*আটের দশকে আপনার আত্মপ্রকাশ। অনেকটা পরিণত বয়সেই। পিছনে কত বছরের প্রস্তুতি ছিল?
ছোটবেলা থেকেই লিখতাম। কিন্তু কোনওদিনই প্রকাশ করার উৎসাহ দেখাইনি। সেই সময় টুকটাক দু-একটা জায়গায় লেখা বেরিয়েছে। সেগুলো তেমন উল্লেখ করার মতো নয়। মনস্থির করে যে লেখা, সেটা তখন হয়ে ওঠেনি। অনুবাদ করতাম প্রচুর। কবিতা লিখতাম। জীবনটাও কেটেছে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। ফলে লেখালিখির প্রতি খুব বেশি মনোযোগী হতে পারিনি। আটের দশকের শুরুতে আমার মনে হল, এবার নিজেকে প্রকাশ করা উচিত। পাশাপাশি এই সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম, শ্রেষ্ঠ পত্রিকাতেই নিজেকে প্রকাশ করব। কারণ ততদিনে নিজের (Bani Basu) লেখার মূল্যায়ন করার ক্ষমতা আমার হয়ে গেছে।
*কবিতা লিখতেন, অনুবাদ করতেন। অথচ বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে নিজেকে মেলে ধরলেন কথাসাহিত্যিক (Bani Basu) হিসেবে। কেন?
কবিতা লিখতে খুব বেশি সময় লাগত না। হঠাৎ হঠাৎ লিখে ফেলতাম। গল্প লিখতে গেলে সময় দিতে হয়, অনেক বেশি ভাবনাচিন্তা করতে হয়। আগে আমার জীবনে সেই সুযোগ ছিল না। তাই সেই সময় গল্পের প্রতি মন দিতে পারিনি। তবে সিরিয়াস লেখালিখি শুরু করার পর গল্প লিখলাম এই কারণে, তখন আমার হাতে কিছুটা সময় এসেছে। এসেছে মানসিক স্থিরতা। আমার প্রথম দুটো লেখা প্রকাশিত হয়েছে দেশ এবং আনন্দমেলায়। ১৯৮১ সালে।
*প্রথম উপন্যাস ‘জন্মভূমি মাতৃভূমি’। তার জন্য পাঠকদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও ৬ বছর। উপন্যাসটির জন্য কীরকম প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
কোনও প্রস্তুতিই ছিল না। শুরুতে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, হাতে যেটুকু সময় পাব, ছোট-গল্প লিখব। কারণ ছোট-গল্প লিখতে খুব পছন্দ করতাম। উপন্যাসের কথা কখনও ভাবিনি। তা ছাড়া উপন্যাস লিখতে পারব এমন ধারণাও আমার ছিল না। দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের উৎসাহেই আমার উপন্যাস লেখা শুরু। প্রথম উপন্যাস ‘জন্মভূমি মাতৃভূমি’ প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দলোক পত্রিকায়। ১৯৮৭ সালে।
*সাহিত্য জগতে কোনওরকম সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে? বিশেষত একজন মহিলা হিসেবে…
শুধুমাত্র মহিলা (Bani Basu) হিসেবে কোনও সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। তবে এটা ঠিক, সমস্ত জগতের মতো সাহিত্যজগৎও নানা কুটিলতায় ভরা। সেইরকম কিছু কিছু সমস্যার মুখোমুখি আমাকেও হতে হয়েছে। সেটা একজন সাহিত্যিক হিসেবে, শুধুমাত্র মহিলা হিসেবে নয়।
*প্রতিকূল পরিস্থিতি কীভাবে অতিক্রম করেছেন?
ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। তবে লেখার ক্ষেত্রে কখনও হার মানিনি। বরং আরও বেশি লেখালিখির প্রতি মনোনিবেশ করেছি। লেখাকেই করে নিয়েছি হাতিয়ার।
*কোনও কিছু প্রত্যাশা করে সাহিত্যজগতে আসেননি। তবু জীবনে যতটা পেয়েছেন, আপনি খুশি?
সত্যিই আমার কোনও প্রত্যাশা ছিল না। এত-এত লিখতে পারব, ধারণা করতে পারিনি কোনও দিন। কম উপন্যাস তো লিখিনি! দেখতে দেখতে অনেকগুলোই। এটা ঠিক, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনও সীমা নেই। তবে একটা কথা বলতে পারি, কোনও অভিযোগ নেই আমার।
*ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?
কিছু তো একটা আছে। সেটা কী? ঈশ্বর না ঈশ্বরকণা? জানি না। কোনও দিনই জানা যাবে বলেও মনে হয় না।
*ধর্ম সম্পর্কে আপনার কী ভাবনা?
ধর্ম একদিক দিয়ে যায়, আমি আর একদিক দিয়ে যাই। ধর্ম নিয়ে সারাদেশে যেটা চলছে, সেটা ভাঁড়ামি। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কিছু মানুষ ধর্মকে হাতিয়ার করেছে। আসলে তারা ধর্মহীন। পুরোটাই লোক দেখানো।
আরও পড়ুন:কেয়া : ভেসে যাওয়া দূরতম দ্বীপ
*সম্প্রতি আপনার একটি বই বেরিয়েছে ‘সাদা কবিতা কালো কবিতা’। আপনার প্রথম কবিতার বই। লেখাগুলো কীভাবে এল?
করোনার সময় গৃহবন্দি ছিলাম। তখন সবে ফেসবুক ধরেছি। হাতে প্রচুর সময়। বাড়িতে বসে বসে কবিতা লিখতাম এবং ফেসবুকে পোস্ট দিতাম। পেতাম তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। বেশ মজা লাগত। সেই সময়ে লেখা কবিতাগুলো নিয়েই মূলত এই বই।
*জীবনে বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। পুরস্কার একজন সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে?
আমি (Bani Basu) মনে করি একজন সৃষ্টিশীল মানুষের পুরস্কার পাওয়া উচিত। সমঝদার পাঠকের ভালবাসা একজন লেখকের কাছে বড় স্বীকৃতি, অস্বীকার করা যায় না। চিত্রশিল্পীর কাছে যেমন দর্শক, সংগীতশিল্পীর কাছে যেমন শ্রোতা, লেখকের কাছে তেমন পাঠক। প্রত্যেক সৃষ্টিশীল মানুষেরই সমঝদার দরকার হয়। যদিও কিছু সৃষ্টিশীল মানুষ তাঁর সৃষ্টিকে ঈশ্বরের প্রতি নিবেদন করেন। সেই সংখ্যা খুব কম। সমঝদারের প্রশংসার পাশাপাশি জীবনের পুরস্কারের প্রয়োজন আছে। পুরস্কার মানে নির্দিষ্ট কিছু পণ্ডিত বা প্রাজ্ঞ মানুষের নির্দিষ্ট সেই বিষয়ে মূল্যায়ন। সেটা খুবই প্রয়োজনীয়। পুরস্কার পেলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে, আরও ভাল কিছু লেখার ব্যাপারে উৎসাহ তৈরি হয়। এর পাশাপাশি ঘটে অর্থপ্রাপ্তি। এরও একটা মস্ত বড় গুরুত্ব আছে। বেশিরভাগ প্রকাশক লেখকদের ঠকানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে আছেন। ফলে পুরস্কারের হাত ধরে যদি কিছু অর্থপ্রাপ্তি ঘটে সেটা খুবই আনন্দের।
*এ তো গেল প্রাপ্তির কথা। জীবনে অপ্রাপ্তি আছে?
অপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে একটু অন্য কথা বলি। নিজের জীবন, নিজের দেশকে আমি ভীষণ ভালবাসি। চিরকাল ভেবে এসেছি, মানুষগুলোই হচ্ছে দেশ। তবে এখন পরিণত বয়সে এসে মনে করি, মাটিটাই দেশ। সমুদ্র, জঙ্গল, পাহাড়, সমতলভূমি, পার্বত্যভূমি ইত্যাদি এবং নানারকম ঋতু নিয়েই আমাদের দেশ। কয়েকজন তাকে উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছে। এই দেশের নানা জায়গায় বিভিন্ন নরগোষ্ঠী আছে। তাদের ভাইবোন মনে না করলেও, সঙ্গী বলে মনে করি, সহযোগী বলে মনে করি। তাদের প্রতি গভীর ভালবাসা রয়েছে আমার। কিন্তু আসল দেশ বলতে মলয়জশীতলাং শস্যশ্যামলাং মাতরম্। মা বলি বা না-বলি, এই কনসেপ্টটাকে ভালবাসি। জানি না এখানকার প্রকৃতি সাইবেরিয়া বা সাহারার মতো হলে ভালবাসতে পারতাম কি না। আমার দেশের রূপ আমাকে বিহ্বল করে তোলে। এত সমস্যা, এত নষ্টামি, তবু আমরা কিন্তু খেতে পাচ্ছি। ভারতবর্ষ সত্যিই সোনার দেশ। প্রচুর সম্পদ রয়েছে এখানে। সঠিক ব্যবহার করলে চিন্তার কিছু থাকত না। কিছু মানুষ দেশটাকে নষ্ট করছে। এটাই কষ্টের। এটাই আমার জীবনের অপ্রাপ্তি। কোনওদিন ভাল কিছু হবে বলে মনে হয় না।
*কখনও কারও প্রশংসা বা সুপরামর্শ আপনার সাহিত্যজীবনকে সমৃদ্ধ করেছে?
আমি খুব প্র্যাকটিক্যাল মানুষ। আবার স্বপ্ন দেখতেও ভালবাসি। স্বপ্ন দেখলেও বাস্তব সম্পর্কে অচেতন নই। ফলে কারও প্রশংসা, পরামর্শ পেয়ে আত্মতৃপ্ত হয়ে গেলাম, তেমনটা কখনও হয়নি। অনেক পড়াশোনার পরে পরিণত বয়সে লেখালিখি শুরু করেছি। তখন থেকেই বুঝতে পারতাম, কোন লেখকের কোন লেখার কোন অংশটা দুর্বল। ফলে নিজের লেখালিখি নিয়েও আমি যথেষ্ট সচেতন থেকেছি। যখনই কোনও অংশ দুর্বল মনে হয়েছে, শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। যখন কেউ এতটা সচেতন থাকে, তখন খারাপ কিছু লেখা তার পক্ষে কঠিন। এই সচেতনতার জন্য অন্যের প্রশংসা বা পরামর্শ কোনওটাই আমাকে সেভাবে ছুঁতে পারেনি। উচ্চমানের নয় এমন লেখার ভূয়সী প্রশংসা শুনতে হয়েছে, পাশাপাশি উৎকৃষ্ট মানের লেখা সম্পর্কে অনেককেই উদাসীন থাকতে দেখেছি। এমন মানুষজনের প্রতিক্রিয়া আমাকে বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বসিত করে না, ভাবায় না।
*বাংলা সাহিত্যে আপনার প্রিয় লেখক কারা?
তালিকা বেশ দীর্ঘ। অনেকেই আছেন। বুদ্ধদেব বসুকে আমার গুরু মানি। ওঁর গদ্যের জন্য। যখন আমি প্রথম লেখালিখি শুরু করি, ওঁকেই আমার মেন্টর মানতাম। আছেন আরও অনেকেই। বলা যায় সমরেশ বসুর কথা। যদিও ওঁর উপন্যাস আমার খুব একটা ভাল লাগে না। কিন্তু ছোট-গল্প অসাধারণ। সুবোধ ঘোষও তাই। উপন্যাসের তুলনায় ওঁর ছোট-গল্প আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে। নগেন্দ্রনাথ মিত্রও আমার খুব প্রিয় লেখক। উপন্যাস এবং ছোট-গল্প দুটোই ভাল লিখেছেন।
*পড়াশোনার জন্য কতটা সময় পান?
আগের তুলনায় পড়াশোনা সত্যি অনেকটাই কমে গেছে। কারণ এখন খুব কম সময় পাই। কমে গেছে ধৈর্যও। সেইসঙ্গে আছে চোখের সমস্যা।
*বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে কতটা আশাবাদী?
সারা পৃথিবীতেই একটা সমস্যা চলছে। বিশেষত শিল্প-সাহিত্যে। সেটা হল এই, সভ্যতাগুলো কেমন যেন বৈচিত্রবিহীন হয়ে যাচ্ছে। একজন আমেরিকান পাঠক যা পড়ছে, একজন বাঙালি পাঠকও তাই পড়ছে। সারা পৃথিবীর মানুষ যদি একরকমের পোশাক পরে, একরকমের খাবার খায়, এক ভাষায় কথা বলে, তাহলে চোখ এবং মন কোনওটারই বৃদ্ধি হয় না। বৈচিত্র নষ্ট হয়ে যায়। তার প্রভাব পড়ে শিল্প-সাহিত্যে। বর্তমান সময়ে ঠিক এটাই ঘটছে। সারা পৃথিবীর মতো এখানেও। ফলে ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা করার মতো জায়গায় এখন আমরা নেই।
*আজ আপনার (Bani Basu) জন্মদিন। কীভাবে পালিত হয় দিনটা?
জন্মদিন পালনের সংস্কার আমাদের বাড়িতে ছিল না। তাই আগে কিছুই হত না। এখন বাড়িতে ছেলেমেয়েরা ঘরোয়াভাবে খাবারদাবারের আয়োজন করে। আর কিছু হয় না। জন্মদিন নিয়ে মাতামাতি আমি বিশেষ পছন্দ করি না। কেউ কেউ শুভেচ্ছা জানান। এইটুকুই।