অনেক দূরের একটি ব্ল্যাক হোলের (Black Hole) খাদ্যগ্রহণের দৃশ্য বিজ্ঞানীদের ‘যন্ত্রবন্দি’ হয়েছে সম্প্রতি। আর তার পর থেকে যা সব ব্যাপারস্যাপার জানা যাচ্ছে, তাক লাগানোর পক্ষে তা যথেষ্ট!
ব্ল্যাক হোল (বাংলায় অনেক জায়গায় এখন ‘কৃষ্ণগহ্বর’ লেখা হয়ে থাকে) কী, তা আমরা এখন মোটামুটি সকলেই জানি। মহাকাশে এমন কিছু মহাজাগতিক বস্তু আছে, যারা আসলে তারাদের জীবনের কোনও এক দশা; যাদের ভর অত্যন্ত বেশি আর আকারও এমন যে ওর ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। যদি আমাদের সূর্য কোনও উপায়ে ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয় (সেটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবু কেবল অনুমান করা হচ্ছে মাত্র) তবে তার ব্যাসার্ধ হবে মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটারের মতো। ওই প্রচণ্ড ঘনত্বের জন্যেই ব্ল্যাক হোলের কাছে কোনও কিছু চলে এলে সে আর ফিরতে পারে না, এমনকী আলোও। এই জন্যেই ব্ল্যাক হোল ‘ব্ল্যাক’, ওকে দেখতে পাওয়ার কোনও উপায় নেই। তবে পরোক্ষভাবে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব টের পাওয়ার অনেক উপায় আছে, আর সেই উপায়ে বিজ্ঞানীরা অনেক ব্ল্যাক হোলেরই অবস্থান বা স্বভাবচরিত্র জানতে পেরেছেন, পারছেনও।
খেতে বসেছেন ব্ল্যাক হোল
এবার তাঁদের যন্ত্রে ধরা পড়েছে দূর মহাকাশের এক ব্ল্যাক হোলের ভোজনপর্বের দৃশ্য। সে খাচ্ছে এক অতিকায় তারাকে। তারাটি হয়তো ঘুরতে ঘুরতে ওই ব্ল্যাক হোলের খুব কাছে চলে আসে, এরপর তার আর ফেরার উপায় থাকে না। আগেই বলেছি যে ব্ল্যাক হোলের (Black Hole) খিদে প্রচণ্ড, যার কারণ ওর প্রবল মহাকর্ষীয় টান। বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের আবিষ্কার করা নিয়ম অনুসারে যে বস্তুর ভর অত্যন্ত বেশি অথচ ব্যাসার্ধ অর্থাৎ আকার খুব কম (যেমন এই ব্ল্যাক হোল) সে বস্তুর মহাকর্ষীয় টান হবে প্রবল, সে-টান এড়াতে পারবে না জাগতিক কোনও কিছুই, এমনকী আলোও। ব্ল্যাক হোলের সীমার মধ্যে তাই কোনও তারা চলে এলে ব্ল্যাক হোলের দিকে সে প্রবল গতিতে ধেয়ে যেতে শুরু করবে। এরপর ব্ল্যাক হোলটি ওই তারাটিকে খেতে শুরু করে। তারাটির দেহ প্রথমে আস্তে-আস্তে লম্বা হবে, তারপর ওই লম্বা দেহটি পাক খেতে শুরু করবে ব্ল্যাক হোলের বাইরের দিকে। চামচ দিয়ে প্লেটে রাখা নুডলসকে যেমন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তুলে নেওয়া হয়, অনেকটা সেইভাবে যেন ব্ল্যাক হোলটি তারাটিকে খেতে শুরু করবে। তখন ওর একটা দিক ক্রমে ঢুকতে শুরু করবে ব্ল্যাক হোলের অন্দরের দিকে। ব্ল্যাক হোলের একদম অন্দরে চলে গেলে ওকে দেখতে পাওয়ার কোনও উপায় থাকবে না বটে, তবে সেই পরিস্থিতির আগে, যখন ওই তারাটির লম্বা-হতে-থাকা দেহাংশ ব্ল্যাক হোলের কাছে চলে যায়, ব্ল্যাক হোলটির গা থেকে অনেক সময় এইরকম ঘটনা ঘটলে ব্ল্যাক হোলের দুই প্রান্ত থেকে প্লাজমা গ্যাস (প্লাজমা হল কঠিন-তরল-গ্যাসের বাইরে পদার্থের চতুর্থ একটি রূপ যেখানে পদার্থ হয়ে থাকে থিকথিকে জেলির মতো আর ওর মধ্যে থাকে প্রচুর আয়ন এবং ইলেকট্রন) আর নানা ধরনের বিকিরণও বেরোতে শুরু করে। শক্তিশালী এক্স-রশ্মি বা গামা-রশ্মির মতো ওই বিকিরণ এবং প্লাজমা-বস্তুই এখন ধেয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে, যাকে দেখতে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
কারা দেখছে সেই ভোজন-দৃশ্য
তারাদের এইভাবে ব্ল্যাক হোলের (Black Hole) খাদ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার ঘটনার নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন ‘টাইডাল ডিসরাপশন ইভেন্ট’ বা TDE। এখন পৃথিবীতে বসানো টেলিস্কোপ যন্ত্রে সাধারণ দৃশ্যমান আলোতেই দেখা যাচ্ছে সে বস্তুকে। যেমন ক্যালিফোর্নিয়া শহরের এক মানমন্দিরে বসানো ‘জুইকি ট্র্যানজিয়েন্ট ফ্যাসিলিটি’ (ZTF) নামে একটি টেলিস্কোপ। এই যন্ত্রেই প্রথম ধরা পড়েছিল এইরকম কিছু অস্বাভাবিক বিকিরণের চিহ্ন। এরপরে উত্তর চিলির আটাকামা মরুভূমিতে বসানো অন্য একটি টেলিস্কোপ এই ধরনের বিকিরণের সন্ধান শুরু করে। জুইকি টেলিস্কোপের কাজ সারা বছরই আকাশের দিকে ‘চোখ’ রেখে দেখে বেড়ানো— কোথায় কোনও অস্বাভাবিক অথচ স্বল্প সময় ধরে চলা ঘটনা নজরে আসছে কি না, আর সেইরকম কিছু দেখা গেলে সেটাকে আরও ভাল করে পর্যবেক্ষণ করবার জন্য চিলির টেলিস্কোপ তো আছেই। শুনলে অবাক লাগবে, ব্ল্যাক হোলের ওই খাদ্যগ্রহণের দৃশ্যের ছবি তোলার জন্য গোটা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় একুশটি টেলিস্কোপ কাজে নেমে পড়েছিল। বিভিন্ন রকমের বিকিরণকেই আলাদা-আলাদাভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে তবে সবাই মিলে এই ঘটনাকে প্রকাশ্যে আনতে পেরেছে। কাজটা, সুতরাং বোঝা যাচ্ছে মোটেই সহজ নয়।
আরও পড়ুন-যারা মানুষের জীবন নিয়ে খেলবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে
কী হারে খাচ্ছে সে?
বিজ্ঞানীরা হিসেব করে এমনও বলছেন, ওই ব্ল্যাক হোলটি প্রকাণ্ড তারাটিকে এখনও খেয়ে চলেছে, আর ওর দেহ থেকে বেরিয়ে আসা বস্তু-পদার্থ প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে; কত গতি? শুনলে অবাক লাগবে, আলোর গতির প্রায় ৯৯.৯৯ শতাংশ! আর ব্ল্যাক হোলটি কতটা করে খাচ্ছে সেটাও বিস্ময়কর— আমাদের সূর্যের যা ভর, তার প্রায় অর্ধেকটা করে নাকি ও খেয়ে নিচ্ছে প্রতি বছর! ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, যদি ব্ল্যাক হোলটা কোনওভাবে আমাদের পৃথিবীর কাছে চলে আসে, কী হবে? আমাদের সূর্যকে তো ও দু-বছরের মধ্যেই খেয়ে হজম করে ফেলবে!
তবে বিজ্ঞানীরা এখন এটা জেনে খুশি যে তাঁরা ব্ল্যাক হোলটি খেতে শুরু করার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সে খবর পেয়ে গিয়েছেন। মানে এখনও বহুদিন ধরে ওর খাওয়া চলবে, আর তাঁরাও এখানে বসে সে ভোজনপর্বের সাক্ষী হতে পারবেন।
আরও একটা ভাল ব্যাপার, অনেক দূরে ঘটে চলা এই ধরনের ঘটনাকে এতদিন বিজ্ঞানীরা দেখতে পেতেন এক্স বা গামা-রশ্মির মতো শক্তিশালী আলোক তরঙ্গের সাহায্যে। সাধারণ আলোর তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য এই দুই ধরনের আলোর চেয়ে অনেক কম, তাই এর শক্তিও অনেক কম। এবারে তাঁরা এই ঘটনাকে দেখছেন সাধারণ আলোতেই, যার অর্থ, ব্ল্যাক হোলের শরীর থেকে এবারে বিকিরণ নির্গমনের পরিমাণও অনেক বেশি। আগামী দিনে ব্ল্যাক হোলটির খাদ্যগ্রহণের সময়কালীন ঘটতে থাকা আরও চমকপ্রদ সব ব্যাপার নজরে আসবে তাঁদের, এই ভেবে এখন বিজ্ঞানীরা উল্লসিত।