শিলং (shilong) পাহাড়ে রাস্তার কোনও এক বাঁকে তোমার গাড়ি কি নেমে আসার সময় আমার গাড়িতে সংঘাত হতে পারে না আবার নতুন করে? যতবার শিলং আসি ততবার নতুন করে প্রেম খুঁজে ফিরি। চলো তোমায় নিয়ে আজ শিলং পাহাড় ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে চলে যাই, আবার নতুন করে লাবণ্য হই, তুমি অমিত।
শিলং (shilong) শহর ছাড়তেই আচমকা বদলে যাবে দৃশ্যপট। মেঘালয় রাজ্যের অসামান্য সৌন্দর্য খোলতাই হবে।
রূপকথার ঘুমন্ত পুরীর মতো চারিদিক নিরালা। অলস চোখে চেয়ে থাকবে শুধু কালো পিচের রাস্তাটা। চারিদিকে পাহাড়ের চূড়াগুলো যেন কেউ করাত চালিয়ে কেটে রেখেছে। গাড়ির সংখ্যা খুব কম। হঠাৎ আসা একটা ছোট গ্রাম গতির বিপরীতে চলে যাবে নিমেষেই। রাস্তায় বড় বড় জনপদ, প্রচুর থাকার জায়গা, খাবারের দোকান এসব চোখে পড়ে না মোটেই। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা এক নীরব উপত্যকার বুকচিরে গাড়ি এগিয়ে চলবে চুরাশি কিলোমিটার দূরে ডাউকির পথে, সময় নেবে ঘণ্টা দু আড়াই।
একটা ছোট জনপদ। সামান্যই খাবার ও জলের বোতল, নরম পানীয় কিছু ফলের পশরা সাজিয়ে বসা ক’টা দোকান। রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে ঢালাই রাস্তা ধরে নিচে নেমে, কাছেই নদীর ঘাট। অনেক নৌকা। পৌনে একঘণ্টা জলবিহার, জনপ্রতি ৩০০ টাকা ভাড়া, এক নৌকায় সর্বাধিক তিন জন। লোকজন থাকলেও ভিড় নেই একটুও। জলপুলিশের সতর্ক প্রহরা। সীমা সুরক্ষা বল-দের সতর্ক পদচারণা। খাসি ও জয়ন্তীর মাঝখান দিয়ে উমঙ্গোটের চলার পথ। উমঙ্গোটের আদরের নাম ডাউকি। ডাউকির স্বচ্ছ জলে নিচে দেখা যায় নুড়ির আলপনা। উপরের নীল আর পাশের সবুজ স্বচ্ছ জলে গুলে তৈরি করে সুন্দর একটা রঙ, সেই রঙটাই মনে ছড়িয়ে পড়ে। জন্মকেজো মানুষও নিমেষে রোম্যান্টিক হয়ে ওঠে। পাশে থাকা তিরিশ বছরের পুরনো টাকঅলা সঙ্গীকেও গালে টোলপড়া শাহরুখ বলে ভ্রম হয়।
নৌকা খানিক উজান বেয়ে যাবে এক মনোরম উপল উপত্যকায়। পাড়ে নেমে জলে পা ভেজানোর চপলতা। স্নানবিলাসী মানুষের মন জলকেলি করার লোভ ছাড়তে পারবে বলে বোধ হয় না। বামদিকের দূর পাহাড়ের গলি পথ বেয়ে আসার কিশোরী উচ্ছ্বাসে একটু লাফিয়ে নেমেই নদী আবার মনোরম স্থির। জল এত স্বচ্ছ যে সামনে নৌকা পুরো প্রতিবিম্বিত হবে ছোটবেলার আঁকার মতো। সে যেন কন্বমুনির আশ্রমের মালিনী। স্বচ্ছতোয়ায় এই প্রতিবিম্ব দেখা আর জলের নিচে নুড়ি গোনাতে বেশ খানিকটা বর্তমানকে অতীত করে দিলে হুঁশ ফেরাবে মাঝির তাড়া। ফেরার পথে চোখে পড়বে জাফলং— আমার বিদেশ হয়তো বা পূর্বপুরুষের প্রাণের দেশ। সাজানো উঠোনে মরাই ফেলে রাতের আঁধারে পালানোর আগে তুলসীতলায় প্রণাম সেরে হয়তো কোনও ঠাকুমা কোনও দিদিমা আশা রেখেছিলেন কখনও ফেরার।
ডাউকি থেকে উঠে গাড়ি একটা ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে দাঁড়াবে সুশ্রী ঝর্নার সামনে। ফটো সেশনের সময় শোনা যাবে পেটের কান্না। শিলং-এর (shilong) টিফিনের কথা আজ তার অতীত স্মৃতি মাত্র। বেচারাকে জানাতে হবে অতি নিকটেই মৌলিনঙ, এশিয়ার পরিচ্ছন্নতম গ্রাম।
মউলিনং-এ রাত্রিবাস করতেই হয় নইলে কিন্তু বেড়ানোর ঠাকুর পাপ দেবেন। এখানে প্রতিটা বাড়ি মধুবালার মতো সুন্দর, দারুণ সাজানো। রাস্তাগুলো যেন পটে আঁকা ছবিটি। সন্ধ্যায় এই রাস্তা ধরেই… ‘কথা ছিল হেঁটে যাবো ছায়াপথ’। সব রোম্যান্টিকতার বর্ণনা হয় না, সব আবেগের ভাষা হয় না। আকাশের চাঁদ যখন বনেজঙ্গলে, সাজানো পথঘাটে রুপোলি জোছনা ছড়াবে তখন সেই জোছনার রঙ মেখে পাশাপাশি হাঁটার সময় দুটো শিরা ওঠা হাত পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে বারবার মনে করবে জন্মান্তরের কথা, কিংবা মাফলারটা মাথায় বেঁধে মনে করিয়ে দেবে ঠান্ডা লাগা ধাতের কথা।
আরও পড়ুন-দলীয় সাংসদের সঙ্গে বৈঠকের পরে ফের কেন্দ্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন মুখ্যমন্ত্রী
হোমস্টের আদরে রাতের আহার, আয়োজন সামান্য কিন্তু আপায়নে প্রচুর। স্বর্গীয় পরিচ্ছন্ন পরিবেশে স্বপ্নের রাত কাটবে পাখির কাকলি ভরা সোনালি ভোরে, এক ফুলবাগানে ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা হাতে। সকালের জলখাবার, দুপুরের খাবার ও সামান্য বিশ্রাম কিংবা যেমনটা পরিকল্পনা। গাড়ি চলবে নিকটেই লিভিং রুট ব্রিজের পথে। বটের ঝুড়ি নেমে শিকড় হয়ে পরমাত্মীয়ের মতো আঁকড়ে ধরেছে একে অপরকে, তৈরি করেছে নদীর উপর একটা প্রাকৃতিক ব্রিজ। চারপাশে পরিবেশ অতি সুন্দর আর বেশ নির্জন। স্থানীয় লোক দ্বারা অঞ্চলটি সংরক্ষিত এবং প্রবেশমূল্য নির্ধারিত।
গাড়ি ফিরবে স্বপ্নের শিলং (shilong) পাহাড়ে। পুলিশ বাজারে জমজমাট জায়গায় কিংবা সবুজ মাখা কোনও নির্জনে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে একদিন কাটবে মোসামাই কেভ, চেরাপুঞ্জি ঘুরতে। চেরি ব্র্যান্ডি, নানা রকম মধু, রঙিন ছাতা কিনতে হবে। ছবির মতো সাজানো শিলং শহরের প্রতিটা বাঁক যেন এক একটা প্রেমের কবিতা। কিন্তু আর কি সময় হবে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে লাবণ্যকে খোঁজার? হয়তো তখন কেতকীর তাড়া থাকবে গৌহাটি নেমে অন্যতম সতীপীঠ কামাখ্যা মন্দিরে পুজো দিয়ে, নদীর বুকে উমানন্দ ভৈরব দর্শন করার। থাকার জন্য পল্টন বাজারে হোটেল ময়ূর-এর জাস্ট কোনও বিকল্প হবে না।
কীভাবে যাবেন?
কলকাতা ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে গুয়াহাটি যাওয়ার প্রথম পছন্দ সরাইঘাট এক্সপ্রেস, কাঞ্চনজঙ্ঘাও চলতে পারে। সাধ হলে আকাশ পথেও যাওয়া যায়। গৌহাটি থেকে শিলং বাসে যাওয়া যায় তিন ঘণ্টায়। কিন্তু শিলং (shilong) ঘোরা, ডাউকি, মৌলি নং গাড়ি ভাড়া করে যাওয়াই ভাল। ডাউকি ঘুরে মৌলিনং-এ একটি রাত্রিবাস করলে তবেই সেখানটা ভাল লাগার সঠিক স্বাদ পাওয়া সম্ভব। সবটাই নির্ভর করছে ছুটি পাওয়ার উপর। শিলং-এর জন্য দুদিন বরাদ্দ রাখতেই হবে। কামাখ্যা ও উমানন্দ দর্শনের জন্য একটা গোটা দিন লাগবেই।
কোথায় থাকবেন?
গুয়াহাটিতে থাকার জন্য হোটেল ময়ূর ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারিনি এতদিনেও। স্টেশনে পল্টন বাজারের দিকে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডের উল্টো দিকে হোটেলটি। পছন্দের কারণগুলি— অবস্থান, পরিছন্নতা, অনবদ্য একটি (ভেজ) খাওয়ার জায়গা। আর লিফটের সুবিধাযুক্ত ছ’তলায় বড় ডবল বেড ঘরের ভাড়া গত মাসেও জিএসটি নিয়েও চার সংখ্যার নিচে ছিল। মৌলিনং-এ অনেক হোমস্টে। দুই শয্যা ঘরের ভাড়া দু থেকে আড়াই হাজার।
রাস্তা কিনার: ৮৫৭৫৪-৪০৪৪৬, হা লা রাইমপেই : ৯৬১৫৮-২৩৬৬০, আই লা জং : ৮৮৩৭০-৮৮১৩৪/ ৯৬১৫০-৪৩০২৭ ইত্যাদি কয়েকটি বেশ চোখে ধরল। যদিও বুকিং করে যাওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হল না।
শিলংয়ে গাদা থাকার জায়গা সাধ ও সাধ্যের মধ্যে যুগলবন্দি হলেই হল।
পুনশ্চ : গুয়াহাটিতে ভীমাশংকর মহাদেব দ্বাদশ জ্যোতিরলিঙ্গ-এর ভীমাশঙ্কর হোন বা না হোন, জায়গাটি কিন্তু দারুণ। খুবই মনোরম ও নির্জন। তাই দ্রষ্টব্য স্থানের তালিকায় থাকা আবশ্যিক।