এমন আত্মভোলা মানুষ আজকের দিনে বিরল
ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়
ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় আমাদের কৈশোর-যৌবন জুড়ে ছিলেন। পাণ্ডব গোয়েন্দার জন্য আমরা মুখিয়ে থাকতাম। টানটান উত্তেজনা এবং শিহরন বজায় রাখার অদ্ভুত এক দক্ষতা ছিল ওঁর মধ্যে। আমাদের পত্রিকায় ওঁর অনেক লেখা ছেপেছি। জানতে চেয়েছিলাম, পাণ্ডব গোয়েন্দা এল কীভাবে? বলেছিলেন, ‘দীর্ঘদিন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহচ্ছায়ায় ছিলাম। একদিন উনি আমাকে ফেমাস ফাইভ পড়তে দিলেন। সেটা কোনও রকমে পড়ার পর মনে হয়েছিল, এই ধরনের লেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। তারপর শুরু করলাম পাঁচটি চরিত্র এবং একটি কুকুরকে নিয়ে পাণ্ডব গোয়েন্দা।’ উনি এ-ও বলেছিলেন, ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা এতটা জনপ্রিয় হবে ভাবিনি।’ একটি বিখ্যাত ফিল্ম প্রোডাকশন হাউস মোটা টাকার বিনিময়ে পাণ্ডব গোয়েন্দার রাইটস কিনতে চেয়েছিল। সেই ব্যাপারে যোগাযোগ করে জানতে পারি, উনি প্রায় জলের দরে অন্য একটি সংস্থাকে রাইটস বিক্রি করে দিয়েছিলেন। আসলে ওঁর কোনও চাহিদা ছিল না। সরল সাদাসিধে মানুষ ছিলেন। এমন আত্মভোলা মানুষ আজকের দিনে বিরল। ছোটদের জন্য এইরকম ঝরঝরে গদ্য লেখক কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-রাজ্যে রাজ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জার থাবা, আক্রান্ত বড়রাও, ওষুধে সতর্কতা
পাণ্ডব গোয়েন্দা একটি খাঁটি বিষয়
প্রচেত গুপ্ত
ছোটবেলায় পাণ্ডব গোয়েন্দা পড়ার সময় মনে হত, গল্পে যে ছেলেগুলোর কথা আছে, তাদের একজন আমি। শুনতে পাই পৃথিবীটা অনেক এগিয়ে গেছে। তথ্য-প্রযুক্তি এসে পড়েছে। মনে হয়েছিল, এখন হয়তো পাণ্ডব গোয়েন্দার প্রতি বর্তমান প্রজন্মের টান নেই। কিন্তু গত কয়েক বছর বইমেলায় ওঁকে ঘিরে ছোটদের উন্মাদনা দেখে বিস্মিত হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি। পাণ্ডব গোয়েন্দা আসলে কী? সাহস, বন্ধুত্ব, বেড়ানো, অ্যাডভেঞ্চারে ঝাঁপিয়ে পড়ার গল্প। এর সব ক’টা গুণ নতুন প্রজন্মের পাঠকদের মধ্যেও রয়েছে। বিশুদ্ধ বাঙালি গল্প। যতই মোবাইল আসুক, ল্যাপটপ আসুক, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আসুক, আমাদের মন থেকে পাণ্ডব গোয়েন্দাকে সরানো যায়নি, যাবেও না। এই লেখার মধ্যে অদ্ভুত এক বিশ্বাস লুকিয়ে রয়েছে। ছোটদের বিশ্বাস। বন্ধুর সঙ্গে থাকব, ভয় পাব না, কেউ সমস্যায় পড়লে উদ্ধার করতে যাব, পাণ্ডব গোয়েন্দা পড়লে এইগুলোই মনে হয়। সবমিলিয়ে পাণ্ডব গোয়েন্দা একটি খাঁটি বিষয়। খাঁটি বিষয়ের বদল ঘটে না। ছিলেন একজন সজ্জন মানুষ। ওঁকে দেখলেই মন ভাল হয়ে যেত। হিমালয় ভ্রমণ নিয়ে অসাধারণ সব লেখা উপহার দিয়েছেন। মুখেও ভ্রমণের গল্প বলতেন চমৎকার।
আরও পড়ুন-সিপিএমের কীর্তি খবর অপছন্দ তাই তছনছ করা হল মিডিয়া অফিস
চিঠি লিখেছিলাম পাণ্ডব গোয়েন্দাকে
দীপান্বিতা রায়
পাণ্ডব গোয়েন্দা। বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু আর তাদের ভারি অনুগত পঞ্চুর অ্যাডভেঞ্চার। বইটা হাতে এলে এক নিঃশ্বাসে সবটা পড়ে ফেলতাম। তখন যেখানে থাকতাম সেই বাড়ির এক পাশে মস্ত উঁচু পাঁচিল ছিল। পাঁচিলের ওপাশে বেশ খানিকটা পোড়ো জমি। তারপর আবার অন্যদের বাড়িঘর। পাণ্ডব গোয়েন্দা পড়তে শুরু করার পর মনে হত, ওই পোড়ো জমিটাতে নিশ্চয় কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে। একদিন রাতে সেখানে টর্চের আলোর ঘোরাঘুরি দেখে তো জনপ্রিয় পত্রিকার দফতরে পাণ্ডব গোয়েন্দাকে চিঠিও লিখে ফেলেছিলাম। রোজ দুপুরবেলা পাড়ার যে কুকুরটাকে মা ভাত দিত, তাকে আমার পঞ্চুর মতোই লাগত। বাবলু, বিলুরা চিঠি পেয়েও এল না দেখে তাকে নিয়েই পোড়ো জমিতে যাব ঠিক করে ফেলেছিলাম। আসলে এটাই ছিল ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের ম্যাজিক। ঠিক আমার কিংবা আমাদের মতোই পাঁচটা ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঘরের পাশেই অ্যাডভেঞ্চার। ছোট ছোট বুদ্ধির খেলা। ভয় ভয় লাগলেও সাহস করে এগিয়ে যাওয়া। শেষ পর্যন্ত দুষ্টু লোকটা যতক্ষণ না পাণ্ডব গোয়েন্দার কাছে হেরে যাচ্ছে, ততক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা।
আরও পড়ুন-দল জিতলেও ট্রোলড রোনাল্ডো
ওঁর ভূতের গল্পও খুব জনপ্রিয় ছিল
জয়ন্ত দে
ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের নাম জেনেছি পাণ্ডব গোয়েন্দা পড়েই। আমি ছিলাম ওঁর লেখার একজন ভক্ত। লেখালেখি শুরু করার কয়েক বছর পর ওঁর সঙ্গে আলাপ হয় মিত্র ঘোষের অফিসে। তখন উনি খুব কম লিখছিলেন। আমি ওঁকে আমাদের কাগজে লিখতে অনুরোধ করি। তারপর নিজেকে নতুনভাবে মেলে ধরেন। অজস্র লেখা উনি লিখেছেন। উপহার দিয়েছেন ধর্মীয় স্থান নিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা। এই লেখাগুলো ওঁকে আরও পাঠকপ্রিয় করে তুলেছিল। প্রায় সারা ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেছেন। বেড়ানোর সেই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন পাঠকদের সঙ্গে। পাণ্ডব গোয়েন্দার পাশাপাশি ওঁর এই লেখাগুলোও কিন্তু থেকে যাবে। ওঁর চোখ দিয়ে আমরা হিমালয় এবং বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্র দেখেছি এবং বুঝেছি উনি কত বড় মাপের লেখক ছিলেন। প্রতিটি লেখায় নিজের ছোট ছোট অনুভূতিগুলো উজাড় করে দিতেন। তুলে ধরতেন আশেপাশের মানুষজনের কথা। সেইসঙ্গে পুরাণ, মিথ, প্রকৃতি, জার্নি ইত্যাদি প্রসঙ্গ তো থাকতই। পড়তে ভাল লাগত। ওঁর ভূতের গল্পও খুব জনপ্রিয় ছিল। সবথেকে বড় কথা, গল্পগুলোয় দেখা যেত ভূতের উপস্থিতি। বাঙালি পাঠকদের মনে উনি থেকে যাবেন।
আরও পড়ুন-মিড ডে মিলের দায়িত্বে স্বনির্ভর গোষ্ঠী
ভ্রমণ-বিষয়ক লেখাও লিখেছেন
উল্লাস মল্লিক
আমার খুব প্রিয় সাহিত্যিক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় চলে গেলেন। ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম শেষশ্রদ্ধা জানাতে। কিশোরদের জন্য লেখা পাণ্ডব গোয়েন্দা ওঁর অমর সৃষ্টি। এই লেখা ছিল আমাদের শৈশব-কৈশোর জুড়ে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে আমাকে সাহিত্যের স্বাদ দিয়েছিল পাণ্ডব গোয়েন্দাই। আমার বয়সি পাঁচজন ছেলে-মেয়ে, সঙ্গে একটি কুকুর, এক একটা অভিযানে যাচ্ছে এবং সফল হয়ে ফিরে আসছে। এগুলো আমাদের কাছে ছিল রোমাঞ্চকর। খুব সহজ-সরল ভাষায় লিখতেন। কোনও রকম ভান-ভনিতা ছিল না। এক নিমেষে পড়ে ফেলা যেত এবং দ্রুত গল্পের ভেতরে ঢুকে যাওয়া যেত। সেখান থেকে বেরোনোর উপায় থাকত না। আমাদের সময়ে কী যে উন্মাদনা ছিল, বোঝানো অসম্ভব। বন্ধুরা হাত বদল করে পাণ্ডব গোয়েন্দা পড়তাম। শিশু-কিশোর সাহিত্যে এই জায়গাটা প্রায় শূন্য হয়ে গেল। পূরণ হওয়া খুব কঠিন। পাশাপাশি ভূতের গল্প এবং ভ্রমণ-বিষয়ক লেখাও লিখেছেন। তবে পাণ্ডব গোয়েন্দার দাপটে ওই লেখাগুলো কিছুটা চাপা পড়ে গেছে। ব্যক্তিগত স্মৃতি প্রচুর। একসঙ্গে বহু অনুষ্ঠানে গেছি। ছিলেন মাটির মানুষ এবং স্নেহপ্রবণ।
আরও পড়ুন-অ্যাডিনো-সামলাতে হল ১৬ শয্যার শিশু ইউনিট
খুঁজে খুঁজে পাণ্ডব গোয়েন্দা পড়ে যাই
সাগরিকা রায়
সে ছিল একটা সময়, যখন শার্লক হোমসকে সবে চিনতে শুরু করেছি। আমাদের বাড়িতে প্রচুর পুরনো পত্রিকা ছিল। ছোট সাইজের। প্রচ্ছদ ছিল অসাধারণ। একটু বড় হয়ে পুরনো পত্রিকাগুলো বের করে পড়া শুরু করেছি। পড়ছি, সূর্যনগরীর গুপ্তধন, সোনার ঘণ্টার ফ্রান্সিস, হীরের পাহাড়ের ফ্রান্সিস, ভয়ের মুখোশ, টারজন, অমরবীর কথা, দস্তার আংটি। একদিন পেলাম পাণ্ডব গোয়েন্দাদের নানান রোমাঞ্চকর অভিযানের গল্প। আমাদের বয়সের পাঁচজনের দল সঙ্গে পঞ্চু নামের একটি দেশীয় কুকুর নিয়ে যে ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে, তা পড়ে উল্লসিত হয়ে পড়লাম বলাই বাহুল্য। খুঁজে খুঁজে পাণ্ডব গোয়েন্দা পড়ে যাই। তারপর কেটে গিয়েছে অনেক বছর। একদিন কলকাতায় মিত্র ঘোষ অফিসে দেখা হল পাণ্ডব গোয়েন্দার স্রষ্টা ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কথায় কথায় বললেন ‘লিখব, আরও লিখব।’ বিভিন্ন স্বাদের লেখা উপহার দিয়েছেন। এইসব লেখার মধ্যে দিয়েই তিনি থেকে যাবেন পাঠকদের মনে।