‘তুহিন… তুহিন…
তুমি তোমার পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে গেলে কেন—’
‘— এই তো আমি আবার এসে গেছি, আমি কি কোনও কাজ অসমাপ্ত রেখেই চলে গেছি?’
‘একদম, ম্যাম বলেছেন আজকের মধ্যেই নিবন্ধটি লিখে জমা দিতে, এখন দুপুর ১২.৩০ মিনিট, তোমার কাজটি সত্বর করে ফেলা উচিত।’
‘— আজ্ঞে, আমি এখনই লেখা শুরু করব, এক গ্লাস জল খেয়ে আসি।’
‘— বেশ বন্ধু, তাড়াতাড়ি ফিরে এসে পড়তে বসো—’
আপনারা একটু অবাকই হচ্ছেন, তাই না— ভাবছেন আমি আবার কার সঙ্গে কথা বলছি! ও আসলে আমার পড়ার টেবিলের সঙ্গে সেট করা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও চালাক একটি যন্ত্র, বলতে পারেন আমার বন্ধু যে আমার পড়াশোনা ও খেলাধুলা-বিষয়ক সবটার তদারকি ও তদবির দুটোই করে। ওর বৈজ্ঞানিক নাম ‘চ্যাটবট’, এটি হল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (Artificial intelligence) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রসূত একধরনের উন্নত বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন কথা বলতে পারে এমন একটি যন্ত্র, যা বর্তমান সময়ে শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে অনবদ্য পরিবর্তনসাধন করেছে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (Artificial intelligence) কী?
আসলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হল সেই বিজ্ঞান বা যন্ত্রবিদ্যা যা নানা সব উন্নততর প্রযুক্তি মারফত কোনও একটি যন্ত্রের মধ্যে তথ্য-বিজ্ঞানের সহায়তায় তথ্যের গ্রহণ, শোষণ ও আত্মীকরণের মধ্য দিয়ে যন্ত্রটিকে মানুষের মতো চিন্তা করতে, শিখতে, তথ্যের বিশ্লেষণ করতে, সমস্যার সমাধান করতে ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত করে তোলে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দৌলতেই যন্ত্র একপ্রকার মানুষের মতো বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে, যা আধুনিক প্রযুক্তি-বিশ্বের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
উন্নয়নের হাতিয়ার
প্রাচুর্যের দুনিয়ায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আজ গ্রাম থেকে শহর, পাড়া থেকে পাঠশালা, ভূস্বর্গ থেকে ভূলোক, রেস্তোরাঁ থেকে রসায়নাগার, ম্যানেজমেন্ট থেকে ইন্দিরা পয়েন্ট, হাসপাতাল থেকে বীজতলা, সেলুন থেকে বেলুন, সেলুলয়েড থেকে স্যাটেলাইট, ক্লাসরুম থেকে গ্রিনরুম, রাজনীতি থেকে কূটনীতি, অর্থনীতি থেকে সমাজনীতি— সর্বত্রই নিজের প্রভাব বিস্তার করেছে রমরমিয়ে। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্বের বহু চালিকা শক্তির গঠনগত ও গুণগত আমূল পরিবর্তন সাধনে সক্ষম। স্বাস্থ্য, চাষবাস, জলবায়ু, নগরোন্নয়ন, মহাকাশ, পরিকাঠামো, পরিগমন, পরিবহণ ও শিক্ষার ক্ষেত্রে অকৃত্রিম উন্নয়ন ডেকে এনেছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
সস্তা, সুলভ, বহুমুখী
এই দীর্ঘ অতিমারি আবহে আমরা সকলেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি যে কীভাবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (Artificial intelligence) আমাদের সকলকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নিবিড়ভাবে সাহায্য করে চলেছে। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, সেই শিক্ষা দেওয়া-নেওয়া ব্যবস্থাপনাটির দৃঢ় এবং দ্রুত উন্নতিসাধনে একনিষ্ঠ এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। শিক্ষা-ব্যবস্থাকে আরও বেশি সহজসাধ্য, সময়-উপযোগী, দক্ষ ও ফলপ্রসূ করে তুলতে আবিষ্কৃত হয়েছে বহুসংখ্যক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রয়োগ-প্রযুক্তি। খুব সহজেই একজন শিক্ষক তাঁর ঘরে বসে বহুসংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে তাঁদের ঘরে ঘরে একই সময়ে সঠিক শিক্ষা পৌঁছে দিতে পারেন শুধুমাত্র এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দৌলতেই। এই বিজ্ঞান পুরো শিক্ষাব্যবস্থাটিকেই স্বয়ংক্রিয় করে দিতে সক্ষম; একটি নির্দিষ্ট নির্দেশাবলি সমন্বিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক কম্পিউটার ঘরে বসেই সমস্ত ছাত্রছাত্রীর মূল্যায়ন করে দিতে পারে মুহূর্তের মধ্যে, একদম সঠিকভাবে— দূরদূরান্ত থেকে হচ্ছে আলাপচারিতা। দূরশিক্ষণ আজ হাতের মুঠোয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আজ শিক্ষাকে করে তুলেছে সস্তা, সুলভ, সুদক্ষ ও বহুমুখী।
আরও পড়ুন-শুভ নববর্ষ লেখা ড্রোন দিয়ে ইউক্রেনে দেদার হামলা রাশিয়ার
শিক্ষাক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল
এখানে প্রথমেই যে স্মার্ট যন্ত্রটির কথা বলতে হয় সেটি হল ‘চ্যাটবট’। এটি একটি প্রতিক্রিয়াশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগান্তকারী ফসল— তথ্য-বিজ্ঞানের হাত ধরে নির্দিষ্ট নির্দেশাবলির সিস্টেম এই বিশেষ প্রয়োগ-প্রযুক্তি। বিজ্ঞানের এই বিশেষ প্রয়োগ ছাত্র-শিক্ষক উভয়কেই দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। একজন ছাত্রকে অনলাইন পড়ানো, তার নিবেশ, তার সহায়তা, শিক্ষকের মতামত, প্রশাসনিক সহযোগ, অগ্রিম সমঝোতা, মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ, তথ্যসংগ্রহ এবং সর্বোপরি ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক স্থিতির খেয়াল রাখা— সবটাই এই ‘চ্যাটবট’ দক্ষতার সঙ্গে সমাধান করে। শিক্ষাকে এক নতুন আঙ্গিকে দেখতে শেখাল এই বিশেষ প্রযুক্তি।
২০১৯ সালের একটি সমীক্ষা বলছে, ২০২৬ সালের মধ্যে গোটা বিশ্বে অনলাইন শিক্ষার যৌগিক বার্ষিক বৃদ্ধির হার প্রায় ৯.১ শতাংশেরও বেশি, তবে এ-কথা জোর দিয়ে বলা যায় অতিমারির কারণে এই সংখ্যাটি হয়তো আরও বেড়ে যাবে আগামী দিনে। শুধুমাত্র শিক্ষা দেওয়া-নেওয়া নয়, কোনও বিশেষ উচ্চস্তরের পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রেও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যাপক সাহায্য করে দূরবর্তী পরীক্ষা-পরিচালক যন্ত্রের হাত ধরে। এই বিশেষ প্রযুক্তি দূর থেকেই পরীক্ষাকেন্দ্রের সকল ছাত্রছাত্রীর নড়াচড়া, কার্যকলাপ ও এমনকী মুখভঙ্গি দেখে পুরো প্রক্রিয়াটির তত্ত্বাবধান করে প্রায় নিখুঁত ভাবে।
‘এআই’ বুক
তবে একথা মাথায় রাখতে হবে যে, পৃথিবীর সব কিছুতেই কিছু সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতা থাকেই, এক্ষেত্রেও আছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সবসময় এই সভ্যতার ভাল করে এসেছে, তাই আমাদের উচিত ধনাত্মক দিক দিয়ে ভাবা। সম্প্রতি ভারতের মুম্বইয়ের ‘দ্য ফ্লুইড এআই’ নামে একটি কোম্পানির হাতে ধরে প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বের প্রথম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দ্বারা লিখিত ১০২ পাতার একটি বই ‘ব্রিজিং দ্য এআই গ্যাপ’। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি একটি অভূতপূর্ব প্রাপ্তি। এই বইটি লিখতে ওই নির্দিষ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মোট তিনদিন সময় লেগেছে এবং মোট ১ লক্ষ ২ হাজার লাইন ‘কোড’ বা তথ্য-বিজ্ঞানের প্রয়োগ করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি যুগান্তকারী বিজ্ঞান যা আগামী দিনে নতুন পথের দিশারি হয়ে দেখা দিয়েছে আমাদের জীবনে। ‘বিজনেস টুডে’র একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ শিক্ষণ-ব্যবস্থাপনা যন্ত্রপাতিই হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক এবং ২০২৫ সালের মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যৌগিক বার্ষিক বৃদ্ধির হার গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৪০.৩ শতাংশ। এ-কথা বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে আগামী দিনে শিক্ষার ভবিষ্যৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।