মনে পড়ে কমরেড, সেই দিনগুলোর কথা। হাজরা মোড় থেকে চমকাইতলা। গোঘাট, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, ডানকুনি। মার, অপমান, পাঁজাকোলা করে রাইটার্স থেকে গলা ধাক্কা। ৩০ বছর আগে ধর্মতলায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিসের গুলি। মৃত্যুমিছিল। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে এসেছে প্রতিনিয়ত। রাজ্যের বহু এলাকায় সেসময় বিরোধীদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। হ্যাঁ, আজ গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে চাপিয়ে আসর জমানো বামেদের আমলে।
মনে করিয়ে দিই জগাই মাধাই গদাইদের, জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চলার পথ কোনওদিনই গোলাপ ছড়ানো ছিল না। কণ্টকাকীর্ণ পথে ‘একলা চলো’র সুরেই তাঁর অগ্রগমনের স্থায়ী-অন্তরা আগাগোড়া বাঁধা। মনে রাখবেন, ২০১১ সালের পালাবদলের যাত্রাপথে ওই একটাই সুর বেজেছে ক্রমাগত। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঈর্ষণীয় সাহস আর ইচ্ছাশক্তির জয় হয়েছে। সেই তার ছেঁড়েনি এখনও। এক পায়ে খেলা হবে থেকে আসন্ন আম্বেদকর মূর্তির পাদদেশের ধর্নামঞ্চ, যে কোনও মুহূর্তে লড়াইয়ের রং বদলে দেওয়ার হিম্মৎ রাখেন জননেত্রী (TMC Supremo Mamata Banerjee)।
শিক্ষায় অনিলায়ন থেকে হোলটাইমারদের পরিবার-পরিজনের মাস মাইনের স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা। ভোট লুট, বুথের পর বুথ নির্বাচনের সকাল থেকেই বিরোধী এজেন্টদের মেরে বের করে দেওয়ার কথা আজ ১২ বছরের মধ্যেই বিমান বসুরা ভুলে গিয়েছেন, মানুষ ভোলেনি।
ইডি, সিবিআইয়ের অভিযোগ প্রমাণ করে শাস্তি বিধানের শোচনীয় হার তো সবার জানা। বোফর্স মামলা থেকে কোটি কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পালানো নীরব মোদি, বিজয় মালিয়াদের কি ফেরাতে পেরেছে মোদিজির এজেন্সি? কিংবা মৃতপ্রায় দাউদকে টেনে আনতে পেরেছে ভারতে? তাহলে কোথায় তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা? আর নারদ কেলেঙ্কারি? লোডশেডিং অধিকারীর সৌজন্যে সেই তদন্ত আর একটু এগলেই সেমসাইড গোল হয়ে যেতে পারে বলে আজ নারদ নিয়েও নীরবতা! আসলে কোনও মামলায় সিবিআইয়ের অতি সক্রিয়তার এক যুগ পর বোঝা যায় সবটাই প্রভুর নির্দেশে স্রেফ নাটক ছিল। তাই, ইডি সিবিআই নামিয়ে ভোটের বাজার মাত করার চেষ্টা আরও একবার ফ্লপ হওয়ার অপেক্ষায়।
এরই মধ্যে দিল্লির প্রভুরা অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ তৈরি করছেন। নতুন মাত্রা জুড়ছেন তাতে। ২০২৩-এর মার্চের ভরদুপুরে নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছেন হিটলারের নাৎসি জার্মানির স্মৃতি।
আরও পড়ুন: বাম আমলে স্বজনপোষণ, সরকারি নিয়োগে দুর্নীতি ক্রমশ প্রকাশ্যে
হিটলারের রাজনৈতিক শত্রুদের খতম করতেই ১৯৩৩ সালের ২২ মার্চ প্রথম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প তৈরি হয়েছিল জার্মানির দাচাউতে। ইহুদি জাতিটাকে একেবারে মুছে ফেলার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা অ্যাডলফ হিটলার জার্মানির একচ্ছত্র শাসক হওয়ার পরে শুরু করেছিলেন, তারই ফলশ্রুতিতে এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের পত্তন। একদা হেনরি ফোর্ডের মনে হয়েছিল ইহুদিদের জায়োনিস্ট জাল অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরছে গোটা দুনিয়াকে! ইহুদিদের তুলোধোনা করা শুরু করলেন আমেরিকার বিখ্যাত গাড়ি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। ১৯১৯ সালে প্রকাশ করলেন নিজের পত্রিকা ‘দ্য ডিয়ারবর্ন ইনডিপেনডেন্ট’। মাত্র পাঁচ বছরে সেই পত্রিকার সার্কুলেশন গিয়ে দাঁড়ায় ৯ লক্ষ। পত্রিকায় ৯১ পর্বের কলামে ফোর্ড ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরলেন বিশ্বের ইহুদি নেটওয়ার্ক। লিখলেন, ‘ইহুদিরা গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু মেশে না কারও সঙ্গে। তারা লোভী, প্রতারক। আবার তাদের হাতেই অর্থ, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা।’ ফোর্ড-এর কলামগুলি নিয়ে রাতারাতি চার খণ্ডের বই বাজারে চলে এল। বইয়ের নাম ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল জিউ।’
২০২৩ দেখাচ্ছে, একই কায়দায় সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়ানোর আয়োজন করছেন মোদি-শাহরা। দিকে দিকে ‘গেল গেল’ রব তুলে বিদ্বেষ বিষ ছড়ানোর চেষ্টা চলছে অবিরত। খবরের কাগজ থেকে বই, রাজনৈতিক আলোচনার মঞ্চ থেকে কলেজ-বিশ্ব বিদ্যালয়ের সিলেবাস, সর্বত্র বিদ্বেষের বীজতলা তৈরির মরিয়া চেষ্টা চলছে একেবারে হিটলারি কায়দায়। একই সঙ্গে চলছে বিরোধী কণ্ঠকে জেল হাজতের ভয় দেখানো, সমালোচনার স্বরকে চিরতরে নীরব করার ব্যবস্থা। এজেন্সি নামিয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার নোংরামি। অপপ্রচার ছড়িয়ে ভাবমূর্তিতে কালি লাগানোর উদ্যোগ।
প্রকল্পরূপায়ণে বেনিয়ম খুঁজে বের করার নামে কেন্দ্রীয় সরকার পরের পর অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন করে চলেছে। কিন্তু প্রতিটি পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও রাজ্যের ন্যায্য প্রাপ্য মেটানো হচ্ছে না। বঞ্চনার সমস্ত সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে মনরেগার ক্ষেত্রে। ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে ৩০ কোটি শ্রমদিবস সৃষ্টির পরিকল্পনা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আগামী অর্থবর্ষও শুরু হতে যাচ্ছে এক সপ্তাহ বাদে। সব রাজ্যের নতুন বছরের বরাদ্দ অনুমোদন করা হলেও একমাত্র বাংলার ক্ষেত্রেই তা আটকে দেওয়া হয়েছে। অথচ এবার ৩২ কোটি শ্রমদিবস সৃষ্টির পরিকল্পনা রয়েছে রাজ্যের। সব মিলিয়ে মোদি সরকারের যা মতিগতি তাতে বাংলার মানুষের সামনে থেকে দু’বছরে মোট ৬২ কোটি শ্রমদিবস কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা কেন? বাংলার মানুষের একমাত্র অপরাধ বোধ হয় একটাই, তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যে বসবাস করেন? গেরুয়া শিবিরের একুশের স্বপ্নভঙ্গের প্রতিশোধ নিচ্ছেন দিল্লিওয়ালারা!
স্বৈরাচারী শাসককে মদত দিতে কোমর বেঁধে নেমেছে ৩৪ বছর ধরে রাজ্যেটাকে শেষ করা বামেরা। আর সেইসঙ্গে কালীদাস কংগ্রেস। জগাই মাধাই আর গদাইদের যৌথ তাণ্ডবে সন্ত্রস্ত বাংলা। সবার টার্গেট একটাই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেস।
এই আবহে শুধু একটা কথা মনে করিয়ে দিই। একুশ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে গেল-গেল রব তুলেছিল বিরোধীরা। ভাবটা এমন, যেন ক্ষমতা দখল হয়েই গিয়েছে। ফল বেরলেই রাজভবনে গিয়ে শপথ নেওয়ার অপেক্ষা। নেত্রীকে (TMC Supremo Mamata Banerjee) পেড়ে ফেলতে দু’বছর আগেও রাম-বাম সব একজোট হয়েছিল। কাঁচরাপাড়া থেকে কাঁথি, উত্তরপাড়া থেকে শিবপুর, মিলেছিল ক্ষমতা দখলের ডাকে। উল্টোদিকে ভাঙা পায়ে তিনি একা। দেদার টাকার খেলা, নিত্য দল ভাঙা ও যোগদান করানোর মেলা। কলকাতা থেকে জেলার সব প্রথম সারির হোটেল ভাড়া করে বহিরাগত নেতাদের মোচ্ছব, কী দেখেনি বাংলার মানুষ। শুধু প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিলেই সত্তরটারও বেশি সভা করেছিলেন। কিন্তু ফল বেরতে দেখা গেল দু’শো আসন দূর অস্ত! একশোর আগেই থেমে গিয়েছে বিজেপি। কংগ্রেস ও বামেরা রক্তশূন্য। ‘গেল গেল’ রব ওঠা তৃণমূলই রেকর্ড আসন জিতে ফের ক্ষমতায়। ২০১৬ সালে মাঠেই ছিল না বিজেপি। সেবার নেত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বাম ও কংগ্রেস জোট করেছিল। বিমানবাবুদের গলায় সে কী প্রত্যয়। যেন ক্ষমতায় ফেরা হয়েই গিয়েছে। কিন্তু মানুষ ৩৪ বছরের অত্যাচারের কথা মনে রেখে বামেদের সেবারও শূন্য হাতেই ফিরিয়ে দেয়।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এবারও বোধ হয় সময়ের অপেক্ষামাত্র।