তখন আমি হেমন্তে মশগুল, আচ্ছন্ন একেবারে। তেমন সময়ে কানাডার টরন্টো শহর থেকে বন্ধু বার্তা পাঠাল, ‘‘এখানে একটা জায়গায় গিয়েছিলাম, মেপল গাছের ঝরা পাতা দেখতে। ওঃ! কী রং রে পাতার! ছবি পাঠালাম।” মেপল পাতার ছবি তো দেখাই আছে। পুলকিত হয়ে বেমালুম লিখে দিলাম ‘‘তার মানে ওখানেও হেমন্ত ঋতু!” ওর উত্তর, ‘‘তোর দেখছি মাথাটা গেছে। হেমন্ত বলে এখানে কিছু আছে নাকি? ভারতের মতো ছ’টা ঋতুর দেশ নাকি? এটা এখানে সামারের শেষ। অক্টোবরে মেপলের ফল হয়, নভেম্বরের শেষে সব পাতা ঝরে যায়।” লিখলাম, ‘‘তুই তো ফিরছিস, আমার জন্যে একটা পাতা অন্তত আনিস।” এল বটে সে পাতা, কিন্তু শুকিয়ে মচমচে হয়ে গেছে। আমি হেমন্তকে সাক্ষী রেখে সেই মৃত পাতাটির সঙ্গে ভূস্বর্গ কাশ্মীরের খসে পড়া চিনার পাতার বিবাহ ঘটিয়ে দিলাম– মনে মনে। এ সময় চিনার পাতারও ঝরে যাওয়ার কাল। আমাদের হেমন্ত বড্ড কোমল তো তাই টুপটাপ পাতা খসায় বটে, পাতায় পাতায় হলুদ বর্ণ ছুঁইয়ে বৃক্ষসমূহকে শুধু ইঙ্গিতটুকুই দেয়,— পাতা খসানোর সময় আগতপ্রায়। আমাদের হেমন্তকাল এমনই। সে আসে। দুটি মাস ধরে প্রকৃতি আর সে মহা মহোৎসবে মাতে। আমরা তার তার কাছে নতজানু হই।
আরও পড়ুন-হেমন্তের উৎসব
সারারাত ধরে নবীন কুয়াশা ছানবিন করেছে সদ্য ফোটা সরষে ফুলে, পাকা ধানের শিষে, খেতের আনাজপাতিতে, গাছগাছালির মাথায়। পুব আকাশে লালচে আলোর আভাস ক্রমশ প্রকাশ হচ্ছে, আর একটি দিনের আগমন ঘটতে চলেছে। কুয়াশার পর্দা সমান্তরাল রেখা ধরে মাঠ ছেড়ে উঠে যাচ্ছে আরও উপরে, বিলীন হয়ে যাবে তারা। হেমন্তের চিত্রভানু মোলায়েম আলো নিয়ে স্পর্শ করল প্রকৃতির যাবতীয় সম্ভারে। ক্রমশ উজ্জ্বল হল সে। হেমন্তের রোদ্দুর। বড়ই নম্র, স্বভাব-বিনয়ী। সারা দিনমানে সে উজ্বল, কিন্তু প্রখর নয়। পড়ন্ত বিকেলে তার সোনালি আলোয় মোহের রূপটান। আহা! হেমন্তের প্রেমে না পড়ে উপায় নেই হে। তার আলো, তার অন্ধকার, দু’টি মাস ধরে তার উপস্থিতি কাঙাল করে তোলে প্রেমের হাটের বুলবুলাকে।
বসন্তকালকে ঋতুরাজ বলে। সে প্রেমে দিওয়ানা করতে পারে মানুষ-মানুষীকে–এমনটা কাব্য-সাহিত্যই ঠিক করে দিয়েছে। ফুলের ডালি নিয়ে আসে বসন্তকাল। তবে কি এই যে উষ্ণায়ণ গ্রাস করছে প্রকৃতিকে, তার জ্বালায় বসন্তের সেই সোহাগভরা রূপ একেবারে ঘেঁটে গেছে। গ্রীষ্ম তাকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। কিন্তু হেমন্ত তার কাল-নির্ণয় অনুযায়ী সময় ধরে উপস্থিত হয়। বর্ষা আকাশকে ধুয়ে মুছে ঝকঝকে করে দিয়ে বিদায় নেয়। হেমন্ত ঋতুর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। হেমন্তও ভালবেসে ফেলার কাল, সে এসেছে বলে পুরুষ-নারীর প্রেম মোটেও সংঘটিত হয় না। মানুষের প্রেম ঘটে প্রকৃতির হেমন্তকালীন উপহারের সঙ্গে।
আরও পড়ুন-জনসমুদ্রে অবরুদ্ধ রামনগর, বিরোধী দলনেতাকে চ্যালেঞ্জ বীরবাহার
এই ঋতুটি আনন্দে ভাসিয়ে দেওয়ার কাল। খ্যাপার মন বৃন্দাবন হওয়ার কাল। তার আগমনে উদযাপিত হয় উৎসব। ‘মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে—/ শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।’ সে উৎসবের মূল উদ্যোক্তা হেমন্ত। আমি,–মনে নেই কতদিন আগে থেকে যেন, হৈমন্তী এসে গেছে টের পেলেই বন্ধ দুয়ার খুলে দিই, তাকে আবাহন-মন্ত্রে বন্দনা করি। কাঙালের মতো কল্পনায় চরাচর পেরিয়ে হেঁটে যাই। তার আলোয় স্নাত হই, রাতের অন্ধকারে অবগাহন করি। পূর্ণিমার জোছনা মাখি সর্বাঙ্গে। কামিনী, ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ নিই। পাকা ধানের গন্ধে উথালপাথাল হই। ঘাসফুলে শিশিরকণা খুঁজি। নিমফুলের সুবাস পাই।
আরও পড়ুন-বহুমাত্রিক লেখনীর স্রষ্টা ছিলেন উপেক্ষিত কথাসাহিত্যিক আবদুল জব্বার
হেমন্ত এসেই শুরু করে তার খেলা, তার দায়িত্ব পালনে মনোযোগী হয়। শুরু করে তার কর্মযজ্ঞ। হেমন্তের মাঝবরাবর। চৌকো মাঠ জুড়ে শীতের আগের সরষে ফুল যেন ভ্যান গখের ছবির উজ্বল হলুদ রং। আর একপাশে ধানের খেত। সদ্য পাকা ধানে সোনালি রং ধরেছে, ঈষৎ নত তারা। তার ওপরে আস্তর বিছিয়েছে সকালের আলো। মাটিতে লগ্ন হয়ে থাকা কড়াইশুঁটির গায়ে নীহারবিন্দু তখনও উজ্জ্বল। আলপথ দিয়ে হেঁটে চলেছে যেজন, তার আর হাঁটা হচ্ছে না। মায়াময় দৃশ্য তাকে স্থবির করে দিয়েছে। কথাটা হল, অঘ্রানে গ্রামে গেলেই তার সঙ্গে হেমন্তের নিবিড় সখ্য হয়। হেমন্ত তাকে, না জানি আরও কত খ্যাপা-খেপিকে ঘরের বাহির করে। হেমন্ত কড়া নাড়ে তাদের দরজায়।
ন্যায্য কথাটি হল, গ্রামে না গেলে হেমন্তের সম্পূর্ণ রূপ বোঝা যায় না। তাকে নিবিড়ভাবে পাওয়া যায় না। গ্রামে আমার শ্বশুরবাড়িতে কার্তিক-সংক্রান্তিতে কার্তিক পুজোয় যেতেই হত। ফলে, আমার প্রিয় ঋতুটিকে প্রতি বছর নানাভাবে কাছে পেতাম। মাঠময় সোনালি ধান, অঘ্রান পড়তেই কৃষকরা গোছা ধরে কর্তন করছেন। গরুরগাড়িতে বোঝাই হয়ে যেতে যেতেও তারা সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। চৌখুপী কাটা মাঠে কতরকমের সবজি, হেমন্তের বার্তা পেয়ে পরিপূর্ণ রূপ ধরছে সব। খেজুর গাছগুলি হেমন্ত আসতেই রসবতী হয়ে ওঠার আয়োজন শুরু করেছে। ভোরে ভেজা মাটিতে চটি বাদ দিয়ে সবজি খেতে হাঁটার নেশাটি যে কী পুলক জাগাতে পারে, তা যে পায় সে জানে। বিকেলের নতমুখী আলো মেখে অসুন্দর বাঁশের মাচা, গোয়ালঘরটিও সুন্দর হয়ে ওঠে। বেশি বেশি বলা হচ্ছে, তাই না? কী আর করা যাবে, হেমন্তের কাছে পেতে পেতে আমি যে তার বড্ড ন্যাওটা হয়ে গেছি।
আরও পড়ুন-অভিষেকের সঙ্গে বৈঠকের পরেই পঞ্চায়েত প্রস্তুতি, শুক্রবারেই বীরভূমে প্রথম সভা
হেমন্ত কৃপণ নয়। শহরজীবনেও সে আসে আমাদের কাছে। তার আলো, তার অন্ধকার, তার কুয়াশার দল, ঝকঝকে জোছনা, মৃদু হিম,— সব আসে। একরকমভাবেই আসে। শুধু, যে যেমন, তার কাছে সে তেমনভাবেই ধরা দেয়। সে কেমন?
আনাজ-বাজারে এসেছেন তাঁরা। বিক্রেতা তাঁর সামগ্রী সাজিয়ে বসেছেন। ক্রেতা বলছেন, ‘‘মুলো শাক কই? কাত্তিক মাস পড়ে গেল এখনও মুলো শাক ওঠেনি নাকি!” আরেকজন খোঁজ করছেন কার্তিকের বেথুয়া শাকের, ‘‘বেতো শাক উঠেচে?” আর এক বাবু, ‘‘হ্যাঁ রে, কাত্তিক মাস শেষ হতে চলল, এখনও টাটকা মুলো আনিসনি!” দোকানি বিনীত স্বরে বলছেন, ‘‘আজ্ঞে বাবু, কাত্তিক মাস সবে পড়ল। আজ দু’তারিখ। ক’দিনের মধ্যেই এসে যাবে বাবু।” বাড়িতে ফিরে বাজারেবাবু স্ত্রীকে বলছেন, ‘‘ওগো, বাজারে কড়াইশুঁটি উঠেছে দেখলাম। একেবারে কচি।” ভোজনরসিক বাঙালি ঋতুদের আসা-যাওয়ার খবর রাখে। তাদের সুখ হেমন্ত জুড়ে থাকে। রাস্তার বাজার, কী দেয়ালঘেরা বাজার, সর্বত্রই হেমন্তের সম্পদ। গৃহস্থের সঙ্গে সেই সব সম্পদের ভালবাসাবাসির সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। মায়ার দৃষ্টি থাকে তাঁদের চোখে। এ-ও প্রেম।
আরও পড়ুন-রাষ্ট্রসংঘে ইরানের বিরুদ্ধে ভোট দিল না ভারত
শহরের রাজপথে সকালের আলো বিছিয়ে থাকে। গলিতে গলিতে ফাঁকফোকর দিয়ে দুপুরের নরম রোদ ঢুকে পড়ে। গিজগিজে ফ্ল্যাট বাড়ির কোন এক বাড়ির বারান্দায়, কিংবা জানলার ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে সে। মানুষটা সেই আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু শিরশিরে ঠান্ডা। ও, তাহলে হেমন্ত এসে গেছে! একটু রাত করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে যুবকের মনে পড়ে মা ফোনে কালকেই তো বলেছিলেন, ‘‘বাবা, কার্তিক মাস পড়ে গেছে, হিম পড়তে লেগেছে। রাতে গায়ে একটা চাদর দিস।” ওর এখন হাঁটতে বেশ লাগছে। আরামদায়ক মৃদু ঠান্ডা তাকে জড়িয়ে রেখেছে। তার মনে প্রেম জাগে,— হেমন্ত রাগের জন্য প্রেম। আলাউদ্দিন খান সাহেব বিলাবল ঠাঁটের হেমন্ত রাগের জন্ম দিয়েছিলেন না? ও গুনগুন করতে করতে হাঁটে।
হেমন্ত এমনই। সে আসে। দুটি মাস তার অরূপবীণা বাজে। শীত ঋতুর জন্য আসনটি পেতে দিয়ে ফিরে যায়।