প্রথমেই সোজা কথাটা সোজাভাবে বলে নেওয়া যাক। রাজ্যবাসী রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের (CV Ananda Bose) কাছে হুমকি নয়, অহেতুক বিতর্ক নয়, গঠনমূলক পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করে।
মাননীয় রাজ্যপাল কয়েকদিন আগে প্রেস বিবৃতির মাধ্যমে বলেছেন, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে রাজ্যপাল চুপ করে থাকবেন না। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। রাজ্য সরকার ও রাজ্যপালের পারস্পরিক সম্পর্কেও কিছুটা বদল এসেছে। তথাপি, কয়েকটি বিষয়ের পুনরুল্লেখ ও কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে বলে মনে করি।
আনন্দ বোস একজন বিদগ্ধ ও পণ্ডিত ব্যক্তি। দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। কেরল সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ প্রশাসনিক পদে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন। একাধিক পুস্তকের রচয়িতা। শুনেছি, অবসরের পর তিনি কেরল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। একইসঙ্গে এটাও ঘটনা, কেরলে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে তিনি নির্বাচনে লড়েছিলেন, কিন্তু জিততে পারেননি। কোনও দলের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে দাঁড়ানো অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু আনন্দ বোস যখন রাজ্যপাল হিসাবে শপথ নিয়েছেন, তখন আশা করা যায়, তিনি দল নিরপেক্ষ হয়ে তাঁর সাংবিধানিক কর্তব্য পালন করবেন। রাজ্যপাল (Governor CV Ananda Bose) পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অরাজনৈতিক সাংবিধানিক পদ। সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেওয়া এবং নির্বাচিত সরকারকে হুমকি দেওয়া তাঁর সাংবিধানিক মর্যাদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। একজন বিদগ্ধ ব্যক্তির পক্ষে অভিপ্রেত নয়। কোনও রাজ্যপালই প্রকাশ্যে বিবৃতি দিতে পারেন না। প্রাক্তন রাজ্যপাল মাননীয় জগদীপ ধনকড়ের কার্যপ্রাণালী মোটেই অনুসরণযোগ্য নয়। তিনি ট্যুইট করে বা প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে নানা অজুহাতে রাজ্য সরকারের সমালোচনা করতেন। দেশের কোনও রাজ্যপাল এই ধরনের কাজ করেননি। তবে একটি কথা আনন্দ বোস যথার্থই বলেছেন— প্রতিবাদের অধিকার গণতন্ত্রে আছে। কিন্তু গুন্ডামির জায়গা সভ্য সমাজে নেই। তারপর তিনি বলেছেন, তিনি ‘চুপ’ করে বা নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারেন না। রাজনৈতিক নেতার মতো কথা বলেছেন। বিজেপির কোনও নেতা এই ধরনের হুমকি-দামকি দিলে মনে করার কিছু ছিল না। রাজনীতিতে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। আচ্ছা রাজ্যপালজি কী করতে পারেন? রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী নামাতে পারেন রাজ্য সরকারের অগ্রাহ্য করে? মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাতে নামতে পারেন? নির্বাচিত সরকারকে ভেঙে দিতে পারেন? এর কোনওটাই তিনি পারেন না। খুব বেশি হলে তিনি নির্বাচিত সরকারকে মাঝে মাঝে অস্বস্তিতে ফেলতে পারেন। তাতে লাভ কিছু হবে না। সরকারের পিছনে, মুখ্যমন্ত্রীর পিছেনে গণসমর্থন থাকলে রাজ্যপাল ও কেন্দ্রীয় সরকারের কী করণীয় থাকতে পারে? সংবাদে প্রকাশ, এই ঘটনা সম্পর্কে রাজ্যপাল রাজ্য সরকারের কাছে রিপোর্ট চেয়েছেন। সেটা তিনি চাইতেই পারেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন। মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, ডিজি (পুলিশ) বা যে কোনও আধিকারিককে ডেকে আলোচনা করতে পারেন। রাজ্যপাল দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। তাঁর প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু পরামর্শ দিতে পারেন এই পর্যন্তই। ভারতীয় সংবিধানের ১৬৭ ধারা অনুসারে রাজ্যপালের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর সাংবিধানিক কর্তব্য রয়েছে। ১) রাজ্য মন্ত্রিসভার সমস্ত সিদ্ধান্ত ও আইনের প্রস্তাব মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালকে জানাবেন, ২) রাজ্যের শাসন সংক্রান্ত বিষয় ও আইনের প্রস্তাব সম্পর্কে যদি রাজ্যপাল কিছু জানতে চান, মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে সেই সম্বন্ধে অভিহিত করবেন, ৩) কোনও মন্ত্রী এককভাবে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে রাজ্যপাল সেটা বিবেচনার জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে পেশ করতে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে পারেন। সংবিধানের ৭৮ ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর একই ধরনের সাংবিধানিক কর্তব্য রয়েছে। ১৬৭ ধারার কার্যকারিতা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালের পারস্পারিক আস্থার উপর নির্ভর করে।
প্রকৃত শাসন ক্ষমতা মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে রাজ্য মন্ত্রিসভার হাতে ন্যস্ত। রাজ্যপাল সাংবিধানিক প্রধান ও মর্যাদাপূর্ণ সাংবিধানিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু সেই মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব অনেকটাই সংশ্লিষ্ট রাজ্যপালের উপর নির্ভর করে। জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত বিধানসভার কাছে মন্ত্রিসভা যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকে। মন্ত্রিসভা ভুল-ভ্রান্তি করলে নির্বাচনের সময় জনসাধারণ বুঝে নেবেন। রাজ্যপাল দায়িত্বশীল নন। তাই তাঁর হাতে প্রকৃত শাসনক্ষমতা নেই। তাঁর ভূমিকা সহায়ক ও পরামর্শদাতার। কেন্দ্রে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।
আরও পড়ুন: ইমরানকে গ্রেফতার করতে গিয়ে খালি হাতে ফিরল পুলিশ
অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে রাজ্যপাল (CV Ananda Bose) রাজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠিয়ে থাকেন। এটা তাঁর নিয়মমাফিক কর্তব্য। আবার নির্দিষ্ট কোনও বিষয় নিয়ে বিশেষ রিপোর্ট পাঠাতে পারেন। যেমন, আনন্দ বোস সাহেব সাম্প্রতিক ঘটনাটি নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে পাঠাতেই পারেন। এতে দোষের কিছু নেই। তিনি চাইলে, রাজ্যে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তনের সুপারিশ করতে পারেন। যদিও ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি থেকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা প্রায় অসম্ভব। এ-ছাড়া বিচক্ষণ রাজ্যপাল নিশ্চয়ই বোঝেন এই ধরনের অ-বিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সমগ্র ভারতবর্ষে কী হতে পারে। রাজ্যপালের এই দ্বৈত ভূমিকার (রাজ্যের শাসনতান্ত্রিক প্রধান ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি) মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা তখনই সম্ভব যদি কেন্দ্রীয় সরকার দলীয় স্বার্থে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে রাজ্যপালের পদটিকে অপব্যবহার না করে।
নির্বাচিত সরকারের কাজে ও প্রশাসনে হস্তক্ষেপ না করেও, রাজ্য সরকারকে প্রকাশ্যে রাজনৈতিকভাবে হুমকি দেওয়া থেকে বিরত থেকেও, আমাদের রাজ্যপাল তাঁর দীর্ঘ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ও পাণ্ডিত্যের ভিত্তিতে প্রশাসনকে নানাভাবে সাহায্য করতে পারেন ও গঠনমূলক পরামর্শ দিতে পারেন। রাজ্যবাসী রাজ্যপালের কাছে সেটাই প্রত্যাশা করে।