উচ্ছ্বাস থেকে স্তব্ধতার ব্যবধান ঠিক কতক্ষণের? রং মুছে কালো হতে ঠিক ক’টা মুহূর্ত? সবান্ধব থেকে সত্যিকার একা হতে আদতে কতটা সময়? আমরা জানি প্রশ্নগুলো যতটা সহজ উত্তরও ততটাই জানা। কিন্তু তবু, তবু প্রতিবার আমরা বিস্মিত হই, ক্ষত-বিক্ষত হই, বিধ্বস্ত হই আর অবিশ্বাসের শিকার হই। কারণ প্রতিবার নতুন চিত্রনাট্য দেখি, দেখি নতুন ট্যুইস্ট! যেমনটা ফের দেখলাম গতকাল। সতীশ কৌশিক চলে গেলেন। নিয়ে গেলেন বেড়ে-ওঠা সময়ের একগাদা কুটোপাটি হাসি, কিছু মাস্তানি, কিছু মনে গেঁথে যাওয়া সিনেমার উজ্জ্বল স্মৃতি। শিল্পী যখন তাঁর শিল্পে আমজনতার হৃদয়ে এরকমই দীপ্ত থাকেন, সার্থকতা সেখানে চিরস্থায়ী হয়। তবু বিষাদ তো আসেই। বিশেষত তখন, যদি সেটা বড্ড অসময়ে হয়। যখন প্রাপ্তির প্রত্যাশা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। সতীশ সেভাবেই চলে গেলেন। মাত্র ৬৬ বছর বয়সে।
আরও পড়ুন-কোচবিহারকে সমৃদ্ধ শহর বানাতে একগুচ্ছ প্রকল্প
১৯৫৬-র ১৩ এপ্রিল হরিয়ানায় জন্মেছিলেন। একগাদা স্বপ্ন ছিল ছোটবেলা থেকেই। পড়াশোনা সম্পূর্ণ করেছিলেন দিল্লির কিরোরী মাল কলেজে। তারপরই যোগ দেওয়া ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা আর ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ায়। থিয়েটার করেছেন জানপ্রাণ দিয়ে। বলিউডে আত্মপ্রকাশ তারপর। লড়াইয়ের দিনগুলোর কথা খুব যে বলতেন তা নয় কারণ ব্যস্ত থাকতেন পরের লড়াইয়ের কাজে। আর এভাবেই থিয়েটার ও সিনেমার সব ক’টি বিভাগকে গুলে খাওয়া। সফল কৌতুক অভিনেতার ছাপ নিয়ে দিব্যি স্বস্তিতে থাকতে পারতেন কিন্তু থাকেননি। গল্প লিখেছেন, চিত্রনাট্য লিখেছেন, সংলাপ লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন, প্রযোজক হয়েছেন, এনএসডি’র সহপাঠী-বন্ধু অনুপম খেরের সঙ্গে মিলে প্রোডাকশন হাউস খুলেছেন এবং হ্যাঁ, সহশিল্পী, সহকর্মী, বন্ধু সবার পাশে তাদের অসময়ে সাধ্যমতো ছুটে গেছেন। সাহস জুগিয়েছেন, ভরসা দিয়েছেন, সহমর্মিতা বিলিয়েছেন, যা ভীষণই বিরল ইদানীং। আর এ-কারণেই এমন উদ্বেল বলিউড। মর্মাহত থিয়েটার জগৎও।
আরও পড়ুন-হাসপাতাল থেকে সুস্থ সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন বিপন্মুক্ত মা, রাজ্যে প্রথম বিরল অস্ত্রোপচারে সাফল্য
আশির দশকের গোড়ার দিক থেকে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেছিলেন থিয়েটারে। থিয়েটার অভিনেতা হিসেবেও বড্ড জনপ্রিয় ছিলেন সতীশ। হিন্দি নাটক ‘উইলি লোম্যান’, ‘সেলসম্যান রামলাল’-এ তাঁর অভিনয় হিন্দি বলয়ে মুখে মুখে ফেরে। সিনেমায় তাঁর জনপ্রিয় চরিত্রগুলির বাইরেও একাধিক বিষয়ভিত্তিক ছবিতেও দুর্দান্ত অভিনয়ের ছাপ রেখে গেছেন। ২০০৯-এ ‘তেরে সং’ ছবিতে শীনা শাহাবাদি, রুসলান মুমতাজদের সঙ্গে দারুণ একটি চরিত্রে ছিলেন সতীশ কৌশিক। যদিও আমজনতার চোখে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা, ১৯৮৭-তে প্রয়াত শ্রীদেবী ও অনিল কাপুর অভিনীত সুপারহিট ছবি ‘মিঃ ইন্ডিয়া’-র ‘ক্যালেন্ডার’ চরিত্রে অভিনয় করে। এরপর অসংখ্য চরিত্র পেলেও ফের ১৯৯৭-এ অনিল কাপুর-গোবিন্দা জুটির সঙ্গে ‘দিওয়ানা মস্তানা’ ছবিতে ‘পাপ্পু পেজার’ হিসেবে দর্শকের মন জিতেছিলেন।
আরও পড়ুন-পেলের সম্পত্তি পাবেন সেই কন্যা
পরিচালক হিসেবে সতীশের প্রথম ছবি, ‘রূপ কি রানি চোরোঁ কা রাজা’ (১৯৯৩)। তবে পরিচালিত প্রথম হিট ছবি, ‘হাম আপকে দিল মে রহেতে হ্যাঁয়’ (১৯৯৯)। লিখেছিলেন কাল্ট ছবি, ‘জানে ভি দো ইয়ারো’-র সংলাপ। শুধু সিনেমা নয়, টেলিভিশনেও একাধিক কাজে একাধিকভাবে যুক্ত ছিলেন সতীশ। ‘ফিলিপস টপ টেন’ শো’টির লেখক- সঞ্চালক ছিলেন, ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি ড্রামা’-তে নবাব জং বাহাদুরের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন দু’বার। ১৯৯০-এ ‘রাম লখন’ এবং ১৯৯৭-এ ‘সাজন চলে শশুরাল’ ছবির জন্য। সব মিলিয়ে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী।
আরও পড়ুন-দিল্লিকে হারিয়ে শীর্ষে হরমনরা
তবে এসব নিছকই তথ্য। এ দিয়ে মানুষটার কাজের ব্যাপ্তি ধরা পড়ে নিশ্চিত কিন্তু প্রিয়জনদের কাছে রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলো যে অনেক বেশি মূল্যবান। কিছু মজার, বাইরের মানুষটার মতোই, কিছু বেদনার, ভেতরের মানুষটার সদৃশ। সারা জীবন মানুষকে হাসিয়েছেন কিন্তু জানতে দেননি প্রথম সন্তানকে মাত্র দু’বছর বয়সে হারানোর যন্ত্রণা। নিজেকে নিয়ে রসিকতারও শেষ ছিল না! কপিল শর্মা জানিয়েছেন, তাঁর কমেডি শো-এ এসে সতীশ কৌশিক জানিয়েছিলেন, মুম্বই এসে প্রথম দিকে অভিনয়ের ব্যাপারে খুব সন্দিহান ছিলেন, নিজের চেহারার জন্য! অভিনয় করতে চাইলে ছবি জমা দিতেই হত আর তখনই মনে হত, যা চেহারা, ছবি দেখেই তো ক্যানসেল করে দেবে!
আরও পড়ুন-পুরীধামে আগুন
অভিনয় দেখানোর সুযোগই মিলবে না। আর অভিনেত্রী নীনা গুপ্তার স্মৃতিচারণ মানুষ কৌশিককে চেনায় আরও গভীর ভাবে। ক্রিকেটার ভিভ রিচার্ডস-এর সন্তানের মা হতে যাচ্ছিলেন যখন অবিবাহিতা নীনা, চারদিকে ছিচ্ছিকার, দূরত্ব, সেই সময় সতীশ ওঁকে ছবির সেটে আন্তরিক প্রস্তাব দিয়েছিলেন, বিয়ে করার। স্রেফ নীনার অপমান সহ্য হচ্ছিল না বলেই! সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেও মানুষটার মনোভাব বুঝেছিলেন নীনা। আজও মনে রেখে উল্লেখ করেছেন আত্মজীবনী ‘সচ কহু তো’-তে। আর ওটাই সতীশ কৌশিক, যার জন্য মনে মনে কাঁদছে আমজনতা।