ঘাতকের হাতে রক্তের দাগ…

পৃথিবীর তাবৎ শাশ্বত সত্য কাব্যিক আখরে উচ্চারিত হয়েছে চিরকাল। যেমন বেদের সনাতন বাণী উদ্গীরিত হয়েছিল ছান্দস ভাষায়। এ-কালেও একজন কবি মিথ্যের মুখোশ ছিঁড়ে টেনে বের করে এনেছেন হত্যাকারীর পরিচয়নামা। হয়ে উঠেছেন সমকালের বিবেক। লিখছেন দেবাশিস পাঠক

Must read

একটি কৃশকায় বই। কবিতার। মোটে ৩২ পৃষ্ঠার। একেবারে কবির ব্যক্তিরূপের মতো। এবং কবির ব্যক্তিত্বের মতোই ওই শীর্ণ আকারের আড়ালে টানটান শিরদাঁড়ার দার্ঢ্য স্পষ্ট প্রতিটি কবিতায়। ১৮টি কবিতার শীর্ণকায় সংকলন। অষ্টাদশ অক্ষৌহিনীর আক্রমণে পর্যুদস্ত, ছিন্নভিন্ন ঘাতকের তাবৎ ন্যাকামির ব্যারিকেড, রাজনৈতিক নষ্টামির প্রতিরোধমূলক দেওয়াল।

আরও পড়ুন-সাহিত্যগন্ধী ইদ সংখ্যা

প্রথম কবিতার প্রথম লাইন। তাতেই যেন কবির সোচ্চার ঘোষণা। একেবারে আত্মপক্ষ সমর্থনে বলিষ্ঠ উদগীরণ। ‘কবিতা হচ্ছে না? বলছ? না হোক কবিতা।’ তারপর সরাসরি, মেরুদণ্ড সোজা রেখে কবি গুজরাত দাঙ্গার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রীকে হিসেবে নির্বাচিত করাকে উপমিত করেন আকাশ পানে থুতু নিক্ষেপের সঙ্গে। বলেন, ওরকম কৃতকর্মের অনিবার্য ফল হল ‘দ্যাখা/ কীরকম সেই থুতু থ্যাপ করে এসে পড়েছে নিজের মুখেই।’
শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এরকম প্রতিস্পর্ধী পঙ্ক্তি যে মুষ্টিমেয় শিরদাঁড়া সচেতন কবি লিখতে পারেন তাঁদের অন্যতম জয় গোস্বামী এই হিম্মতেরও উদ্গাতা।

আরও পড়ুন-বোকাবাক্সের সাদাকালো দিনগুলো

‘সংবাদ মূলত কাব্য’ শিরোনামে দুটি কবিতা জায়গা করে নিয়েছিল জয়ের পূর্ববতী কাব্য সংকলন ‘কঙ্কাল’-এ। বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে আমরা অভিন্ন নামচিহ্নে দশটি কবিতা পাই। কবিতার নাম বিষ্ণু দে-র কাব্যগ্রন্থের শীর্ষনাম থেকে উদ্ধৃত। কবি নিজেই ভূমিকাতে সেই সংবাদ জানিয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই শিরোনামের প্রতিটি কবিতা পেরেক হয়ে নিজেদের গেঁথেছে ঘাতকের মুখোশে। অনাবৃত করেছে তাদের স্বরূপ।
স্পষ্ট কথাটি সরাসরি বলা। প্রত্যেকটি অক্ষর অনপেত উচ্চারণ। কবি যখন বলেন, ‘পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানোকে/ পরপর ধর্ষণ করে যারা জেলে ছিল এতদিন/ তাদের অন্যায় সব মাফ হয়ে গেছে—/ সকলকেই ছেড়ে দিয়েছে স্বাধীন দেশের সরকার!’ তখন বলার ধরনে ও ছেদ-যতি চিহ্নর প্রণোদনায় আর নতুন করে কোনওকিছুই ব্যাখ্যার দরকার পড়ে না। একই বিষয়ে লেখা ‘ন্যায়যুক্তিপথ’। তার শেষ লাইনেও একেবারে বীতাগ্নি প্রহরের প্রশ্ন এবং সেটি মোহন ভাগবতকে, ‘তবে কি মা-বোন নেই আপনার ঘরে?’
যদি বলি এসব কবিতা নয়, এসব এক ‘প্রাতর্গেয়’ রূপে প্রচারিত পুরুষকে চাঁদমারি করে তৈরি প্রচার পুস্তিকার প্রাতিস্বিক বিদ্রব, তাহলেও কবির কিস্যু এসে যায় না। তিনি তো বলেই দিয়েছেন, ‘কবিতা লিখছি না আমি আর!/যা লিখছি, তা চিৎকার! চিৎকার!’

আরও পড়ুন-বাক্স ফিকে মুঠোয় ম্যাজিক

এই চিৎকৃত স্পষ্টতা টলমল করে দেয় আমাদের ঘুমিয়ে থাকা বিবেককে। এলোমেলো করে দেয় আমাদের নিত্য যাপনের স্থবির সুখকে। আমরা বেপমান অস্তিত্বে হারিয়ে যাই। যেতে বাধ্য হই।
সেই কবে মহাশ্বেতা দেবী ‘হাজার চুরাশির মা’তে লিখেছিলেন, ‘দল এবং ঝান্ডা বদলালেই ঘাতকরা নিষ্কৃতি পায়।’ আর এতদিন পর জয় আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেখিয়ে দিলেন, অভগ্ন আনুগত্যে একটি বিশেষ রঙের ঝান্ডা ধরে থাকলে ঘাতকও শাসকের মতো সমীহ পায়। আর সেজন্য দায়ী আমরাই।

আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামে আজ থেকে চাটাই পেতে বৈঠক

রবীন সুর একদা তাঁর কবিতায় প্রগাঢ়তর আবেগে স্পন্দিত হয়ে লিখেছিলেন, ‘তিনিই কবি যাঁর পিঠে চাবুকের দাগ থাকে না/ এক অর্থে তিনি সৈনিক…/ যে বেঁচে থাকায় বঞ্চনার বিষ/ যে জীবন জীবন্ত নয়/ যে পৃথিবী সুন্দর করার জন্য আমরা/ পূজা করে আসছি,/ নামাবলী কমণ্ডলু ধূপধুনা ব্যতিরেকে/ তিনি সেই পূজার পুরোহিত/তার গলায় শেকলের দাগ নেই।’
যে-বইয়ের মলাটের রং ঝরা-রক্তের কালচেটে রক্তিমতায় অনুজ্জ্বল কিন্তু অনুভবী চিন্তায় গাঢ়, সেই কবিতার বইয়ের কবিকে আমরা সৈনিক-পূজারি হিসেবে আরও একবার চিনে নিলাম ‘ঘাতক’-এর বচন-অনির্বচনের সদ্য মিলনের পরিভূষিত উৎসবে। আর নিজেদের চিনে নিই ‘ঘাতক’ হিসেবেই। কারণ, আমাদের জন্যেই তো ‘নিজের চলবার পথে নিজে অবশেষে/বসে পড়েছেন গান্ধীজি’।

আরও পড়ুন-প্রাক্তন নৌ-কর্মী খুনে গ্রেফতার হল স্ত্রী ও ছেলে

পুনশ্চ : জয় গোস্বামীর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ঘাতক’-এর বিষয়ে এই অদীক্ষিত কবিতা পাঠকের যা যা বলার ছিল, সব বলা হয়ে গিয়েছে। তবু এই অংশের অবতারণা করতেই হল শুধু একটিমাত্র কথা বলতে চাওয়ার অদম্য আগ্রহে। ‘ঘাতক’ বইটির অন্তিম উচ্চারণ তাৎপর্যপূর্ণভাবে ‘গান্ধীজী’। এই উচ্চারণে কোনও ছান্দিক বাধ্যবাধকতা বা কাব্যিক অনুপ্রেরণা নেই। সে সম্ভবনা নাকচ করে কবি নিজে ‘ভূমিকা’ অংশে কোনও রাখঢাক না করেই জানিয়েছেন, ‘যে মাত্রাটি এল না ছন্দের ক্ষেত্রে, বা বলা যায় শূন্য রয়ে গেল যে মাত্রাটি, কেন্দ্রীয় সরকার ও হিন্দুত্ববাদী দলগুলির কাছে গান্ধীজীর আদর্শও সেরকমই শূন্য হয়ে গেছে আজকের ভারতবর্ষে।’ অধিকতর ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।

Latest article