মঞ্চ-চিত্রের বৃত্তান্ত
অনবদ্য নাট্য-সন্ধ্যা। যদিও ছিল না অভিনয়। ছিল না কোনও লিখিত সংলাপ। কী ছিল? নাটক নিয়ে গভীর আলোচনা, প্রাণখোলা নাটকের গান। উপলক্ষ নাট্য ব্যক্তিত্ব সুমন মুখোপাধ্যায়ের বই ‘মঞ্চ-চিত্রের বৃত্তান্ত’ প্রকাশ। ৩ ডিসেম্বর কলেজ স্ট্রিট বিদ্যাসাগর টাওয়ারে নিজস্ব বইঘরে এক অনবদ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল দে’জ পাবলিশিং। সুমন মুখোপাধ্যায় তো ছিলেনই। পাশাপাশি ছিলেন তাঁর পিতৃদেব বর্ষীয়ান নাট্য ব্যক্তিত্ব অরুণ মুখোপাধ্যায়। পিতা ও পুত্রের সঙ্গে কথোপকথনে ছিলেন কবি-অধ্যাপক অভীক মজুমদার।
আরও পড়ুন-মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির বদল দরকার
শুরুতেই কয়েকটি নাটকের গান শোনালেন সুমন। তাঁর সঙ্গে মাঝেমাঝেই গলা মেলালেন অরুণ মুখোপাধ্যায়। বেশিরভাগ গান তাঁর নাটকের এবং তাঁরই লেখা। বইঘরের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ছিল ঝলমলে সুর। চোখমুখ উজ্বল হয়ে উঠছিল অরুণবাবুর। হয়তো হয়ে পড়ছিলেন স্মৃতিমেদুর। মনে পড়ছিল মহড়া অথবা মঞ্চের কোনও বিশেষ মুহূর্তের কথা। তাই স্বতঃস্ফূর্ত গেয়ে উঠছিলেন।
বছরটি কয়েকটি কারণে বিশেষ। দে’জ পাবলিশিং-এর সুবর্ণজয়ন্তী। পাশাপাশি চেতনা নাট্যগোষ্ঠী এবং তাঁদের প্রযোজিত প্রথম নাটক ‘মারীচ সংবাদ’-এর ৫০ বছর। কিছুদিন আগেই সাড়ম্বরে হয়েছে উদযাপন। এই আসরেও ফিরে ফিরে এসেছে ঘটনা দুটির প্রসঙ্গ।
অভীক মজুমদার বললেন, আমরা অনেক সময় মনে রাখিনি, রাখি না, অরুণ মুখোপাধ্যায় মঞ্চের নাটকগুলোর বাইরে কিছু কিছু নাটক লিখেছেন, যেগুলো কথাসাহিত্য থেকে নেওয়া। রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ থেকে নাটক তৈরি করেছেন। সাহিত্যের ভাষাকে নিয়ে যেতেন নাটকের ভাষায়। কেন?
আরও পড়ুন-যৌনকর্মীদের মানবাধিকার
অরুণ মুখোপাধ্যায় বললেন, আমরা নাটুয়া। মঞ্চে আমাদের নাটক করার কথা। যে নাটক করতে চাই, সেই নাটক চট করে পাই না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে যেতে হয় সাহিত্যের কাছে। আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্ধ ভক্ত। বহু নাটক তৈরি করেছি তাঁর সাহিত্য থেকে। বলা ভাল তাঁকে আমি আঁকড়ে ধরেছি। মনে রাখতে হবে, মানিকবাবুর সাহিত্য থেকে নাটক নির্মাণ খুব সহজ কাজ ছিল না। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় আমি মানিকবাবুর সাহিত্যের ভাষাকে অক্ষত রাখার চেষ্টা করেছি। কারও কাছে সেই প্রয়োগ সার্থক মনে হয়েছে, কেউ কেউ সমালোচনাও করেছে। মানিকবাবুর সাহিত্য থেকে নাটক নির্মাণ আমার কাছে যুদ্ধের মতো ছিল। সেই যুদ্ধে যে সবসময় জয়ী হয়েছি, তেমনটা নয়। তবে আনন্দ পেয়েছি খুব।
‘মারীচ সংবাদ’-এর জন্মকথা শোনালেন তিনি। নাটকটি বাংলা রঙ্গালয়ে সৃষ্টি করেছে ইতিহাস। মঞ্চস্থ হয়েছে অন্য ভাষাতেও। বাদ যায়নি ‘মেরিবাবা’ গানের প্রসঙ্গও।
গান বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে অরুণ মুখোপাধ্যায়ের নাটকে। তবে সুমন মুখোপাধ্যায়ের নাটকে সেভাবে আসেনি। মৃদু অভিযোগ অভীক মজুমদারের।
আরও পড়ুন-যৌনকর্মীদের মানবাধিকার
সুমন বললেন, গানের ব্যবহার আছে আমার নাটকেও। তবে তুলনায় কম। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ নাটকেই আছে বেশ কয়েকটি গান। আসলে নাটকের মধ্যে গান আলাদা অর্থ বহন করে। ঘটাতে হয় তার সঠিক প্রয়োগ।
অন্তরঙ্গ আলোচনায় এইভাবেই উঠে এল বিবিধ প্রসঙ্গ। পিতা-পুত্রের মুখ থেকে অভীক মজুমদার বের করে আনলেন বহু অজানা কথা। এমনকিছু বিষয়, যেগুলো মঞ্চের পিছনের। স্বাভাবিক আলো থেকে বঞ্চিত। সৌভাগ্য তাঁদের, মনোরম শীত-সন্ধ্যায় যাঁরা অনুষ্ঠানের সাক্ষী থাকলেন।
আরও পড়ুন-কলেজিয়াম বৈঠকের তথ্য প্রকাশ নয় : সুপ্রিম কোর্ট
ভূতের বাগান ও কাকতাড়ুয়া
২০১৪ সালে পথচলা শুরু উত্তর কলকাতা সৃষ্টিছাড়া নাট্য দলের। গত কয়েক বছরে মঞ্চস্থ করেছে বেশ কয়েকটি মনে রাখার মতো নাটক। বিভিন্ন সময় প্রতিবন্ধকতা এসেছে। তবে কোনওকিছুই থামাতে পারেনি দলের চলার গতি।
২৬ নভেম্বর কলকাতার গিরিশ মঞ্চে মঞ্চস্থ হল দলের সাম্প্রতিকতম প্রযোজনা, রাজা সরকার রচিত ও নির্দেশিত ‘ভূতের বাগান ও কাকতাড়ুয়া’।
নাটকের কাহিনি দানা বেঁধেছে গ্রাম্য সরল সাদাসিধে মানুষদের ঘিরে। তাঁদের সারল্যের সুযোগ নিয়ে, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন রেখে নিজেদের ইচ্ছাপূরণ করেন কিছু দুষ্ট বুদ্ধির মানুষ, ব্যবহার করেন অসৎ উদ্দেশ্যে। মৃত্যুভয় দেখিয়ে তাঁদের দিয়ে দিনের পর দিন পাপ কাজ করিয়ে নেওয়া হয়।
এই হল নাটকের মূল বিষয়বস্তু। এবার আসা যাক গল্পে। ধূর্জটিপ্রসাদ নামে এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার গ্রামের পুলিশ অফিসারকে হাত করে তাঁর বন্ধু ভণ্ড সাধু ভোম্বলবাবার সাহায্যে এক বিরাট ব্যবসা ফেঁদে বসেন। সেটা মূলত বাগানের গাছ চুরির ব্যবসা। এই কাজে তাঁরা ব্যবহার করেন গ্রামের দুই সহজ সরল মানুষ বিশু এবং হাবুলকে।
আরও পড়ুন-মেসি মার্টিনেজই শেষ চারে তুলল আর্জেন্টিনাকে
বিশুকে দায়িত্ব দেওয়া হয় কাকতাড়ুয়া সেজে বাগানে দাঁড়িয়ে থাকার। হাবুলকে লাঠি হাতে বাগান পাহারা দেওয়ার। এদের দু’জনকে সামনে রেখে চলতে থাকে ধূর্জটিপ্রসাদের চোখধাঁধানো অসৎ কারবার। কিন্তু এই পাপ চাপা থাকে না। শহরের এক সুশিক্ষিত যুবতী নেহার উপদেশে সম্বিত ফিরে পায় হাবুল এবং বিশু। শুরু হয় সমাজের শাসক শ্রেণির সঙ্গে অতি দরিদ্র দিনমজুরদের এক অসম লড়াই, বেঁচে থাকার লড়াই। অবশেষে জয় হয় সত্যের।
হাবুল এবং বিশুর চরিত্রে সুমন চক্রবর্তী এবং তপন চক্রবর্তী এককথায় অসাধারণ। সমগ্র নাটক জুড়ে তাঁরা মুগ্ধ করেছেন।
অন্যান্য চরিত্রে নিবেদিতা দাস (টুসি), মিতু সাহা (ময়না) যথেষ্ট মুনশিয়ানার ছাপ রাখেন। ধূর্জটিপ্রসাদের চরিত্রে প্রণব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দারোগার চরিত্রে গোপাল সর্দার যথেষ্ট সাবলীল। ভোম্বলবাবার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন নাটকের লেখক ও পরিচালক রাজা সরকার। দক্ষ অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি চরিত্রটিকে যথাযথ রূপদান করেছেন।
এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে কনস্টেবল (মৃগাঙ্ক সরকার), টুকটুকি (মৌসুমী মণ্ডল), ভোলা (জিৎ দাস), নেহা (রুনা ঘোষ), জয় (বাসুদেব দাস) যথাযথ।
আরও পড়ুন-কোর্টে লড়াই পরাস্ত বিজেপি, মোরবিতে সাকেতের জামিন
উত্তম বিশ্বাসের আলো, ঈশান সাহার আবহ এবং প্রণব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চসজ্জা প্রশংসার দাবি রাখে। পাশাপাশি প্রশংসা করতে হয় পরিচালকের। সবমিলিয়ে একটি দৃষ্টিনন্দন সন্ধ্যার সাক্ষী ছিলেন উপস্থিত দর্শকরা। আশাকরি এই নাটক আগামী দিনে আরও অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে।