কেয়া : ভেসে যাওয়া দূরতম দ্বীপ

বাংলা থিয়েটারের প্রতিবাদী চরিত্র ছিলেন কেয়া চক্রবর্তী। দলের জন্য স্বার্থত্যাগ করেছেন। ছেড়েছেন কলেজের চাকরি। গনগনে আগুন ছিল তাঁর মধ্যে। তবে নিভে গিয়েছিলেন অকালে। আগামিকাল, ১২ মার্চ, তাঁর মৃত্যুদিন। স্মরণ করলেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ দাস

Must read

ফ্ল্যাশ ব্যাক : ডাউন মেমরি লেন
মা লাবণ্য চক্রবর্তী মুসৌরি থেকে কিনে এনেছেন শৌখিন শাল। যত্নে আদরে সেটা রেখেছেন আটপৌরে আলমারিতে। হঠাৎ একদিন দেখলেন হাতে নকশা করা সেই শাল আলমারিতে নেই। মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘‘আমার শৌখিন শালটা কোথাও রেখেছিস?” উত্তরে মেয়ে বলল— রিহার্সাল থেকে ফেরার সময় দেখি একটা বুড়ো শীতে কাঁপছে। বৃষ্টি পড়ছে। ওই লোকটাকে আমি শালটা দিয়ে দিয়েছি। মা তুমি কি রাগ করলে?
না, সেদিন দরদি অভিমানী মেয়ে কেয়ার (Keya Chakraborty) উপর রাগ করেননি লাবণ্য।
লাবণ্য-কেয়ার অভিমানের আখ্যান শুরু ১৯৫৭ সালে। লাবণ্য তখন বিএ পরীক্ষা দিচ্ছেন। আর কেয়া স্কুল ফাইনাল দিয়ে কলেজে পড়ছে। বাগবাজারের যে স্কুলে লাবণ্য চাকরি করতেন, কেয়া মাঝে মাঝে সেখানে আসত। মা-বেটি সেখান থেকে গিয়ে বসত শ্যামবাজার কফি হাউসে। ১৯৬৪ সালে তাদের দু’অঙ্কের জীবনের আখ্যান একাঙ্ক-তে বদলে গেল। কেয়ার তখন এমএ পরীক্ষার আর ছ’মাস বাকি। মানসিকভাবে খুব অস্থির হয়ে পড়েছিল ও। জোর করেই লাবণ্যকে তাই বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। সেই থেকে শুরু হয়েছিল মা-মেয়ের একাঙ্ক জীবনে যুগলবন্দি।
কেয়া-র মেয়েবেলা কেটেছে ঠাকুমার স্নেহ-মমতায়। একা একা। মায়ের ভালবাসা পায়নি। বাবা-মায়ের দূরত্বের বাস্তবটা ও দেখেছে। কেয়ার সুখী হওয়া বেশ শক্ত ছিল। ও ছিল আবেগপ্রবণ, আদর্শবাদী, নরম ও অভিমানী। ছোটবেলা থেকে মা না থাকায় একা-একা বড় হয়ে ওঠা, এক দুঃখবিলাসী নারী।

চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি…
তখন কেয়ার (Keya Chakraborty) এমএ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোয়নি। সে চাকরি খুঁজতে শুরু করল। যোগ দিল ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে। আট মাসের চাকরি ছেড়ে এবার চলে এল স্কটিশ চার্চ কলেজে। কলেজে পড়ানোটা নেশা হয়ে উঠল। ছাত্রদের বলতে লাগল— তোমরা ইংরেজি সিনেমা দেখবে, তোমাদের উচ্চারণ একদম ভাল না। নিজে বিসিএল থেকে ওথেলো, হ্যামলেট, জুলিয়াস সিজার নাটকের টেপ করে এনে ছাত্রদের শোনাতে লাগল। ’৭১-এর নকশাল আন্দোলন বদলে দিল কেয়ার ভাবনা। স্কটিশ থেকে ফিরে একদিন মাকে বলল— আমি চাকরি ছেড়ে দেব। আজ কয়েকটা ছেলে এসে আমাদের একটা ছাত্রকে দু’তলা থেকে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দিল। সব শিক্ষক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। কিন্তু কেউ বাধা দিল না। আমি একটু এগিয়ে গেলাম, কিন্তু কে যেন পেছন থেকে আমার আঁচল টেনে ধরল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম মা।

লুকিয়ে ভালবাসব তারে, জানতে দিব না
ভালবাসার কথা শুনলেই কেয়া (Keya Chakraborty) হেসে বলত— ‘‘ভালবাসে? কতটা? প্রাণ দিতে পারে?” এটাই তার ভালবাসার মাপকাঠি। মাকে বা স্বাধীনতাকে যাকেই ভালবাস ‘প্রাণ দিয়ে’ তা প্রতিষ্ঠা করতে হয়। ভালবাসার মধ্যে একটা প্রত্যয়, একটা বিশ্বাস, একটা কমিটমেন্ট আছে। সাধারণ মানুষ সম্পর্কেও কেয়ার ছিল অদ্ভুত এক ভালবাসা। দুঃখ পাওয়া মানুষের সঙ্গে সে একাত্ম বোধ করত। অবশ্য এর শুরুটা ছোটবেলা থেকে।
শিক্ষকতা করতে গিয়েও সেই ভালবাসা। কাজকে ভালবাসা। ছাত্রদের ভালবাসা। যেন ছাত্র-ছাত্রীদের গোটা জীবনের দায়িত্ব তার। থিয়েটার করতে গিয়েও এই ভালবাসাকে কেয়া অগ্রাহ্য করতে পারেনি।

আরও পড়ুন: ভাল কাজ করার জন্য মুখিয়ে আছি

ভাল মানুষের দলে…
স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কেয়া (Keya Chakraborty) অভিনয় করেছে। কিন্তু তার নাটকের প্রধান দল ছিল নান্দীকার। ১৯৬০-এর ২৯ জুন নান্দীকার তৈরি হয়। প্রথমদিকে নান্দীকারের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। ‘বিদেহী’, ‘সেতুবন্ধন’ — এসব প্রযোজনা তেমন টাকা তুলতে পারেনি মঞ্চ থেকে। ফলে দলের আর্থিক সংকট দেখা দেয় শুরুতেই। এই শুরুর পর্বে কেয়া ছিল নান্দীকারের মুশকিল আসান। ১৯৬১-তে নান্দীকার নামায় তাদের নতুন নাটক ‘চার অধ্যায়’। অজিত তখন অন্তু আর কেয়া এলা। অত্যন্ত কঠিন ছিল এই নাটক। বিশেষত শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্রের বহুরূপীর অসাধারণ প্রযোজনার পরও নান্দীকারের মতো একটা নতুন দলের পক্ষে এটা দুঃসাহসের কাজ ছিল। কিন্তু তাদের অভিনয় এতই ভাল হয়েছিল যে, ৮টি আমন্ত্রিত শো পেয়েছিল। আর্থিক দিক থেকে এটি ছিল সফল প্রযোজনা। এর ফলেই নান্দীকার ঋণমুক্ত হয়। এর পরের নাটক ‘বদনাম’ ও ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র’। এই সময় পরীক্ষার কারণে কিছুদিন কেয়া নান্দীকারে অভিনয় করেনি, পরে আবার শুরু করে।
কেয়া বিশ্বাস করত গ্রুপ থিয়েটারের কাজ শুধু অভিনয় নয়, একটা আন্দোলনের সঙ্গী হওয়া। ভাল শিল্পী তো হতেই হবে। সেই সঙ্গে ভাল নাট্যকর্মী-ভাল কমরেডও। থিয়েটারের যে-কোনও কাজে কেয়া সবার আগে এগিয়ে যেত, সে-কাজ যত শক্ত হোক বা শ্রমের হোক। কী না দেখত কেয়া! প্রচারের কাজ, হিসেবের কাজ, পোশাক বা সহ-নির্দেশনার কাজ— দলের সব কাজই ও করত নিখুঁতভাবে। অপরিণত সদস্যদের তৈরির অদৃশ্য দায়িত্ব ছিল ওর উপর। নান্দীকারের লাইব্রেরি তৈরির দায়িত্ব ছিল তার উপর। বেসুরো সদস্যদের গলাতেও সুর আনার চেষ্টা করত। দলের জন্য বহু স্বার্থত্যাগ রয়েছে তার। কলেজের চাকরি ছেড়েছে। সংকটের দিনে ব্যক্তিগত দায়ে হাজার হাজার টাকা জোগাড় করেছে। মায়ের গয়না বন্ধক দিয়েছে। ভাঙন দেখা দিলে জীবনকে বাজি রেখে তা রোখার চেষ্টা করেছে।
বারবার দল ভাঙতে বসেছে। রঙ্গনার আমলে একদিন নান্দীকার পুরো ভেঙে গিয়েছিল। রাত বারোটার সময় অজিত অর্থাৎ অজিতেশের বাড়িতে গিয়েছিল কেয়া, রুদ্রপ্রসাদ ও সুব্রত। রাত ন’টা থেকে বারোটা চলল তর্ক-আলোচনা। বোঝাপড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে কেয়া। ফাইনাল রাউন্ড অজিতের বাড়িতে। রাত তখন তিনটে। মীমাংসা হল নিজেদের। কেয়ার প্রাণে তখন অনন্দের তুফান উঠেছে। হেঁটে বেরিয়ে পড়ল রাতের কলকাতা দেখবে বলে।

আমার প্রতিবাদের ভাষা— প্রতিরোধের আগুন
নান্দীকারকে শুধু শ্রম দেয়নি, হৃদয় দিয়েছিল কেয়া। ‘ভালোমানুষ’-এ শান্ত মেয়ে শান্তা আর দৃঢ়পুরুষ শান্তপ্রসাদ— চমকে দিয়েছিল দর্শকদের। ‘তিন পয়সার পালা’, ‘আন্তিগোনে’ কেয়াকে চেনাল অন্য রূপে।
বুকের রক্ত দিয়ে ‘রঙ্গনা’ তৈরি করার পর যেদিন কেয়া-অজিতেশ-রুদ্রপ্রসাদ মহড়া দিচ্ছিল তাদের নতুন নাটক আন্তিগোনের, সেদিনই হলের মালিক তাদের লটবহর, সেট সব রাস্তায় নামিয়ে দেয়। পুলিশের চোখের উপর মালিকের পোষা গুন্ডারা যখন রুদ্রপ্রসাদের গায়ে হাত তোলে, শাসানি দেয়, সেদিন অস্ত্রহীন কেয়া ওই লুটেরাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির সময় কার্জন পার্কে প্রতি শনিবার প্রতিবাদের নাটক অভিনয় হত। পুলিশ এসে তরুণ প্রবীর দত্তকে পিটিয়ে মেরে ফেললে এক চোখে আগুন আর অন্য চোখে জল নিয়ে কেয়া কীভাবে বাদল সরকারের নাটক ‘মিছিল’-এ শামিল হয়েছিল, তা আজকের নাট্য-আন্দোলনে এক ইতিহাস।
প্রতিবাদ ছিল কেয়ার চরিত্রে। সমাজের কুৎসা শুনে ও হাসত চিবুক উচু করে অগ্রাহ্যের ভঙ্গিতে। কেয়া বলত— স্টেজের ওপর উঠে যখন অভিনয় করি তখন লোকে আমায় মেনে নেয়। কিন্তু থিয়েটার সেরে মধ্যরাতে যখন বাড়ি ফিরি, তখন লোকে আমায় মেনে নিতে পারে না। আর তারা মানতে পারে না বলেই পরিচিত লোকজন দেখলে আমায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে পুরুষটি থাকে, ইচ্ছে করেই তার কাঁধে হাত রাখি। জনগণ যাতে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে দেখে আনন্দ পায়।

কই মা, সত্যজিৎ রায় তো আমায় ডাকল না
অভিনয় কেয়ার (Keya Chakraborty) রক্তে। বাংলার রঙ্গমঞ্চে জনপ্রিয়তার শীর্ষে কেয়া। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মঞ্চ। এমন অভিনেত্রীর জন্যে সিনেমার ডাক আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক। অনেক পরিচালক তাকে সিনেমায় নামার আবদার করেছে। ও সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে— নো মিনস নো। শুধু বলত— সত্যজিৎ রায় যদি আমাকে ডাকে, তো আমার একটা সিনেমা করার ইচ্ছে আছে। ২৮-২৯ বছর বয়সেও কেয়া মাঝে-মাঝে মাকে বলত— কই মা, সত্যজিৎ রায় তো আমায় ডাকল না!
পরে অবশ্য ও প্রথম সিনেমা করে ‘যে যেখানে দাঁড়িয়ে’। অবশ্য তার আগে মৃণাল সেনের একটা ছবিতে ছোট্ট একটা কাজ করেছিল। ‘প্রণয়পাশা’ ছবিতে নামার তার প্রধান কারণ ছিল মায়ের পেসমেকার। টাকা নেই। ৭৪-এ কলেজ ছেড়েছে। ৭৫-এ পেসমেকার বসাতে হয় মায়ের।

জীবন যেরকম…
যে অভিনয় কেয়াকে জীবন দিয়েছিল, সেই অভিনয় ওকে জীবন থেকে ছুটি দিল।
১২ মার্চ গঙ্গাবক্ষে এপিটি মধুরা লঞ্চে এসআরবি প্রোডাকশনের ‘জীবন যেরকম’ ছবির শ্যুটিং চলছে। দুপুর তখন প্রায় তিনটে। ছবিতে একটা দৃশ্য ছিল— একজন অন্ধ মহিলা তার হারানো ছেলেকে খুঁজতে গিয়ে লঞ্চের আপার ডেক থেকে গঙ্গায় পড়ে যাবে। কেয়া সেই অন্ধ মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করছিল। তাকে খরস্রোতা জোয়ারের মধ্যে উপরের ডেক থেকে লাফিয়ে পড়তে বলা হয়। কেয়া সাঁতার জানত না। দৃশ্যটি যাতে অবাস্তব না হয়, সেজন্যে তার পরিবর্তে কোনও ডামিকে নেওয়া হয়নি। কেয়াকে ঝাঁপ দিতে বলা হলে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তলিয়ে যায় গভীর জলে। পরদিন তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
শ্মশানে কেয়ার ফুল-চন্দনে সাজানো দেহের সামনে অজিত কেঁদে চেঁচিয়ে উঠল— ‘‘কেয়া তোমায় ভুলব না।” সঙ্গে সঙ্গে সবাই একসঙ্গে শোক-গর্জনে ফেটে পড়ল— ‘‘কেয়াদি, তোমায় ভুলব না, তোমায় ভুলব না। তোমায় আমরা ভালবাসি।” এবার আর কেয়ার সেই উত্তর পাওয়া গেল না— ‘‘ভালবাসা? কতটা? আমার জন্যে প্রাণ দিতে পারো?”
কেয়া এখন ভেসে যাওয়া এক দূরতম দ্বীপ। এ-দ্বীপে অজিত নেই। ব্যোমকেশ নেই। নেই রুদ্রবীণার ঝঙ্কার। নেই সত্যজিতের ফেলুদাও। তাই অপরাধী খোঁজার দায়ও নেই।

Latest article