মৃত্যুঞ্জয় পাল আগরতলা: ত্রিপুরার এনসিসি থানায় তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে ঠিক কী ঘটেছিল? পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদই বা হল কেমন?
খোয়াই থানা সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার মিথ্যা অভিযোগে মামলা করে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ ছ’জনের বিরুদ্ধে। ত্রিপুরা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয় তৃণমূল। হাইকোর্ট বলে, এবিষয়ে এখন চার্জশিট দিতে পারবে না পুলিশ। তা সত্ত্বেও পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিশ পাঠিয়ে বলে, দশ দিনের মধ্যে আসতে হবে।
কুণাল ঘোষ চারদিনের মাথায় সোমবার আগরতলা এসে যান। মঙ্গলবার তাঁর খোয়াই থানায় যাবার কথা। কিন্তু সোমবারই পুলিশ বলে দেয় খোয়াইয়ের বদলে আগরতলা এনসিসি থানায় আসতে।
আরও পড়ুন-
সোমবার দলীয় কাজে রাত অবধি সক্রিয় ছিলেন কুণাল। মঙ্গলবার সকাল থেকে হঠাৎ তাঁর শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। তাঁকে হাসপাতালে যেতে বলেন সহকর্মীরা। কুণাল বলেন, ‘‘আগে থানায় যাব। না হলে অপপ্রচার হবে নোটিশ এড়াতে আমি হাসপাতালে গিয়েছি।’’
প্রায় জোর করেই থানায় যান কুণাল। তখন তাঁর শরীর টানছে না। খোয়াইয়ের তদন্তকারী অফিসার সত্যজিৎ মল্লিক বসেছিলেন ওসির ঘরেই।
জেরার কোনও ভিডিও রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করেনি পুলিশ।
আইও সত্যজিৎ মল্লিক প্রথমে কেন মামলা করা হয়েছে তা বলেন কুণালকে। তারপর বলেন, ‘‘হয়ে গেছে। এটাই জানানোর ছিল। আপনি এসেছেন। হয়ে গেছে।’’
কুণাল: সে কী! আপনি তো মামলার কথা বললেন। এবার আমার বক্তব্য শুনতে হবে তো।
আইও: বলতে চাইলে বলুন।
কুণাল: অভিষেক এবং আমরা পাঁচজন কখনওই সেদিন কোনও সরকারি কাজে বাধা দিইনি। মিথ্যা অভিযোগ করেছেন ওসি।
আমাদের কর্মীরা মার খায়। তাদের পুলিশ খোয়াই নিয়ে আসে। তারপর তেলিয়ামুড়া থানার কেস দেয় এখানে। খবর পেয়ে আমাদের নেতা এবং আমরা ছুটে আসি। পুলিশকর্তাদের সঙ্গে কথা বলি। জামিনযোগ্য ধারার মামলা, তাই থানা থেকে ছাড়া যায় কি না দেখতে বলি। আর আমাদের আইনজীবী আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলি। এসডিপিও, এএসপি ছিলেন। আপনাদের এএসপি রাজীব সেনগুপ্ত না কী নাম যেন, জিজ্ঞেস করুন, উনি যখন ডেকে বলেন কোর্টে সব রেডি, আমাদের আইনজীবীরাও পৌঁছে গিয়েছেন, ধৃতদের থানা থেকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা সঙ্গে যাই। কোনও বাধা হয়নি। এই ভিডিওটা দেখুন। এটা গ্রহণ করুন।
আইও: না, আমি ভিডিও নেব না। আমাদের থানার ভিতরের ভিডিও আছে। আপনাদের লইয়ার আপনাদেরটা কোর্টে দেবেন।
কুণাল: এটা কোনও কথা হতে পারে না। আপনি তদন্তকারী অফিসার। আপনি কেন আমার পুরো বক্তব্য এবং তথ্যপ্রমাণ নেবেন না?
আইও: আমি ওই সিডি নেব না। আপনি যে বলছেন ওদের কোর্টে নিয়ে যেতে বাধা দেননি, তাহলে অত সময় লাগল কেন? আপনি থানায় ঢুকেছেন ১১:১০ মিনিটে। অভিষেকবাবু ঢুকেছেন ১২:০৫ মিনিটে। অথচ বন্দিরা কোর্টে গেল দুপুর আড়াইটেতে, এত দেরি করে। আপনারা তো বাধা দিচ্ছিলেন।
আরও পড়ুন-
কুণাল: বাজে কথা। গ্রেফতার হলে যে কোর্টে যেতে হয়, সেটা আমরা জানি। কেন বাধা দেব? আমরা বলেছিলাম এই ধারায় থানা থেকে বন্ডে ছাড়া সম্ভব কি না। আর বলেছিলাম আইনজীবী আসার সুযোগ দিন। একজন কলকাতা থেকে আসছেন। একজন আগরতলা থেকে। আলোচনাই তো চলছিল। যখন আইনজীবীরা খোয়াই পৌঁছলেন, আমরা ওঁদের সঙ্গেই কোর্টে গেলাম। বলুন তো, তেলিয়ামুড়ার থানা কেস খোয়াইতে এল কী করে? কেন পুলিশ ওদের ভুল বুঝিয়ে আটকে রাখল? কেন থানা থেকে জামিন দেওয়া যাচ্ছে না, এসব আলোচনা করা কি অন্যায়? তাছাড়া ওরা জখম ছিল।
আইও: তেলিয়ামুড়া থানার কেসে ছাড়া গেলেও আমবাসা থানার জামিন অযোগ্য ধারা ছিল ওদের।
কুণাল: যদি থাকেও, তাহলেই বা কী? এভাবে শোওন অ্যারেস্ট হতে পারে না। আইন নেই। একটা থানা অন্য থানার স্বার্থে ছাড়ব না বলতে পারে না। খোয়াই তার ধারা অনুযায়ী ছাড়বে। অন্যথায় পুলিশের চক্রান্ত প্রমাণ হয়। একটি থানা কোর্টে দিলে, সেই খবর পেলে বা বন্দিত্বে থাকলে, তখনই অন্য থানা শোওন অ্যারেস্ট প্রেয়ার দিতে পারে। আমরা এগুলোই তো পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। আর বাইরে বিজেপি তাণ্ডব করছিল। এটাকে আমাদের বিরুদ্ধে কাজে বাধার অভিযোগ বলে চালিয়ে দেওয়া হল। যাই হোক, আপনি আমার বয়ান লিখছেন না কেন? আমি তো বলেই যাচ্ছি। স্টেটমেন্ট করতে চাইছি।
আইও: লেখার কিছু নেই। সব স্মৃতিতে রাখব।
কুণাল: স্মৃতিতে রাখবেন মানে?
আইও: আপনার হয়ে গিয়েছে। আপনি যেতে পারেন।
কুণাল: বুঝলাম। তাহলে আমায় যে নোটিশ পাঠিয়েছেন তাতে লিখে দিন আমি আইন মেনে সাড়া দিয়েছি।
আইও: ওটা লাগবে না।
কুণাল: অবশ্যই লাগবে। লিখে দিন।
এরপর এনসিসি থানার অফিসারও আইওকে বলেন লিখে দিতে।
আইও নোটিশের পিছনেই লিখে দেন কুণাল নোটিশ মেনে এসেছেন, তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন এবং অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ঠিক এই লেখাটাই যেন শেষ হওয়ার অপেক্ষা ছিল। আর শরীর ধরে রাখতে পারেননি কুণাল। আইও যখন লেখা কাগজটি এগিয়ে দিচ্ছেন কুণালের দিকে, তখনই শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারান কুণাল। পরপর কয়েকবার বমি করেন। এলিয়ে পড়ে শরীর। ততক্ষণে ওসির ঘরে ঢুকেছেন সুবল ভৌমিক, প্রকাশ দাস-সহ নেতৃবৃন্দ। পুলিশ অফিসাররাও তাঁর মাথায় জল দেন। প্রাথমিক ধাক্কা কাটলে কুণালকে নিকটবর্তী আইএলএস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
বুধবার কুণাল একটু স্থিতিশীল। স্যালাইন চলছে। হল্টার মনিটরিং চলছে। আচ্ছন্ন ভাব কমেছে। তবে দুর্বলতা প্রবল। অন্য কিছু পরীক্ষাও চলছে। শীর্ষনেতৃত্ব খোঁজ রাখছেন। ডাঃ শান্তনু সেন এবং অন্যরা হাসপাতালে যান। সব ঠিক থাকলে আজ, বৃহস্পতিবার তাঁকে কলকাতায় ফেরানো হবে।