দেবু পণ্ডিত: ‘নতুন গতি’ পত্রিকার ইদ সংখ্যা একটি প্রয়োজনীয় ও সংগ্রহযোগ্য গ্রন্থ। এই বইয়ের পাতায় পাতায় ধর্ম সাহিত্য ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব বিষয়ক আলোচনার বলিষ্ঠ মেলবন্ধন রচিত হয়েছে।
এই বিশেষ সংখ্যার একাধিক প্রবন্ধ ইদ বিষয়ক। যেমন এ হান্নান লিখেছেন, ‘ ঈদ কী ও কাদের জন্য’। সেখানে সুস্পষ্টভাবে যথাযথ সূত্র সহকারে বিবৃত হয়েছে বছরে দু’বার আসা এই আনন্দময় উৎসবের প্রাণবিন্দু পবিত্রতাকে নিউক্লিয়াস করে গড়ে উঠেছে। আবার মাহফুজুর রহমান আখন্দ তাঁর নিবন্ধে দেখিয়েছেন কীভাবে গোটা বিশ্বে ইদকে কেন্দ্র করে লোকসংস্কৃতির প্রসৃতি অর্জিত হয়েছে। মহম্মদ মফিজুল ইসলাম তাঁর নিবন্ধে স্বল্প পরিসরে একই কথা সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন ফিতরা যাকাতের মহতী প্রণোদনার বিষয়টি।
আবুল কাশেমের বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছেন ড. রমজান আলি। প্রবন্ধটির সঙ্গে রয়েছে আবুল কাশেমের বংশতালিকা এই প্রবন্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
আরও পড়ুন-বোকাবাক্সের সাদাকালো দিনগুলো
মইনুল হাসান রাজনীতিক, সত্য, তবে ভিন্ন ঘরানার রাজনীতিক। তাঁর লেখাতেও সেই অন্য সুর ও অনন্য হয়ে প্রকাশিত। তিনি যখন লেখেন, গেরুয়া পক্ষ যা করছে ‘সেটা হিন্দু ধর্ম নয়’, তিনি যখন বলেন হিন্দুত্ব মানে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ আর উপনিষদ ত্যাগের কথা, ভালবাসার কথা, সর্বত্র ঈশ্বরের পরিব্যাপ্ত থাকার কথা বলে, তখন টের পাই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সনাতনী সুরটি তাঁর মতো মানুষদের হৃদয় বাঁশিতে ধরা পড়েছে। তখন প্রার্থনা করি, এই সুর সর্বব্যাপী হোক। ‘আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া আজকের নিদারুণ কষ্টগুলোকে জয় করে আবার সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে’, তুলতেই হবে।
এইসব অনবদ্য প্রবন্ধ সমাহারের পাশাপাশি একটি প্রবন্ধের বিষয়বস্তু চোখ ও মনকে টানে। ‘বিশ্ব সাহিত্যে আরব্য রজনীর প্রভাব’। লেখক মহম্মদ বরজাহান। আরব্য রজনীর কাহিনিগুলো কীভাবে ‘ভূগোল-বিশ্বাসের সীমা’ অতিক্রম করে বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনায় নয়া আলপনা এঁকেছে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ থেকে টেনিসন, বায়রন থেকে ইয়েটস সবাই কীভাবে এইসব কাহিনির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, সেসবের বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন এই নিবন্ধ। এই গল্পগুলি যে আদতে দুর্নীতি থেকে মুক্তির দিশা দেখায় সেকথা জানার ও বোঝার পর আরব্য রজনী মননে ভিন্ন মাত্রা খুঁজে নেয়, সেকথা অনস্বীকার্য।
আরও পড়ুন-ভারতীয় টেলিভিশন আজও সাবালক হতে পারল না
একইরকম আকর্ষক বিষয়বস্তু মুহাম্মদ হেলালউদ্দিন রচিত নিবন্ধ ‘নিম্নবর্গের নিম্নবর্ণের রবীন্দ্রনাথ’। অজানা তথ্যের অনবদ্য উচ্চারণে প্রবন্ধটি আকর্ষক হয়ে উঠেছে। সাধারণভাবে অনালোচিত বিষয় আলোচনা করে এটি বিতর্কের সলতে উসকে দিয়েছে, সন্দেহ নেই।
একইভাবে খায়রুল অনামের প্রবন্ধ আমাদের সামনে এক অচেনা ঔরঙ্গজেবকে তুলে ধরে। একটি বক্তব্যেই অনেক কথা ফুটিয়ে তুলেছেন প্রাবন্ধিক। ‘ঔরঙ্গজেব প্রকৃত অর্থে ধার্মিক ছিলেন। ধর্মান্ধ ছিলেন না।’ তাঁর মনে হয়েছে, আলমগীর তাঁর ‘শাসনে রাজধর্ম রক্ষা করে গেছেন।’ কিন্তু ‘দেশকে ধর্মীয় রাষ্ট্র বানানোর কোনও প্রচেষ্টা তাঁর ছিল না।’
অনবদ্য প্রবন্ধ সম্ভারের সমান্তরালে রয়েছে অনবদ্য কিছু ছোট গল্প। সেগুলোর মধ্যে এমদাদুল হক নূরের ‘প্রেম’, মাসুদ আখতারের ‘আমি জবাব দিইনি’, শেখ আব্দুল মান্নানের ‘ডেডবডি’, নৌশাদ মল্লিকের ‘জীবন সায়াহ্নে’, কুমারেশ চক্রবর্তীর ‘অপারেশন বিদ্যা বালান’ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। মনিরা খাতুন, গোলাম রসুল, বন্দনা মালিক, ফারিন ইয়াসমিন, রিজিয়া সুলতানা প্রমুখ কবির কবিতাগুলোও মনে রেখাপাত করে।
আরও পড়ুন-বাক্স ফিকে মুঠোয় ম্যাজিক
এই অনবদ্য সংখ্যা পাঠের শেষে মনের কোটরে জেগে ওঠা অনুভূতিকে প্রকাশ করতে গেলে এখানেই প্রকাশিত একটি কবিতা ‘তখনও মানুষ থাকে’ (কবি মহম্মদ সফিকুল ইসলাম)-র পঙ্ক্তির আশ্রয় নিতে হয়।
‘‘মানুষের বীজ থেকে মানুষ জন্ম নেয়/ হায়না কুকুর শুয়োরের দলে মিশে/ বজ্জাতরূপে একদিন রক্ত মাংস চায়।/… মানবতা বুকে আঁকড়ে কিছু লোক/ তখনও মানুষ থাকে।”
তাঁরাই এরকম গ্রন্থ খুশির ইদে আমাদের দিতে পারেন। দিয়ে থাকেন।