প্রতিবেদন : প্রথম তাঁকে কে এই অভিধায় ভূষিত করল?১৯৪৬ ঘেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর বিশেষ সহকারী ছিলেন এম ও মাথাই। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য এরকম : “অনেকের বিশ্বাস যে নেহরুই প্রথম গান্ধীজিকে ‘জাতির জনক’ আখ্যা দেন। এ-ধারণা ভুল। সরোজিনী নাইডু প্রথম এই আখ্যা দিয়েছিলেন। নতুন দিল্লিতে এশিয়ান রিলেশনস কনফারেন্সের (২৮ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল,১৯৪৭) বক্তৃতামঞ্চের দিকে গট গট করে যখন হেঁটে গেলেন গান্ধীজি, তখন, সেই মুহূর্তে সভাপতি সরোজিনী নাইডু তাঁর কর্তৃত্বব্যঞ্জক স্বরে ঘোষণা করলেন, ‘দ্য ফাদার অফ দ্য নেশন’।” কেমন ছিলেন এই জাতির পিতা তাঁর ব্যক্তিগত পরিসরে? জনচক্ষুর আড়ালে? পতি কিংবা পিতা হিসেবে, কেমন ছিল তাঁর ভূমিকা?
২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩।কস্তুরবা গান্ধীর নিথর শরীরটা ধরে আছেন মোহনদাস। ষাট বছরেরও বেশি সময়ের বৈবাহিক জীবনের শেষে কস্তুরবা মোহনদাসকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন সেই চিরঘুমের দেশে, যেখান থেকে কেউ কোনও দিন ফেরে না। গত বছরেও এমন একটা দিনের কথা ভাবেননি বাপু।
১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে উত্তাল দেশ। গান্ধীজি কারান্তরালে। পুণের কাছে আগা খান প্যালেসে। ৯ অগাস্ট পর্যন্ত ব্রিটিশ পুলিশ কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতাদের ধরপাকড়ে ব্যস্ত ছিল। গান্ধীপত্নী কস্তুরবাকে ধরেনি তারা। কিন্তু কস্তুরবা স্বামীর গ্রেফতারির বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেবেন বিক্ষোভ সমাবেশে, এ খবর কানে যেতেই সুশীলা নায়ারের সঙ্গে গ্রেফতার করা হল কস্তুরবাকেও। নিয়ে আসা হল ওই আগা খান প্যালেসেই। স্বামীর মুখোমুখি হতেই অভিমানে ফেটে পড়লেন কস্তুরবা।
“তোমাকে পই পই করে বলেছিলাম না, সর্বশক্তিমান সরকার বাহাদুরের সঙ্গে পাঙ্গা নিতে যেও না? কথাটা শুনলে না। এখন ফল ভুগতে হবে আমাদের সব্বাইকে।” সুশীলা নায়ারের লেখা ‘কস্তুরবা : ওয়াইফ অফ গান্ধী’ (১৯৪৮) গ্রন্থের ৩৬ নং পৃষ্ঠায় জাতির জনকের পত্নীর স্বামীকে এরকম ধমকদানের বর্ণনা আছে। সেবারই আর একটা কাণ্ড বাধিয়েছিলেন কস্তুরবা। সে আখ্যানও বর্ণিত উল্লিখিত গ্রন্থের ৪৪ পৃষ্ঠায়। স্বামী তখন স্ত্রীকে ভারতের ইতিহাস, ভূগোল পড়াচ্ছেন ওই আগা খান প্যালেসেই, বন্দিদশাতেই। একদিন পড়ানোর সময় কস্তুরবা জিজ্ঞেস করে বসলেন, “আচ্ছা! তুমি কেন ইংরেজদের ভারত ছাড়তে বলছ? এত্ত বড় দেশ আমাদের, আমরা সবাই মিলেই তো এখানে থাকতে পারি। ওরা যদি চায়, দাওনা গো ওদের থাকতে। তবে হ্যাঁ, ওদের বলে দিও, থাকতে গেলে কিন্তু আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করলে চলবে না, আমাদের ভাই হয়ে থাকতে হবে।” সেই সরলপ্রাণা কস্তুরবা ছেড়ে চলে গিয়েছেন মোহনদাসকে। গিয়েছেন ভগবানের কাছে। মোহনদাসও তো তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সেবার। এক্কেবারে ভগবানের ভরসায়।
আরও পড়ুন : লক্ষ্য রেকর্ড মার্জিন, গান্ধী জয়ন্তী থেকেই খড়দহে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব
চলে এসেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। স্ত্রী-পুত্রদের দায়িত্ব দাদা লক্ষ্মীদাসের কাঁধে ফেলে দিয়ে। প্রথম দিকে টাকা পাঠাতেন ওদের দেখভাল করার জন্য। সেবার ঠিক করলেন, দেশে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেবেন। চিঠি পাঠালেন দাদাকে। লক্ষ্মীদাসকে ‘শ্রদ্ধেয় মহাশয়’ বলে সম্বোধন করে সাফ জানিয়ে দিলেন, তাঁর পক্ষে আর টাকাপয়সা পাঠানো সম্ভব নয়। যা রোজগার করেছেন তা এতদিন ধরে তাঁকে পাঠিয়েছেন। এবার থেকে যা রোজগার করবেন তা সমাজসেবায় ব্যয় করবেন। লক্ষ্মীদাস যেন তাঁর কাছ থেকে আর কিছু প্রত্যাশা না করেন। দাদা লক্ষ্মীদাস মোহনদাসের ব্যরিস্টারি পড়ার খরচ জুগিয়েছেন এতদিন ধরে। মোহনদাস যখন আইন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হননি, তখন তাঁর সংসার চালিয়েছেন। এখন ভাইয়ের এই চিঠি তিনি হজম করতে পারলেন না। তাঁর স্পষ্ট কথা, পরিবার প্রতিপালনের পবিত্র দায়িত্ব এড়াতে পারেন না মোহনদাস। গান্ধী জবাবি চিঠিতে লিখলেন, সমগ্র সমাজই তাঁর পরিবার। মা-ভাইকে ছেড়ে আসার সময় যিশুখ্রিস্টও ঠিক এই উত্তর দিয়েছিলেন। বাইবেলের ম্যাথু ১২ঃ৪৬-৫০-এ এর উল্লেখ আছে। গান্ধী অবশ্য তাঁর পত্রে বাইবেলের প্রসঙ্গ টানেননি। তবে জানিয়েছেন, মুহূর্তের দুর্বলতায় স্ত্রী-পুত্রের কথা ভেবে জীবনবিমা করেছিলেন। এখন বুঝতে পারছেন, তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে-বউ বিমার টাকা পেলে আর খেটে খাওয়ার কথা ভাববে না। ফলে, তারা আত্মনির্ভর হবে না কোনও দিন। সুতরাং বিমায় যে টাকা তিনি বিনিয়োগ করেছিলেন, সেটাও তুলে নিয়েছেন। ভগবান তো আছেনই। তিনিই ওদের দেখবেন। লক্ষ্মীদাস রেগে কাঁই। তবে, বড় ভাইয়ের দায়িত্ব পালনে পিছিয়ে আসেননি।
আর মোহনদাস পরিবারের দায় ঘাড় থেকে নামিয়ে মুক্তপুরুষ। তবে কস্তুরবাকে দেওয়া কথা রাখতে ভোলেননি।
দক্ষিণ আফ্রিকায় আসার আগে কস্তুরবাকে কথা দিয়েছিলেন, এক বছরের মধ্যে তিনি নিজে তাঁর কাছে দেশে ফিরে আসবেন নয় দেশ থেকে তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন। তাই ১৯০৪-এর গোড়ার দিকেই ভারত থেকে কস্তুরবাকে নিয়ে এলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। নিজের কাছে। সঙ্গে তিন পুত্র। মনিলাল, রামদাস আর দেবদাস।
হরিলালকে আনেননি। রাগে। লক্ষ্মীদাস, হরিলালের জ্যাঠা হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তার বিয়ের পাকা ব্যবস্থা করেছেন আগের বছরই, জানুয়ারি ১৯০৩-এ। গান্ধীদের পারিবারিক বন্ধু এক আইনজীবীর কন্যা পাত্রী। হরিলালের বয়স তখন সবে চোদ্দো। পাত্রী গুলাব ভোরা মোটে এগারো। লক্ষ্মীদাসের ইচ্ছে ছিল বিয়েটা সেরে ফেলার। মোহনদাসের তীব্র আপত্তি টের পেয়ে ঘুরপথ নিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, বিয়ে হবে তখন, যখন ছেলের বয়স ১৮ বছর হবে। সেই বিয়ে হল কস্তুরবা আর বাকি তিন ছেলের দক্ষিণ আফ্রিকা আসার দু’বছর পর। লক্ষ্মী ঘটা করে বিয়ে দিতে চান ভাইপোর। বিয়ের খরচ চেয়ে বসলেন ভাইয়ের কাছে। মোহন পত্রপাঠ জানিয়ে দিলেন, “হরিলাল বিয়ে বিয়ে করলে ভাল, না করলেও ভাল। কারণ, বর্তমানে আমি ছেলে হিসেবে তার কথা ভাবা বন্ধ করে দিয়েছি।”
সেবার কস্তুরবারা দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে পা রাখার কয়েক মাসের মধ্যে প্লেগ দেখা দিল সেখানে। মোহনদাস নেমে পড়লেন জনসেবায়। কস্তুরবাও। স্বামীর পাশে। যোগ্য সহধর্মিণীর মতো। ভারতীয়দের মহল্লায় ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের বুঝিয়েছিলেন স্বাস্থ্য বিধির সাধারণ নিয়মগুলো।
চার বছর পর। ১৯০৮। জেলে বসেই খবর পেয়েছিলেন, কস্তুরবা ভীষণ অসুস্থ। রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রায়ই। জরিমানা দিয়ে জেলের বাইরে আসার সুযোগ ছিল। মোহনদাস সে পথে হাঁটলেন না। জেলে বসেই চিঠি লিখলেন কস্তুরবাকে, “ যদি তুমি মরেও যাও, তবুও জেনো, আমার কাছে তুমি অমর হয়েই থাকবে। আত্মা মৃত্যুহীন। আমি তোমাকে একটা কথা আগেও বলেছি, আজ ফের বলছি। তোমার মৃত্যুর পর আমি অন্য কারোকে বিয়ে করব না।” সাহেব ডাক্তার চা খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল অ্যানিমিয়া সারানোর জন্য। গান্ধির কথাটা মনে ধরেনি। ডাক্তার বলেছিলেন তাঁর কথা না শুনলে তিনি আর চিকিৎসা করবেন না। ডাক্তারি করার দায়িত্ব নিজের ঘাড়েই নিলেন গান্ধি। প্রথমেই বললেন, নুন আর ডাল খাওয়া ছাড়তে হবে। কস্তুরবা মেনে নিলেন। তারপর বললেন, স্রেফ আটা আর ফল খেয়ে থাকতে হবে। কস্তুরবা রাজি হননি। অবাধ্য স্ত্রীকে দেখে গান্ধি বুঝলেন, “তুমি একজন মহিলার সঙ্গে লেপ্টে থাকবে আবার মানুষের সেবা করবে, দুটো একসঙ্গে করা যায় না।”
তবু বেশ কাটছিল দিনগুলো। কিন্তু গোল বাধল গত বছরেই। কস্তুরবার প্রথম হার্ট অ্যাটাক। অ্যালোপাথি থেকে আয়ুর্বেদ, কোনোটাতেই কোনও কাজ দিল না। গান্ধি সব বন্ধ করে দিলেন। হরিলাল ছাড়া সব ছেলেরাই মাকে দেখতে এল। কস্তুরবা হরিলালের খোঁজ করায় গান্ধি পুলিশকে বললেন, তাকে খুঁজে আনতে। জানা গেল, হরিলাল এসেছিল। আগা খান প্যালেসের গেট টপকে ঢোকার চেষ্টাও করে। কিন্তু মুখ থেকে ভর ভর করে মদের গন্ধ বেরচ্ছিল বলে পুলিশ ঢুকতে দেয়নি। হরিলাল আবার এল। রামদাস আর দেবদাসের সঙ্গে। কিন্তু সে তখন মদ খেয়ে চুর। কস্তুরবা তার হাল দেখে কপাল চাপড়াতে লাগলেন। হরিলাল পালিয়ে বাঁচে, আর ফিরে আসেনি।
মরদেহ স্নান করালেন মহাত্মা, নিজের হাতে। পরিয়ে দিলেন তাঁর নিজের হাতে চরকায় কাটা সুতোয় বোনা শাড়ি। কস্তুরবা তো এটাই চেয়েছিল। আগা খান প্যালেসের এক কোনায় জ্বলল তাঁর চিতা। গান্ধি যদি শেষবার অনশনে বসে মরেন, তবে তাঁকে দাহ করার জন্য নির্দিষ্ট করা ছিল জায়গাটা। সে জন্যই কাঠ এনে রেখেছিল সরকার। সেই কাঠই ব্যবহার করা হল কস্তুরবাকে দাহ করার জন্য।
আগুন জ্বলে উঠল।
আরও পড়ুন : সুকান্তের সম্বর্ধনায় নেই কেন? লকেট বললেন “ব্যস্ত আছি”
মহাত্মা স্থির হয়ে বসে থাকলেন চিতার পাশে। বার বার বলা হল, আপনি এভাবে বসে থাকবেন না। ভেতরে গিয়ে বিশ্রাম নিন। গান্ধির মুখে সেই এক কথা, “বাষট্টি বছর ও আমার সঙ্গে ছিল। আমি এখন যদি ওকে ছেড়ে যাই, তবে ও আমায় ক্ষমা করবে না।” চিতার আগুন নিভল। সব পুড়ে ছাই। পড়ে রইল শুধু কস্তুরবার শাঁখা জোড়া। সবাই বলল, সতীলক্ষ্মী ছিলেন যে! জাতির জনক কিছু বললেন না।