“আমাদের জীবনে বিদ্যসাগরের স্মৃতি, বিদ্যাসাগরের আদর্শ যেন চিরদিন উজ্জ্বল হইয়া থাকে, তবেই আমাদের জাতীয় মঙ্গল হইবে। এই মহাপুরুষ যে কত বড় ছিলেন, তিনি নিজের কাজ দিয়া যে কত বিরাট, কত বিচিত্র একটা দৃষ্টান্ত আমাদের দেশের সন্মুখে রাখিয়া গিয়াছেন তাহা তাঁহার নানা কীর্তিগুলি একত্র করিয়া দেখিলে তবে কতকটা বুঝা যায়। … ঈশ্বরচন্দ্রকে আমরা সংস্কৃত পণ্ডিত বলিয়া জানি, দয়ার সাগর বলিয়া জানি, তিনি বাংলা সাহিত্যে ও ভাষায় নূতন যুগ, নূতন ধরণ আনিয়াছেন বলিয়া জানি, হিন্দু-সমাজ সংস্কার করিয়াছেন বলিয়া জানি। কিন্তু তাঁহার প্রতিভা এইসব গুণগুলির সমষ্টির চেয়েও অনেক বড় ছিল। তাঁহার অতুলনীয় মহত্ত্ব ছিল তাঁহার মনের গঠনে ও চরিত্রের বলে।”
এই দীর্ঘ উদ্ধৃতিটি অন্য কারও নয়। এ হল একজন প্রথিতযশা ঐতিহাসিকের বিদ্যাসগর সম্পর্কে মূল্যায়ন। সেই ইতিহাসবিদের নাম আচার্য যদুনাথ সরকার। ‘দয়ার সাগর বিদ্যাসাগরের অতুলনীয় দান’ বিষয়ে লিখতে বসে তাঁর এই সুচিন্তিত মন্তব্য।
বিদ্যাসাগরের মানসিক গঠন ও চারিত্রিক শক্তি অনুধাবনের প্রণোদনায় নীচে তাঁর জীবন-কাণ্ড থেকে টেনে নেওয়া কতগুলো পাতা।
বিষয়গুলো হয়ত অজ্ঞাত নয়, তবে বহুচর্চিতও নয়।
অনালোকিত, অনালোচিত সেইসব প্রহরে আলো ফেলে দেখা, ২০১তম জন্মবার্ষিকীতে অন্যরকম রেনেসাঁ–পুরুষের খোঁজে।
নীলচাষ ও বিদ্যাসাগর
বিদ্যাসাগর তখন কলেজের ছাত্র। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল ব্যাপারটা। তারপর তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষক হলেন। ততদিনে ব্যাপারটা জমে উঠেছে। বাংলা জুড়ে নীল চাষ। ইংল্যান্ডে বস্ত্র শিল্পের রমরমা। সেখানে নীলের চাহিদা তুঙ্গে। তাই, ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখার দায় নিয়ে মরাটাই বাংলার চাষিদের অনিবার্য পরিণতি হয়ে দাঁড়াল। ভারত থেকে ইউরোপে যেত বলেই গ্রিকরা এই জিনিসটার নাম দিয়েছিল ‘ইন্ডিকন’, মানে ‘ভারত থেকে আগত বস্তু’। সেখান থেকেই উৎপত্তি নীলের ইংরেজি শব্দের, ‘ইন্ডিগো’। সেই ‘ইন্ডিগো’ রপ্তানি করে ফুলে ফেঁপে উঠলেন কোম্পানির সাহেবরা।
ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে এনিয়ে সরব হলেন লেয়ার্ড সাহেব। বললেন, নীলকর সাহেবরা অসহায় কৃষকদের জমি দখল করছে, তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করছে, বাগানের গাছ উপড়িয়ে ফেলছে। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেই হয় মেরে ফেলা হচ্ছে নয় কয়েদ করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে একটা উদ্দাম অরাজকতার ছবি। কোনও সভ্য দেশে এমনটা হয় না বলেও মন্তব্য করলেন তিনি।
এসবের জেরে শুরু হল নীল বিদ্রোহ। লেখা হল ‘নীলদর্পণ’ নাটক। তার সংলাপে রইল বিদ্যাসাগরের ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’র উল্লেখ, ‘ছোট বউ বসিস, আমি আসচি, বিদ্যাসাগরের বেতাল শুনব।’ নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ার সময় খলচরিত্র উড সাহেবের ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। তাঁর অভিনয় দেখতে দেখতে আত্মবিস্মৃত বিদ্যাসাগর মঞ্চে জুতো ছুঁড়ে মারলেন। হল জুড়ে শোরগোল পড়ে গেল।
‘হিন্দু প্যাট্রিয়টে’র পাতা তখন কৃষকের আসল চিত্র তুলে ধরত দেশবাসীর সামনে। সারা দেশ বুঝতে পারল, নীলকরদের অত্যাচার কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। বাঙালি গান বাঁধল, ‘নীল বানরে সোনার বাংলা করল এবার ছারখার’। কিন্তু ‘অকালেতে হরিশ মলো’। হরিশ মানে হরিশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়টে’র দুঁদে সম্পাদক। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৭ বছর। হরিশের মৃত্যুর পর ‘হিন্দু প্যাট্রিয়টে’র ছাপাখানা বিক্রি কয়ে দেওয়া ছাড়া হরিশচন্দ্রের পরিবারের আর কোনও উপায় ছিল না। হরিশের মা শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের। বিদ্যাসাগর গিয়ে ধরলেন কালীপ্রসন্ন সিংহকে। তিনি পাঁচ হাজার টাকায় প্রেস আর কাগজের সত্ত্ব, দুটোই কিনে নিলেন। অনশনে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেল হরিশচন্দ্রের পরিবার।
রাজনীতি ও বিদ্যাসাগর
এসবের বছর পাঁচেক পরের কথা। সদ্য গঠিত হয়েছে জাতীয় কংগ্রেস। ১৮৮৬-র ডিসেম্বর। কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন কলকাতায়। সভাপতি দাদাভাই নৌরজি। এ সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের প্রতিক্রিয়া একেবারে চাঁচাছোলা। “বাবুরা কংগ্রেস করছেন, আস্ফালন করছেন, বক্তৃতা করছেন, ভারত উদ্ধার করছেন। দেশের হাজার হাজার লোক অনাহারে প্রতিদিন মরছে, সেদিকে কারও চোখ নেই। রাজনীতি নিয়ে কী হবে? যে দেশের লোক দলে দলে না খেতে পেয়ে প্রত্যহ মরে যাচ্ছে, সেদেশে আবার রাজনীতি কী?”
এসব কথা বিদ্যসাগরের মুখে মানায়। কারণ, ঠিক এর আগের বছরেই দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল বাংলা জুড়ে। বক্তৃতাবাজিতে সময় নষ্ট করেননি। গভর্নমেন্টের কাছে দাবি সনদ পেশ করার জন্য অপেক্ষা করেননি। নিজের উদ্যোগে বীরসিংহ গ্রামে অন্নসত্র খুলেছিলেন। সে সংবাদ পেয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া, বিদ্যাসাগরের দয়ার মধ্যে যে ‘বলিষ্ঠ মনুষ্যত্ব’ ফুটে ওঠে সেটা দেখে বাঙালি জাতির প্রতি ‘চিরাভ্যস্ত ঘৃণাপ্রবণ মনও আপন নিগূঢ় মানবধর্মবশত ভক্তিতে আকৃষ্ট না হয়ে পারে না’।
কলকাতা অধিবেশনের সময় কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা এলেন। বিদ্যাসাগরকে আমন্ত্রণ জানালেন অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য। তিনি সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন, দেশের স্বাধীনতা পেতে গেলে যদি শেষ পর্যন্ত তরবারি ধরার দরকার পড়ে, তবে তাঁরা কি তাতে রাজি আছেন? আমন্ত্রণকারীদের চোখে মুখে বিড়ম্বনার ছাপ ফুটে উঠল। বিদ্যাসাগর বলে দিলেন, “তবে আমাকে বাদ দিয়েই তোমরা এই কাজে এগোও।”
কংগ্রেসের আগে তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সভা। একবার সেই সভার প্রতিনিধিরা সরকারের কাছে দাবিদাওয়া নিয়ে গিয়ে রীতিমত অপমানিত হয়েছিলেন। বিমর্ষ মুখে তাঁরা বসে আছেন। তাঁদের দেখে এসে বিদ্যাসাগর বলে উঠলেন, ‘ওহে, আজকে পলিটিকাল ওয়ার্ল্ডে যে বড়ই গ্লুম দেখে এলাম।’ কমলকৃষ্ণ ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, এই gloom (গ্লুম) কথাটা বলার সময় বিদ্যাসাগর এমন মুখভঙ্গি করলেন যে শ্রোতার দল হেসে কুটোপাটি।
ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সভা জমিদারদের। তাঁরা তো আর কৃষকের কষ্ট নিয়ে ভাবিত হবেন না। তাঁরা তো আর চাষির দুরবস্থার কথা সরকারের কানে পৌঁছে দেবে না। চাষিকেই স্বতন্ত্র স্বার্থগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের কথা তুলে ধরতে হবে। কিচ্ছু করার নেই। তাই দরকার কৃষক সভার। ১২৮০ বঙ্গাব্দের ৩০ অগ্রহায়ণ সংখ্যায় ‘সাধারণী’ পত্রিকা জানাল, “প্রসিদ্ধনামা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহোদয় এইরূপ একটি সভা করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছেন।” ২৪ ভাদ্র সংখ্যার ‘সোমপ্রকাশে’ও সে খবরের প্রতিধ্বনি। “বর্তমান ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এবং হিন্দু প্যাট্রিয়ট জমিদারদিগের পক্ষে যেরূপ কার্য করিতেছেন যদি কৃষকদিগের পক্ষে সেরূপ কোনও উপায় থাকিত তাহা হইলে আজি অনেক অত্যাচার প্রকাশ হইয়া পড়িত ও তাহার নিরসন হইত তাহার সন্দেহ নাই।” সোমপ্রকাশের এ সংক্রান্ত বক্তব্যের আলাদা গুরুত্ব আছে। কারণ, এ কাগজ স্বয়ং বিদ্যাসাগরের সৃষ্টি। দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর এই উদ্যোগ। এই কাগজ স্থাপনের পেছনে যে রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা ছিল, সেকথা লিখে গিয়েছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। “বিদ্যাসাগর মহাশয় দেখিলেন যদি কোনও কাগজে ইংরেজির মতো রাজনীতি চর্চা করা যায়, তাহা হইলে ্বাংলা খবরের কাগজের চেহারা ফেরে। তাই তাঁহারা কয়েকজন মিলিয়া ‘সোমপ্রকাশ’ বাহির করিলেন; সোমবার কাগজ বাহির হইত বলিয়া নাম হইল ‘সোমপ্রকাশ’।”
মনে রাখতে হবে, তত দিনে নীলচাষ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তা নিয়ে মাতামাতির প্রশ্ন তাই নেই। কিন্তু হুজুগের বাইরে এসেও বিদ্যাসাগর সিরিয়াসলি ভাবছেন কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার কথা। কারণ, তিনি অন্তরের অন্তস্তলে টের পাচ্ছেন ‘শ্রমজীবী ও কৃষকশ্রেণির উন্নতি না হইলে সমাজের প্রকৃত উন্নতি হইবে না’। এ একেবারে পাক্কা রাজনীতিকের চিন্তা। অথবা সমাজসচেতন এক বিদ্বজনের স্ফটিক স্বচ্ছ্ব উপলব্ধি।
এরকম চিন্তাভাবনা থেকেই একবার ভেবেছিলেন বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশান গড়ার কথা। একেবারে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মতপ্রকাশের প্ল্যাটফর্ম হবে সেটা। ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ধনীদের সভা, তাহার সভ্য হওয়া মধ্যবিত্ত মানুষের কর্ম নয়’, অথচ মধ্যবিত্তের সংখ্যা ও প্রতিপত্তি, দুই-ই বাড়ছে। তাই, ‘তাহাদের উপযুক্ত একটি রাজনৈতিক সভা থাকা আবশ্যক’। এরকম ভাবনা থেকেই বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশান গড়ার সিদ্ধান্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ভাবনার বাস্তব রূপ দিতে পারেননি। লোকবল ছাড়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কাজে আসে না, এই উপলব্ধি থেকেই বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশান গড়ার পথে এগোননি। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘আ নেশন ইন মেকিং’ গ্রন্থে বিষয়টির স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন। “পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং জাস্টিস দ্বারকানাথ মিত্র মধ্যশ্রেণির মত প্রকাশের মঞ্চ হিসেবে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, এমনকি এর নাম ভেবে রেখেছিলেন ‘বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশান’। কিন্তু যথেষ্টরকম সাড়া না পাওয়ায় তাঁরা এ কাজে বিরত হন।”
এরপর এল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান গড়ার প্রহর। উদ্যোক্তা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমোহন বসু বিদ্যাসাগরকে এই নতুন সংগঠনের সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব দেন। বিদ্যাসাগর জানতে চাইলেন, এই উদ্যগের অংশীদার কারা? বাকিদের নামে কোনও আপত্তি ছিল না। অমৃতবাজার পত্রিকার শিশির কুমার ঘোষের নাম উঠতেই শিবনাথ শাস্ত্রীকে মুখের ওপর বলে দিলেন, “যা, তবে তোদের সকল চেষ্টা পণ্ড হয়ে যাবে। এঁদের এর ভিতর নিলে কেন?” এর পর শারীরিক অবস্থার দোহাই দিয়ে সংগঠনের সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব এড়িয়ে যান।
বিদ্যাসাগর যে খুব একটা ভুল বলেননি, পরবর্তী ঘটনাক্রমই তার প্রমাণ। শিশির কুমার ঘোষ, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান গড়ার পথে বাগড়া দিতে ছাড়েননি। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান গড়ে ওঠার আগেই তাঁরা ইন্ডিয়ান লিগ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল ‘লিগ’ থাকতে আবার ‘অ্যাসোসিয়েশান’ কেন। আনন্দমোহনের অনুমতির অপেক্ষা না করেই তাঁরা তাঁকে লিগের সদস্য বানিয়ে দেন। পরে আনন্দমোহন টের পান, তিনি যে কাজ সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন, লিগে থেকে সে কাজ করা যাবে না। তিনি লিগ ছেড়ে অ্যাসোসিয়েশানে প্রথম সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।
ছাত্র ধর্মঘট ও বিদ্যাসাগর
সন ১৮৬২। মেডিক্যাল কলেজে তখন বাংলায় ডাক্তারি পড়ানোর কোর্স ছিল। তিন বছরের কোর্স। কলেজের অধ্যক্ষ তখন রিভার্স সাহেব। তিনি ওই ক্লাসের এক ছাত্রের নামে মিথ্যে চুরির অপবাদ দিলেন। শুধু তাই নয়, ছাত্রটিকে পুলিশ ডেকে জেলে ঢুকিয়ে দিলেন। প্রতিবাদে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর নেতৃত্বে ছাত্ররা ক্লাস বয়কট করে। গোলদিঘিতে তখন রোজ তাঁদের প্রতিবাদ সভা। মুখ্য বক্তা অবশ্যই বিজয়কৃষ্ণ।
সর্বত্র একটা হইচই পরে গেল। কলেজ কর্তৃপক্ষের অনড় মনোভাবে ছাত্রদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বিজয়কৃষ্ণ ছাত্রদের নিয়ে ছুটলেন বিদ্যসাগরের কাছে। প্রথমে বিদ্যসাগর তাঁদের কথায় কান দিতে চাননি। ‘যাও, যাও, আমি ওসব কিছু শুনতে চাই না। ছেলেরা অনেক সময় মিছামিছি ওরূপ অনেক গোল করে।’ শুনেই প্রতিবাদ করলেন বিজয়কৃষ্ণ। বললেন, ‘আপনি আমাদের কোনও কথা না শুনেই একটা স্থির কর নিচ্ছেন কেন? আমাদের দুটা কথা শুনে, পরে যা ইচ্ছা বলুন। বাংলা বিভাগে যাঁরা পড়েন, তাঁদের কি একটা বংশ বা জাতির মর্যাদা নেই? ইঁহারা সকলেই কি ইতর, ছোটলোক, চোর, বদমায়েশ; আপনিও একথা বলেন?’
এর পর পুরো ঘটনা মন দিয়ে শুনলেন বিদ্যাসাগর। ছোটলাট বিডন সাহেবকে সব জানালেন। লিখিতভাবে। ছোটলাট তদন্তের আদেশ দিলেন। তদন্তে দেখা গেল গোলমাল পাকিয়েছেন অধ্যক্ষ রিভার্সই। সাহেবকে ক্ষমা চাইতে হল।
বিদ্যাসাগরের বাঙালিয়ানা
বহু ব্যাপারে বিদ্যসাগরের ইংরেজিয়ানা প্রশ্নাতীত। যেমন, চেয়ারে বসার ব্যাপারে। যোগেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি কথায় তেমনই একটি প্রসঙ্গ। তাঁদের বাড়িতে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন বিদ্যসাগর। বসার জন্য বৈঠকখানায় ঢালা বিছানা পাতা, দুটো তাকিয়াও রাখা ছিল। বিদ্যাসাগর ঘরে ঢুকেই বললেন, ‘ আমি কি বিয়ে করতে এসেছি যে আমার জন্য বরাসন পেতে রেখেছ? তাকিয়া কী হবে? আমি তো কখনও হেলান দিয়ে বসি না।”
কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য লিখে গিয়েছেন, ‘বিদ্যাসাগর বরাবর চেয়ারে বসিতেন।’ অথচ, কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে কিংবা সুরেন্দ্রনাথ পার্কে তাঁর যে মূর্তি আছে, সেগুলোতে তিনি আসনপিঁড়ি হয়ে বসে আছেন।
দেখতে মোটেই স্মার্ট ছিলেন না। যদুনাথ সরকার লিখছেন, ইয়ং বেঙ্গলের দল তাঁকে রাস্তায় দেখলে ওড়িয়া বেহারার থেকে আলাদা কিছু ভাবত না। কিন্তু এমন মানুষটির স্মার্টনেস ছিল চিন্তা ভাবনায়।
বিদ্যাসাগর আসার আগে শিক্ষার জগতে প্রচলিত ধারণা ছিল, “আবৃত্তিঃ সর্ব শাস্ত্রাণাম বোধাদপি গরীয়সী।” বিদ্যাসাগর সেই ধ্যানধারনায় আমূল পরিবরতন আনলেন। ছাঁকা মুখস্থ করার কাজটা শিক্ষার বিরোধী। তাই মুখস্থ নয়, ছাত্রেরা যাতে পড়াটা বুঝতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য চালু করেলেন বাংলায় সংস্কৃত ব্যাকরণ পড়ান। প্রাচীনপন্থীরা ক্ষেপে লাল। প্রাকৃত অর্বাচীন ভাষার সাহায্যে দেবভাষার শিক্ষা, ব্যাপারটাতে তাঁদের ভীষণ আপত্তি। বিদ্যাসাগর এক্সপেরিমেন্টের জন্য বেছে নিলেন রাজকৃষ্ণ মুখপাধ্যায়কে। বাংলায় সংস্কৃত ব্যকরণের উপক্রমণিকা লিখে দিলেন। তিন মাসের মধ্যে রাজকৃষ্ণ রপ্ত করে ফেললেন সংস্কৃত ভাষার গঠন প্রণালী। সংস্কৃত কাব্য পড়তে বুঝতে কোনও অসুবিধা হত না তাঁর। পণ্ডিতের দল হতবাক।
তা বলে গোঁড়া প্রাদেশিকতাকে প্রশয় দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না বিদ্যাসাগর। কোনও ব্যাপারেই গোঁড়ামি ছিল তাঁর না-পসন্দ। তাই মহারাষ্ট্রের মতো অন্য প্রদেশ থেকে কালিদাস, ভবভূতির কাব্য আনিয়ে সেগুলো ছাপাবার, অনুবাদ করার ব্যবস্থা করেন। কারণ, তিনি জানতেন ও মানতেন তুর্কি বিজয়ের সুবাদে বাংলায় সংরক্ষিত অনেক সংস্কৃত পুঁথির আদি-বিশুদ্ধ রূপ রক্ষিত হয়নি। অন্য প্রদেশে তা হয়েছে। এ ব্যাপারে তাঁর কোনও রকম উন্নাসিকভাব ছিল না। বাংলা নিয়ে ছিল না কোনও না অহেতুক আদিখ্যেতা।
এইসব খণ্ডচিত্রের কোলাজেও সমগ্র বিদ্যাসাগর ধরা পড়েও ধরা পড়েন না, এটা যেমন সত্যি, তেমনই এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে এসবের মধ্যেই তিনি হারিয়েও হারিয়ে যান না।