২০২৩-’২৪ সালের বাজেট যখন পেশ করা হচ্ছে, তখন তার প্রেক্ষাপটে ছিল চড়া বেকারত্বের হার ও চাহিদা হ্রাসের ফলে আর্থিক বৃদ্ধির হারের শ্লথগতি। শিল্পক্ষেত্রের এই গতিহীনতা হঠাৎ করে ঘটেনি। গত এক দশক ধরেই শিল্প ক্রমে গতি হারিয়েছে। অতিমারির ধাক্কায় সেই সমস্যা তীব্রতর হয়েছে মাত্র। সামগ্রিক ভাবে লাভজনক ও অর্থপূর্ণ কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকা এবং আয় হ্রাস পাওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও সঙ্কুচিত হয়েছে। তার ফলে, ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে শ্লথতর হারে। এর ফলে আবার ধাক্কা লেগেছে আর্থিক বৃদ্ধির হারে এবং কর্মসংস্থানের উপর।
আরও পড়ুন-আমেরিকাতেও নিষিদ্ধ
এবারের বাজেটে যাঁদের লাভ হওয়ার কথা তাঁদেরই লাভ হল। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কোনও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নেই বাজেটে। নেই অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা বাড়ানোর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। দেশে যখন অসাম্যের বিকট বাড়বৃদ্ধি তখন সেই অসাম্য মোচনের সাংবিধানিক দায় পালনে ব্যর্থ এবারের বাজেট।
আরও পড়ুন-২২ গজকে মিস করছেন ঋষভ
অসাম্যের রূপটা কেমন? অক্সফ্যাম ইন্টারন্যাশনালের পেশ করা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ২০১২-’২১ সালে ভারতে যত সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে, তার ৪০% রয়েছে ধনীতম ১% মানুষের হাতে। অন্যদিকে, দরিদ্রতম ৫০% মানুষের ভাগে পড়েছে মাত্র ৩%। অথচ এই দরিদ্রতম ৫০% মানুষ জিএসটি বাবদ সরকারকে যে কর দেন, তা ধনীতম ১০ শতাংশের করদানের প্রায় ৬ গুণ। এই যখন অবস্থা, তখন দেশজোড়া কর্মসংস্থানের ভয়ঙ্কর সংকট দূর করতে বাজেট প্রায় উল্টোদিকে হেঁটেছে। ধনীতমদের আয়করের উপর সারচার্জের হার ৪৩% থেকে কমে ৩৯%। জনসংখ্যার দিকে থেকে তাঁরা খুবই কম। আজ যখন এক বিরাট সংখ্যক দেশবাসী দারিদ্রের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত তখন তাঁরা কী পেলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দুরবস্থার কথা ভাবলে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রমীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনের আওতায় থাকা ১০০ দিনের কাজে ব্যয়বরাদ্দ ৩০,০০০ কোটি টাকা (৩৩%) কমাতে পারত না সরকার। খাদ্যে ভরতুকি কমেছে ৩১%। যা টাকার মূল্যে ৯০ হাজার কোটি টাকা। সারে ভরতুকি কমেছে ২২ শতাংশ। রান্নার গ্যাসে ৭৫ শতাংশ। অনেক বড় বড় কথা বলা হলেও আত্মনির্ভর ভারত রোজগার যোজনার বরাদ্দ ৬৫% কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। শ্রমজীবীদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন কেন্দ্রীয় স্কিম বা প্রকল্পের ব্যয়বরাদ্দও প্রায় অর্ধেক করা হয়েছে। কাটছাঁট করা হয়েছে পেনশন ফান্ডেও।
আরও পড়ুন-স্নুকারে বিশ্বসেরা ভারত
ক্ষুধা তালিকায় লজ্জাজনক অবস্থানে থাকা অপুষ্টিতে ২০১৪ সালের ১৪.৮ থেকে ২০২২ সালে ১৬.৩–এ পোঁছেও খাদ্যের উপর ভরতুকি ৩১% কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষুধা নিরসনে সরকারি ভাবনা যে কতটা দুর্বল, তা বাজেট দেখলেই বোঝা যায়। ভাবলে অবাক লাগে, যখন দেখা যায়, মিড-ডে মিলের বরাদ্দ ৯.৪% এবং এ সংক্রান্ত পুষ্টিভিত্তিক ভরতুকি ৩৮% কমানো হয়েছে। বারবার প্রশ্ন ওঠে, এ সরকার কাদের সরকার। কৃষক সংগঠনগুলিকে দেওয়া সরকারের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের প্রতিশ্রুতিকে কার্যকর করার পরিবর্তে ন্যাশনাল ফুড সিকিউরিটি অ্যাক্টের অধীনে খাদ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ১৭% বরাদ্দ কমানো হয়েছে। খাদ্য নিগমকে দেওয়া ভকতুকিও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার ফলস্বরূপ নিঃসন্দেহে গণবণ্টন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা, প্রধানমন্ত্রী কিসান সিঁচাই যোজনা, প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনাতেও বরাদ্দ ছাঁটাই হয়েছে। পেট্রোলিয়াম ভরতুকি ৬৯০০ কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মান নিধিতে কোনও বৃদ্ধি ঘটেনি। সবদিক থেকে গরিব-মারা বাজেট।
আরও পড়ুন-জমাদারদের জন্য কেন্দ্র কী করেছে, জানতে চাইল সুপ্রিম কোর্ট
২০২২-’২৩ অর্থবর্ষের সংশোধিত অনুমানে দেখা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন রাজ্যের জন্য অর্থ কমিশনের বরাদ্দের পরিমাণ ২০২১-’২২ অর্থবর্ষের প্রকৃত ব্যয়ের তুলনায় এ-বছর বহুলাংশে কমেছে। বর্তমান বাজেটেও সেই বরাদ্দ কমল ৪২,০০০ কোটি টাকা। এখন সামাজিক ক্ষেত্রে মানব উন্নয়ন সংক্রান্ত ব্যয়ের বেশির ভাগটাই রাজ্য সরকারের দায়িত্ব। রাজ্যের বরাদ্দ কাটছাঁট হলে স্বভাবতই রাজ্যগুলির পক্ষে এই ব্যয় নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে উন্নয়নখাতে খরচ কমবে। কো-অপারেটিভ ফেডারেলইজম-এর অপার মহিমা।
আরও পড়ুন-কাশ্মীরি পণ্ডিত সঞ্জয়ের খুনিকে খতম করল যৌথবাহিনী
২০২২-’২৩ অর্থবর্ষের সংশোধিত হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এই অর্থবর্ষে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ বাজেট বরাদ্দের চেয়ে যথাক্রমে ৪৪০০ কোটি টাকা ও ৯২৫০ কোটি টাকা কম। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে খরচ কমালে দেশের উন্নয়নে যে বাধা পড়বে সে-কথা বাজেট তৈরির সময় একবারও মনে পড়ল না? যেদিকে দেখা যাক, সবদিকেই এই বাজেট মানুষের কথা ভেবে তৈরি হয়নি। জনস্বাস্থ্যবাহী প্রতিটি ক্ষেত্রেই অবহেলিত হয়েছে। এক কথায় মানুষকে বোকা বানানোর এই বাজেট জনবিরোধী এবং প্রকৃত অর্থেই নির্দষ্ট মুষ্টিমেয় ধনপতিদের স্বার্থরক্ষায় রচিত।
আরও পড়ুন-রাজ্যপাল অধিবেশন বন্ধ রাখতে পারেন না : সুপ্রিম কোর্ট
এই বাজেটের কোনও দিশা নেই সেকথা পুরোপুরি ঠিক নয়। কারণ এবারের বাজেটের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বেশ পরিষ্কার। যে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য মাথায় রেখে বাজেট রচিত হয়েছে, তা হল, জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব ঘাটতির হার কমানো। যাকে বলা হচ্ছে বিচক্ষণ আর্থিক নীতি। আসলে জিডিপির অনুপাতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ বাজেটে কমে গেছে। এবার জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ খানিক বাড়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ব্যয়-বরাদ্দের পরিমাণ কাটছাঁট করা হল জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব ঘাটতি ও রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্যই। এই নীতিগত অভিমুখটি নব্য-ধ্রুপদী অর্থনৈতিক দর্শনের অনুসারী। ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় এই অভিমুখটি একেবারেই মানানসই নয়। এতে লগ্নির পরিমাণ কমে। তাতে কর্মসংস্থান কমে। আয়বৃদ্ধির হারেও ভাটা পড়ে। অর্থাৎ আমাদের অবস্থায় যা প্রয়োজন এতে তার উল্টোটাই ঘটে।
আরও পড়ুন-মহিলারাই ঠিক করবেন সাগরদিঘি কার
যেমন অতি-ধনীদের জন্য কর কমিয়ে দেওয়ায় দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কোনও লাভ হল না। মধ্যবিত্তদের আয়করের সুবিধা আসলে একটা ধোঁকা মাত্র। এই বাজেটে দেশের বেকার জনগোষ্ঠী, দরিদ্র ও বিপন্ন মানুষ, শ্রমিক ও কৃষকদের অবস্থার কোনও উন্নতি ঘটবে না। এই বাজেট কাদের দিকে ঝুঁকে, তা নিয়ে কোনও সংশয়ের অবকাশ নেই। সব মিলিয়ে দেশের ১০-১৫ শতাংশ মানুষকে খুশি করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উপর যে আক্রমণ নামানো হল, বাজেটের সেই চরিত্রটিকে প্রকাশ করাই বড় কাজ। অসাম্য-দরিদ্র-ক্ষুধা-তাড়িত ভারতের মানুষের বাজেট কবে করবে কেন্দ্রীয় সরকার! বরাদ্দের অভাব কথা দিয়ে ঢাকার এই কু-অভ্যাস দূর হবে কবে!