বাংলা ভাষার খ্যাতনামা কবি শ্যামলকান্তি দাশ। স্বতন্ত্র তাঁর উচ্চারণ। শুরু থেকেই তৈরি করেছেন আশ্চর্য কাব্যভাষা। কয়েকটি পঙ্ক্তি পড়লে সহজেই চিনে নেওয়া যায়। তাঁর বিভিন্ন কবিতায় ফুটে উঠেছে গ্রাম জীবনের সহজ-সরল ছবি। মেঠো প্রকৃতি, চেনা-অচেনা পশুপাখি, পোকামাকড়, উপেক্ষা, অনাদর, অভিমান সমস্তকিছুই জায়গা করে নিয়েছে। অক্ষরের ধূসর শরীরে লেগে রয়েছে সোঁদা মাটির গন্ধ। অবহেলিত লাজুক গ্রামীণ শব্দ মিশে রয়েছে ছত্রে ছত্রে। প্রয়োজনে ছক ভেঙেছেন। স্বভাবকালো গ্রাম জীবনের বাইরের ছবিও ধরা পড়েছে তাঁর অসংখ্য লেখায়। চেনা জগতের পাশাপাশি মাঝেমধ্যেই নিয়ে যান অচেনা আলোকালো জগতে। সেই জগতের প্রকৃত সন্ধান পেতে খুলতে হয় ভাবনার দ্বার। শাণিত করতে হয় মেধা।
আরও পড়ুন-ছাঁটাইয়ের কোপে উইপ্রো কর্মীরাও
এই কবি এক প্রাণবন্ত মানুষ। দুহাতে লিখে চলেছেন। বড়দের এবং ছোটদের জন্য। পাশাপাশি লেখান অন্যদের। তরুণ প্রজন্মের কবিদের কাছে পরম আশ্রয়। বনস্পতির ছায়া। নানা সময় সম্পাদনা করেছেন একাধিক পত্রিকা। বর্তমানে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছে ‘নতুন কবিসম্মেলন’। যে পত্রিকা গত এক যুগে বদলে দিয়েছে বাংলা কবিতার গতিপথ।
২০২২-এ ‘ছোঁয়া’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে সাতের দশকের বিশিষ্ট এই কবির ‘কবিতা সংগ্রহ’। মোট ১৫টি কাব্যগ্রন্থ স্থান পেয়েছে ৪৫৫ পৃষ্ঠার এই সংকলনে। সেগুলি হল ‘কাগজকুচি’, ‘প্রেমের কবিতা’, ‘ভূতের চরণে’, ‘আমাদের কবিজন্ম’, ‘লালরঙের স্বর্গ’, ‘সরল কবিতা’, ‘ছোট শহরের হাওয়া’, ‘ভালবেসেছিলাম’, ‘দূর থেকে লিখি’, ‘বইখাতা’, ‘খড়ের মানুষ’, ‘বোকা মেয়ের জন্য’, ‘শত্রুরা বাড়ি নেই’, ‘যায় চলে দিন’, ‘রাক্ষস’।
ছন্দে তিনি অনন্য। পাশাপাশি লেখেন টানা গদ্যেও। দুই ধরনের কবিতায় তাঁর বিপুল পারদর্শিতা। পাতায় পাতায় বৈচিত্র্য। প্রেম এসেছে তাঁর কবিতায়। নীরবে। করেছেন প্রতিবাদ। সে-ও নিজের মতো করেই। খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করেন, গভীরে গিয়ে ভাবেন, শেষমেশ প্রকাশ। তাঁর প্রকাশভঙ্গির মধ্যে দেখা যায় না উচ্চস্বরের অকারণ উপস্থিতি।
আরও পড়ুন-নিউজিল্যান্ডের নয়া প্রধানমন্ত্রী ক্রিস হিপকিন্স
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কাগজকুচি’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৭-এ। কবিতা সংগ্রহে জায়গা হয়েছে কয়েকটি কবিতার। প্রথম কবিতা ‘সাবান’। তিন স্তবকের ছোট্ট কবিতা। দ্বিতীয় স্তবকে তিনি লিখেছেন ‘দু-পায়ে মেঘ, মেঘের কানকাটা/ কীভাবে যাবে ঘরের পথে ভাবো—/ দু-পাশে বন, বাঘের নজরানা/ কীভাবে যাবে ঘরের পথে ভাবো!’ বাঘের উপস্থিতি তাঁর কবিতায় এসেছে নানা সময়। আলোচ্য কবিতাটিতে ছড়িয়ে রয়েছে থমথমে পরিবেশ। তিনি এক মস্ত জাদুকর, ‘মেঘের কানকাটা’র আশ্চর্য প্রয়োগে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেন। এই মেঘ সর্বশক্তিমান। যদিও আর্তের ক্রন্দনরোল শুনতে অপারগ। চতুর সাবান থাকে ধরা-অধরার মধ্যিখানে। কবিতাটি বহুমুখী। গভীরে নিয়ে যায়, ভাবায়।
যাওয়া যাক আরও কয়েকটি কবিতায়। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত ‘প্রেমের কবিতা’র লেখাগুলো পড়লে বোঝা যায়, হরণ বা অর্জন নয়, মুঠি আলগার মধ্যে দিয়েই জিতে নিতে চান ভালোবাসা। বিরহের মধ্যেও তুমুল আনন্দ। সেই আনন্দের সরোবরে ডুবসাঁতার দিতে চান কবি। বেশিরভাগ কবিতা সেই ইঙ্গিত বহন করে। গানের প্রসঙ্গ ফিরে এসেছে বিভিন্ন কবিতায়। তবে কবিতাগুলো সুরহীন। ‘এখনো তুমি’ কবিতার চারটি পঙ্ক্তি : ‘গানের মতো তোমার ছায়া পড়ে/ ফুলের ফাঁকে ফুলের আড়াআড়ি/ আমার কোনো গভীর কথা নেই/ ছড়িয়ে দিয়ো জলের গড়িমসি।’ এই ‘গভীর কথা নেই’ এক বেদনাঘন উচ্চারণ। ছায়াময় মন নিয়ে প্রেমিক হেঁটে যায় ইচ্ছা-অনিচ্ছার আলপথ ধরে। কিছু কবিতা নিছক প্রেমের নয়, হয়ে উঠেছে আরও বেশি কিছু।
আরও পড়ুন-বিজেপির মিথ্যাচার ক্ষুব্ধ মালিওয়াল
চাঁদকে ভূতের সঙ্গে তুলনা করেছেন কবি। এমন উপমা বাংলা সাহিত্যে বিরল। ‘ভূতের চরণে’ গ্রন্থের ‘শূন্য ঘরে’ কবিতায় ছোট্ট অংশ : ‘উচ্ছেগাছে কাঁপছে ফিঙে/ ধানের মাঠে বৃষ্টি পড়ে,/ ভূতের মতো চাঁদ উঠেছে/ জনমানবশূন্য ঘরে।’ পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ভূত। মনের অন্ধকারে ঘাপটি মারা নয়, এই ভূত আলোকিত।
১৯৯১-এ প্রকাশিত হয়েছে ‘আমাদের কবিজন্ম’। এই বই কবিকে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল। আজও বহু আলোচনায় বইটির প্রসঙ্গ ওঠে। ভূত এবং বাঘের মতো চাঁদ বারবার ফিরে এসেছে নানা কবিতায়। ‘আমাদের কবিজন্ম’ কবিতায় প্রতিবন্ধী চাঁদের কাহিনি শুনিয়েছেন। শুরুটা এইরকম ‘যে ছিল চাঁদের মতো, চাঁদ তাকে অক্ষত রাখেনি।’ আঘাতের সিংহভাগ আসে সমগোত্রীয়র কাছ থেকেই। চাঁদকে বিদ্ধ করে চাঁদ, কবিকে কবি। এক নির্মম সত্য উচ্চারিত হয়েছে। হতাশা নয়, আঘাতের চিহ্ন এবং বেদনা লেগে রয়েছে অক্ষরশরীরে। এই বইয়ের কবিতাগুলিতে দেখা যায় গল্প বলার প্রবণতা। ঘটেছে বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার মিলন। কথার পিঠে সরল কথা সাজাতে সাজাতে চলে যান গভীরে এবং মেলে দেন ‘ওই শিরশিরে লোভে বিষ, বিষে মৃত্যু, সশস্ত্র বিপ্লব’-এর মতো তোলপাড় করা পংক্তি। ‘বাঘ’ কবিতার এই পঙ্ক্তির মধ্যে ঘটেছে চিরকালীন হিংসার প্রকাশ। মিল-ছন্দের উজ্জ্বলতা দেখা যায় কয়েকটি কবিতায়। ‘এ-ভাবেই’ কবিতায় তিনি লেখেন : ‘এ-ভাবেই হোক না হাঁটা/ ক্রোশ দুই পথ তো মোটে/ এ-গাঁয়ের ভিন্ন ধারা/ বিকেলে টগর ফোটে।’ চিরকাল ভিন্ন ধারায় হেঁটেছেন কবি। এইভাবেই। অবলীলায় বলে যান পাতার আড়ালে থাকা মামদো মানুষ, কালো-কঠিন লোকের কথা।
আরও পড়ুন-ঋষির জরিমানা
‘লাল রঙের স্বর্গ’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। এই বইয়ের বিভিন্ন কবিতায় চোখে পড়ে চমকে দেওয়ার মতো পঙ্ক্তি। ‘এখানে’ কবিতাটির শেষ স্তবক ‘এখানে ভূত ভূতের চেয়ে ফাঁকি/ আবছা জল, জলের কাছে হাঁটে/ এখানে চুপ, একটি কথা নয়/ কাগজ ভাঙে, কাগজ ভেঙে পড়ে!’ কিছুটা সান্ধ্যভাষার আশ্রয় নিয়েছেন কবি। বলেছেন ভঙ্গুর সমাজ ও সভ্যতার কথা। ‘কাগজ ভাঙে, কাগজ ভেঙে পড়ে’র মধ্যে দিয়ে যেন সভ্যতার পতনকেই চিহ্নিত করা হয়েছে।
১৯৯৫ সালে প্রকাশিত ‘সরল কবিতা’। প্রতিটি কবিতা চার পঙ্ক্তির। আশ্রয় নিয়েছেন ছন্দ-মিলের। সরল, তবে তরল নয়। মিশেছে নানা বিষয়। ‘ভাত’ কবিতায় চোখ রাখা যাক : ‘একখানা তেলকালো মুখ/ ধোঁয়াওঠা খসখসে হাত/ মরা পেটে জ্বালালে আগুন/ ও আমার দুধসাদা ভাত!’ চরম অপ্রাপ্তির কবিতা। তেলকালো মুখটি যেন কোনো এক আটপৌরে মায়ের।
আরও পড়ুন-নিয়ন্ত্রণরেখা এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করছে চিন, ধরা পড়ল উপগ্রহ চিত্রে
‘ছোট শহরের হাওয়া’ প্রকাশিত হয়েছে একই বছর। নানা স্বাদের কবিতা। এই গ্রন্থের ‘বেড়াল’ কবিতায় কবি চেনান স্বার্থপর সমাজকে। বেড়াল যেন আমাদেরই কেউ। কবি লেখেন ‘ল্যাজা খাবে, মুড়ো খাবে, কাঁটাকুটি খাবে/ উথলানো দুধের কড়াই—/ চেটেপুটে হঠাৎ বেড়াল হয়ে যাবে/ পথের বেড়াল হয়ে যাবে।’ পাশাপাশি মিলমাত্রায় লেখা ‘বাঘভালুক’ এক ভীষণ কবিতা। ‘সোনারুপোর দিন, দিনে মানুষ যায় গোনা/ যতই মুখঝামটা দাও মালা/ বাঘভালুক চেনাতে পারব না’। পাঠকদের নাড়িয়ে দিয়ে যায়।
কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ পেরিয়ে যাওয়া যাক ‘রাক্ষস’-এ। প্রকাশকাল ২০০৩। বাঘ, চাঁদ, গানের মতো রাক্ষস নিয়ে অসংখ্য কবিতার জন্ম দিয়েছেন কবি। দুই পঙ্ক্তির ‘সংগ্রহ’ কবিতায় তাঁর উচ্চারণ ‘রাক্ষস জমিয়ে আমি একদিন সাংঘাতিক বড়লোক হব/ মেঘে রৌদ্রে ঘুরে ঘুরে সারাদিন রাক্ষস জমাই।’ পঙ্ক্তি দুটি মুখে মুখে ফেরার মতো। আরও একটি ভীষণ কবিতা ‘বাবার বন্ধু’। শুরুতে তিনি লেখেন : ‘রাক্ষস আমাদের বাবার বন্ধু। অনেকদিনের পুরনো/ সেই বন্ধুতা প্রতিদিন ঘষে মেজে/ বাবা নতুন করে তোলেন।’ কবিতার শরীর বেয়ে আরও কিছু দূর গেলে, আবছা নীলরঙের আলোর মধ্যে দিয়ে অনেক গল্পগাছা উড়ে আসতে দেখা যায়। কিছু ধরা পড়ে, কিছু গলে যায় আঙুলের ফাঁক দিয়ে। রাক্ষস যেন বিবেক।
সবমিলিয়ে এই ‘কবিতা সংগ্রহ’ পাঠ এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। অসংখ্য কবিতার মধ্যে আলোচনা করা গেল সামান্যই। বাইরে থেকে গেল সিংহভাগ। সেটা তোলা রইল আগ্রহী পাঠকদের জন্য।
আরও পড়ুন-মোদি জমানায় কলঙ্কিত ক্রীড়াক্ষেত্র
অক্ষরের পাশে অক্ষর সাজান শ্যামলকান্তি দাশ। ভাঙেন, ছেঁড়েন, যা ইচ্ছে তাই করেন। এইভাবেই গড়ে তুলেছেন আপন কবিতা-সাম্রাজ্য। দীক্ষিত পাঠক বাধ্য হন তাঁকে স্বীকার করতে, তাঁর রঙে রঙিন হয়ে উঠতে।