অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়
[১]
“ওই দেখ, ওই দেখ।”
“বাব্বা, ঢং দেখে আর বাঁচি না।”
“লজ্জা-শরমের মাথা খেয়েছে একেবারে। মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার বয়স হয়ে গেল আর উনি এখন ছেলে কোলে করে ঘরে ঢুকছেন।”
“তুই জানলি কী করে ওর ছেলেই হয়েছে?”
“সেদিন মনুর দোকানে ডাল কিনতে গেছিলাম। ওর ছোট মেয়েটাকে দেখলাম হাগিস কিনছে। জিজ্ঞেস করতে বলল, ভাই হয়েছে।”
“ছেলের শখ সবাইয়েরই থাকে, তা বলে এই বয়সে আবার একটা বাচ্চা!”
“সেই যখন বাচ্চা নিল তখন একটু আগে নিলেই পারত, এখন তো ওই ছেলে মানুষ করতে গিয়ে জান কয়লা হয়ে যাবে।”
“উফ! তোরাও না, সেই তখন থেকে কেন বাচ্চা নিল, কেন বাচ্চা নিল— এই করে যাচ্ছিস। হয়তো বাচ্চা নিতে চায়নি। মনের সুখে মাছ খাচ্ছিল, তারপর দেখল গলায় কাঁটা ফুটে গেছে!”
আরও পড়ুন-ভক্তি আন্দোলনের দুই যুগপুরুষ
“উফ, তুইও না! পারিস বাবা। সারাদিনে দুটো নোংরা কথা না বললে তোর পেটের ভাত হজম হয় না।”
“সত্যি! একেই বলে ভাগ্য। আমার বর তো এখন আর আমার দিকে ফিরেও দেখে না। এই, তোদের বরেরা দেখে?”
“দরকার পড়লেই দেখে। তবে আমার আর এখন ওসব একটুও ভাল লাগে না। খুব কষ্ট হয়।”
পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে টাইম-কলের লাইনে বিভিন্ন সাইজের আধময়লা সস্তা পলিথিনের শেষ হয়ে যাওয়া নরম পানীয়ের বোতল হাতে অপেক্ষারত প্রতিবেশিনীদের বলা কথাগুলো সবই কানে এল পূর্ণিমার। পূর্ণিমাকে দেখে অনেকদিন পর ওরা একটা নতুন গল্পের খোরাক পেয়েছে, না হলে কে আগে জল নেবে তাই নিয়ে এখন ঝগড়া করত।
আরও পড়ুন-বিয়ের স্বীকৃতি চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে চার সমলিঙ্গ দম্পতি
পূর্ণিমাদের গলিটা এত সরু যে রিকশা ঢোকে না। পাছে চেনা কারও প্রশ্নবাণের মুখে পড়তে হয় তাই তপন ওকে পিছনে ফেলে দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়েছে বেশ খানিকটা পথ। কাঁথায় মোড়া দশ দিনের ছেলেটাকে কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে বাসার দিকে এগিয়ে যায় পূর্ণিমা। ওর মনে এখন অনেক সংশয়। ছোট মেয়েটা অনেকটাই ছোট, সে হয়তো কিছুই জানতে চাইবে না। হাত-পা নাড়া পুতুলের মতো ছেলেটাকে দেখে খুশিই হবে। কিন্তু মেজ মেয়েটা? সে তো সব বোঝে। সে যদি কিছু জানতে চায়? যদি কিছু অপ্রিয় প্রশ্ন করে? তার কি জবাব দেবে পূর্ণিমা?
বাইরের লোককে তবু উপেক্ষা করা যায়, এড়িয়ে যাওয়া যায় তাদের। কিন্তু যারা খুব কাছের, যারা সারাক্ষণ কাছেই থাকে, তাদের কি অত সহজে উপেক্ষা করা যায়? এড়িয়ে যাওয়া যায় তাদের তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি?
আরও পড়ুন-আর কত দেখব! ডিএ প্রাপ্তি সাংবিধানিক অধিকার হল কবে?
[২]
“স্যার, আজ ছেড়ে দিন। আজ আমার শরীরটা তেমন ভাল নেই। সকাল থেকে পেটে খুব ব্যথা হচ্ছে।”
কোনও লাভ হবে না জেনেও আর একবার কাতর কণ্ঠে অনুরোধ জানায় বৈশাখী। সত্যিই আজ সকাল থেকে ওর শরীরটা খুব খারাপ। তলপেটে একটা ঝিম-ধরা ব্যথা। জলখাবারে রোজকার মতো আজও সেই রুটি, আলু চচ্চড়ি। কিন্তু খাবারটা দেখেই আজ গা-টা কেমন গুলিয়ে উঠল। কিছুই আর খেতে ইচ্ছা করল না। কিন্তু স্যারকে এসব কথা বলে কোনও লাভ হবে না। মাস তিনেক হল স্যারের বউ বাপের বাড়ি চলে গিয়েছে। বাচ্চা হবে। স্যার ছুটির দিনে শ্বশুরবাড়ি যায় বউকে দেখতে। আর বাকি দিনগুলোতে যখন ইচ্ছা হয় তখন পড়াবার নাম করে বৈশাখীকে ডেকে নেয়।
লম্বা একটা নিঃশ্বাস নেয় বৈশাখী। ইচ্ছা থাকলেও স্যারকে বাধা দিতে পারে না ও। মন কিছুতেই মানতে চায় না এসব, কেমন একটা পাপবোধ জাগে কিন্তু ওর কৈশোর- উত্তীর্ণ শরীরটা? সেটা যে শুধু স্যারকেই কাছে পেতে চায়। ও’ও তো অপেক্ষায় থাকে কখন স্যার ওকে কাছে ডেকে নেবে।
কিন্তু আর ক’দিনই বা এভাবে চলবে? বাচ্চা হয়ে যাওয়ার মাস কয়েক পরেই তো স্যারের বউ আবার স্যারের কাছে ফিরে আসবে। স্যারের বউ যখন ফিরে আসবে তখন কী হবে ভাবলেই বুকের ভেতরটা হু-হু করে ওঠে বৈশাখীর।
আরও পড়ুন-হংকং ফ্লু নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে সতর্কবার্তা কেন্দ্রের
[৩]
জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই অভাব কখনও পিছু ছাড়েনি পূর্ণিমার। বিয়ের আগে অবধি চোখে অনেক রঙিন স্বপ্ন ছিল, মনের কোণে অনেক আশা ছিল বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে; কোনও মধ্যবিত্ত সচ্ছল পরিবারে বিয়ে হবে ওর। কিন্তু পূর্ণিমার সব স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গেল। বিয়ের পরেও আর্থিক অনটন পিছু ছাড়ল না।
প্রথম প্রথম তপনের সীমিত আয়ে বেশ ভালই চলছিল ওদের দু’জনের সংসার। কিন্তু কোলে যখন বড় মেয়েটা এল তখন থেকেই আবার শুরু হল দু’প্রান্ত মেলাবার টানাপোড়েন। তবুও যদি একটাই সন্তান থাকত তা হলে হয়তো একদিন সুখের মুখ দেখবার সুযোগ থাকত। কিন্তু তখন ওদের জোয়ান বয়স তার ওপর তপনের ছিল পুত্রসন্তানের পিতা হওয়ার আশা, তাই ইচ্ছা না থাকলেও আরও দু’বার সন্তানের জন্ম দিতে হল পূর্ণিমাকে।
বড় মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় বেশ ভাল ছিল। প্রতি বছর ভাল ভাল নম্বর পেয়ে ক্লাসে উঠত। তপন চেয়েছিল মাধ্যমিক পাশ করলেই একটা ভাল ছেলে দেখে মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দেবে। কিন্তু পূর্ণিমা চাইত মেয়েটা আরও কিছুদূর পড়ুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক। তাই তপনের অনেক মুখনাড়া শুনেও পলিটেকনিক পড়তে পাঠিয়েছিল মেয়েটাকে। কলেজ এখান থেকে অনেক দূরে। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতে হবে। খরচ অনেক তবুও অনেক জোরাজুরি করে রাজি করিয়েছিল তপনকে। কিন্তু শেষ অবধি? না, শেষ অবধি আর শেষরক্ষা হল না। বাইরে পড়তে গিয়ে শেষকালে পেট বাধিয়ে বসল মেয়েটা।
আরও পড়ুন-সভ্যতাগুলো কেমন বৈচিত্রবিহীন হয়ে যাচ্ছে
খবরটা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল পূর্ণিমার। তারপর মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে পেট খসাতে গিয়ে যা শুনল তাতে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল ওর। মেয়ে ব্যাপারটা চেপে রেখে পাঁচ মাস কাটিয়ে ফেলেছে তাই এখন আর কিছুতেই কিছু করা যাবে না। গর্ভপাত এখন আইনত অপরাধ।
দোষী ছেলেটার সঙ্গে মেয়ের বিয়েও দেওয়া যাবে না। এই কাণ্ডটা ঘটিয়েছে মেয়ের বউ-বাচ্চাওয়ালা মাস্টার। প্রথম প্রথম তার কথা অনেক শুনত মেয়ের কাছে; স্যার পড়ানোর জন্য কোনও টাকাপয়সা নেয় না, মাঝে-মাঝেই আলাদা করে ডেকে পড়া বুঝিয়ে দেয়। তখন একটু সন্দেহ হয়েছিল পূর্ণিমার। শুধু শুধু এত দরদ কেন মেয়ের ওপর? কিন্তু ওই মাস্টারটাকে ছাড়িয়ে নতুন মাস্টার রাখলে তো আবার নতুন করে মাইনের টাকা গুনতে হবে। আর্থিক সুবিধার কথা ভেবে সোমত্থ মেয়েটাকে আর সাবধান করা হয়ে ওঠেনি পূর্ণিমার।
আরও পড়ুন-সভ্যতাগুলো কেমন বৈচিত্রবিহীন হয়ে যাচ্ছে
তপন বলেছিল থানায় যাবে, কেস করবে মাস্টারের নামে, বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস। ধর্ষণের মামলায় সাত বছর জেল খাটাবে মাস্টারটাকে। কিন্তু পূর্ণিমা তো জানে ওর মেয়ের সঙ্গে যেটা হয়েছে সেটা আর যা-ই হোক ধর্ষণ কখনওই নয়। যদি ধর্ষণ হত তাহলে তো মেয়ে প্রথমেই বাধা দিত। আর কাউকে না জানালেও পূর্ণিমাকে নিশ্চয়ই জানাত। তাহলে আর শুধু শুধু লোক-জানাজানি করে লাভ কী। থানায় ডায়েরি করলে ধড়পাকড় হবে, হয়তো খবরের কাগজে ছেপে বের হবে মেয়ের খবরটা। সবাই অনেক সহানুভূতি জানাবে। মানবাধিকার রক্ষা, মেয়েদের অধিকার রক্ষা করার জন্য যেসব এনজিও আছে তাদের প্রতিনিধিরা আসবে, সুবিচার পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেবে। কিন্তু তারপর? তারপর কী হবে? যেখানে আদালতের নিরিখে প্রকৃত প্রমাণের অভাবে গণধর্ষণকারীকে শাস্তি দিতে বছরের পর বছর লেগে যায় সেখানে কীভাবে সুবিচার পাবে পূর্ণিমার মেয়ে?
আরও পড়ুন-চাপ সামলাতে শিখেছি : ইগা
তার চেয়ে এই ভাল। ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার আগেই এক নিঃসন্তান দূর-সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে চলে গিয়েছিল পূর্ণিমা। শর্ত ছিল মেয়ের বাচ্চাটা একটু বড় হলে ওদের দিয়ে দিতে হবে, ওরা দত্তক নেবে বাচ্চাটাকে।
এখন মেয়ের ছেলেকে বড় করতে গিয়ে পূর্ণিমার আর্থিক অনটন আরও একটু বাড়বে, কিন্তু মনে একটা আশা থাকল; বড় মেয়ে বৈশাখী হয়তো আবার মন দিয়ে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে।
অঙ্কন : শংকর বসাক