারেটে সুখটান দিতে দিতেই অলোকেশের কপালে ভাঁজ, তবে কি টেলিভিশন মিডিয়াকে গ্রাস করে ফেলবে ডিজিটাল দুনিয়া!
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের দুর্নীতি, রাজ্যের প্রতি বঞ্চনা নিয়ে সমালোচনায় সরব তৃণমূল
ইমরানের উপর হামলার খবরের বহুমুখী পরিবেশনার কৃতিত্ব দাবি করতেই পারে ডিজিটাল মিডিয়া। আবার এটাও ঠিক, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনেক অসম্পূর্ণ এবং অসত্য তথ্যও সেদিন পরিবেশিত হয়েছে সোশ্যাল ও ডিজিটাল-প্রচারেই। খবরের গভীরতা অটুট রেখে নির্ভুল তথ্যে পরিবেশনের নিরিখেই এখনও ডিজিটাল মিডিয়ার তুলনায় বিশ্বাসযোগ্যতায় কিছুটা হলেও এগিয়ে নিউজ চ্যানেল-ভিত্তিক টিভি মিডিয়া। সারাদিন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ডিজিটাল পোর্টালে খবরের বন্যায়। কিন্তু খবরের কারবারিদের বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণই হল, ঝেড়েবেছে বা ছেঁকে না নিলে হিতে বিপরীতের সম্ভাবনা প্রবল। সত্যি বলতে কী, সাংবাদিকতার এথিক্স মেনে খবর যাচাই থেকে শুরু করে উভয়পক্ষের বক্তব্য-সহ সম্প্রচারের চালু রীতি এখনও অটুট নিউজ চ্যানেলেই। ডিজিটাল মিডিয়ায় এমন রীতি-নীতি মানার চল নেহাতই কম। তথ্যভিজ্ঞ মহলের কথায়, আইনের বাঁধনে যে বাঁধা টিভি মিডিয়া। বেচালে শাস্তির বিধানও আছে। ডিজিটালেও তেমন শাসন চালুর কথা শোনা গেলেও বাস্তবে এখনও হয়নি।
আরও পড়ুন-আইডল নেইমারের চাপ কমাতে চান ভিনি
ছাদে পায়চারী করছিলেন অলোকেশ। চ্যানেলের টক শো বা প্রাইম টাইমের খবরে আজ আর মন বসেনি। টিভির পর্দায় হরেক নিউজ চ্যানেলের কেতাদুরস্ত পরিবেশনা যতই নজর কাড়ুক, ডিজিটাল মিডিয়া যে সেই একচ্ছত্র সাম্রাজ্যে ভালরকম ভাঙন ধরিয়েছে, তা ছানবিন শেষে অলোকেশের কাছে বেশ স্পষ্ট। নিউজ চ্যানেলের পরপর বুলেটিন বা আলোচনা শুনতে শুনতেই একসময় টিভির ঘরে দিনের শেষে জমে উঠত পারিবারিক রি-ইউনিয়ন। ড্রয়িংরুমে বোকা বাক্সে বন্দি হয়ে থাকার সেসব দিন এখন অতীত। মুঠোফোনের মায়ায় ড্রয়িংরুমের সেদিনের শরিকরাই আজ এক ছাদের তলায় থেকেও যেন আলাদা আলাদা দ্বীপের বাসিন্দা। অলোকেশের মনের গহনে দোলাচলের চোরাস্রোত, প্রযুক্তি বদলের হাত ধরে দ্রুত ডানা মেলছে ডিজিটাল মিডিয়া। সেই তালে তাল রেখেই মুঠোফোনে নিজস্ব আবর্তে একা হয়ে পড়বে না তো পরিবারের কয়েকজন! আলোকবর্ষের হিসাব ভুলিয়ে দূরে সরে যাবে না তো পরিবারের সুজন, স্বজন!