কবি-সাহিত্যিকদের কল্পনায় আকাশ এক স্বপ্ন। সুখ, দুঃখের, হাসি, কান্নার, প্রেম-বিরহের বিচিত্র হাওয়ামহল হল আকাশ। সে কখনও প্রেয়সী, কখনও মা, কখনও মিত্র, কখনও নিদারুণ একাকিত্ব, কখনও বিস্তৃত-হৃদয়। কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক আকাশচর্চা আসলে তা নয়। আকাশকে চেনা তার চেয়েও কিছু বেশি। আকাশের থিয়োরিটিক্যাল, প্র্যাকটিকাল রয়েছে। আকাশের একটা গোটা মহাকাশ রয়েছে। আকাশকে পড়াশোনা করে জানতে হয়, চিনতে হয়, বুঝতে হয় তবেই খোলসা হয় গ্রহ-নক্ষত্রের মাঝের রসায়ন। স্বপ্নের নয়— বাঙালিকে সেই আসল আকাশটি চিনতে শিখিয়েছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী সৌমেন মুখোপাধ্যায় (Soumen Mukherjee)।
এখন প্রশ্ন জ্যোতির্বিজ্ঞান কী?
মহাজাগতিক বস্তু বা ঘটনাবলি, গ্রহ, উপগ্রহ, চাঁদ, তারা, নীহারিকা গ্যালাক্সি, ধূমকেতু— এই সবই অ্যাস্ট্রোনমি বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্তর্গত। সৌমেন মুখোপাধ্যায় (Soumen Mukherjee) ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের সেই শিক্ষক যিনি সহজ-সরল ভাষায় আকাশকে চিনতে শিখিয়েছিলেন। গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে, অক্লান্তভাবে সাধারণের মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চাকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে অথচ প্রচারের আলো তেমন পড়েনি তাঁর ওপর।
পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়া কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল না। শৈশব থেকেই আকাশের প্রতি ছিল অদম্য আকর্ষণ। আকাশ ভালবাসতেন। মহাজাগতিক বিষয়গুলি নিয়ে ভাবতেন।
যখন জ্যোতির্বিজ্ঞানী নন
সৌমেন মুখোপাধ্যায় তখন জ্যোতির্বিজ্ঞানী নন, স্কুল ছাত্র। স্থানীয় দ্বারকানাথ বিদ্যাপীঠে পড়তেন। খুব মেধাবী। বাবা নৃপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং মা সুধালতা দেবী। তাঁদের দুই সন্তান বড় সৌমেন এবং ছোট দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। যুবক সৌমেন (Soumen Mukherjee) ছিলেন দুর্দান্ত সাঁতারু। একাধিক মেডেল পেয়েছেন সাঁতারু হিসেবে। যাদবপুরে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান কিন্তু থার্ড ইয়ার সম্পূর্ণ করতে পারেননি। পড়াশুনো ছেড়ে সক্রিয়ভাবে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এই সময় দীর্ঘদিন গ্রামে ছিলেন। নকশাল আন্দোলনের সময় তাঁকে চার বছর জেলও খাটতে হয়েছে। সেখানে জুটেছে পুলিশের নির্যাতনও। এরপর ছাড়া পেয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে তখন থেকেই সুনাম কুড়িয়েছেন। প্রচুর ছাত্র পড়াতেন। এই সময় থেকেই তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞানের যাত্রা শুরু। আশির দশক থেকে অ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে পড়াশুনো শুরু করেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চার শুরু
কলকাতার জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চার অগ্রণী সংগঠন ‘স্কাই ওয়াচার্স অ্যাসোসিয়েশন’ ১৯৭৮ সালে ছিল ফুলবাগানে। ১৯৮৬ সালে হ্যালির ধূমকেতু আগমনের সূত্রে তিনি এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। পরে এটি চলে আসে ঢাকুরিয়ার বেণী ব্যানার্জি অ্যাভিনিউতে, সৌমেনবাবুর বাড়িতে। এই অ্যাসোসিয়েশনের কাজ ছিল মূলত আকাশ চেনা, জানা, আকাশে যা কিছু ঘটে তা দেখা, সেগুলো নিয়ে প্রচার এবং প্রসার। সেই সূত্রেই বিভিন্ন সেমিনার, ওয়ার্কশপ করানো, স্কাইওয়াচিং ক্যাম্প করে আকাশ দেখানো, ঘটে যাওয়া বিভিন্ন মহাজাগতিক ঘটনার পাবলিক শো ইত্যাদির মাধ্যমে গ্রহের আসল রূপরেখা চেনানো, মানুষকে গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে বহু পুরাতন কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া ছিল সংগঠনের উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন- সংসদে আম্বেদকর মূর্তির সামনে কাল ধরনায় তৃণমূল
শখের অ্যাস্ট্রোনমার
এই স্কাই ওয়াচার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রাণপুরুষ হয়ে উঠেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞান সাধক সৌমেন মুখোপাধ্যায়। সহজ ভাষায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারতেন অনর্গল। মহাকাশ-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের উপর কাজ করতেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে এমন অনেক কিছু রয়েছে যা আমাদের জানা-চেনার বাইরের। প্রফেশনাল অ্যাস্ট্রোনমাররা সেইসব বিষয় নিয়ে কাজ করেন না, তাঁদের কাছে নিজস্ব গবেষণাটাই গুরুত্ব পায়। সেই অজানা অনেককিছু চেনা তা নিয়ে পড়াশুনো, বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ যা বিভিন্ন জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণাতে কাজে লাগে সেই কাজগুলি অ্যামেচার অ্যাস্ট্রোনমাররা খুব নিপুণভাবে করেন। সৌমেন মুখোপাধ্যায় ছিলেন এমনই একজন শখের অ্যাস্ট্রোনমার। যিনি মহাকাশের এমন অনেক অজানা রহস্যভেদ করেছিলেন। আমেরিকার অ্যাভসো (AAVSO) নামক অর্গাইনেজেশনের সদস্য, ছিলেন। মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন ডেটা তিনি পাঠাতেন সেখানে। নাসাতেও বেশ কিছু তথ্য পাঠিয়েছেন।
টেলিস্কোপ
এখানেই শেষ নয়। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় তৈরি করেছিলেন একাধিক ছোট-বড় টেলিস্কোপ। প্রথম যে টেলিস্কোপটি তৈরি করেন সেটি ৪ ইঞ্চি। এরপর ৫ ইঞ্চির একটি টেলিস্কোপ তৈরি করেন। তারপর রানা খান ও অন্যদের সহযোগিতায় তৈরি করেন অ্যাসোসিয়েশনের সবচেয়ে বড় ৯ ইঞ্চি টেলিস্কোপ। গোটা জীবনে তৈরি করেছিলেন আরও বেশ কয়েকটি টেলিস্কোপ। সেগুলো জনবিজ্ঞান প্রচারের সময় খুব কাজেও এসেছে। নিজে হাতে টেলিস্কোপ বানানো শিখিয়েওছেন। নক্ষত্রের জীবনচক্র নিয়ে গবেষণা করে গেছেন নিরলস ভাবে।
নিখুঁত পর্যবেক্ষক
খুব সিরিয়াস অবজারভেশন করতেন সৌমেন মুখোপাধ্যায়। মহাকাশের বিভিন্ন ঘটনার সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিখুঁত পরিমাপ ও তথ্য নির্ণয় করতেন তিনি। এই বিষয়ে তিনি ছিলেন সকলের ঊর্ধ্বে— এমন অসাধারণ আর কেউ ছিলেন না। ক্যালেন্ডার নিয়ে লেখা তাঁর বইটি খুব প্রাসঙ্গিক এবং মূল্যবান। টেলিস্কোপ নির্মাণ তো বটেই তিনি ছিলেন নিখুঁত এবং অভিজ্ঞ আকাশ পর্যবেক্ষকও। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হোক, অথবা বৃহস্পতি গ্রহের ওপর টুকরো টুকরো হয়ে শুমেকার-লেভি ধূমকেতুর পতন কিংবা সূর্যের বুকে শুক্র অথবা বুধের সঞ্চরণের মতো বিরল মহাজাগতিক ঘটনা দেখাতে তিনি মাঠে-ময়দানে, মহানগরীর চত্বরে দূরবিন নিয়ে পৌঁছে যেতেন। সঙ্গে থাকত তাঁরই প্রশিক্ষিত ছাত্রেরা। তাঁদের নিয়ে হাজির হতেন জনতার মাঝখানে। তিনি বলতেন, ‘মানুষকে ভুল শেখাবেন না। যা বলবেন সবটা জেনে বলবেন। আপনি কতটা জানেন সেটা বড় কথা নয়, আপনার সেই জানা বিষয় বা সেই জ্ঞান মানুষ কতটা বুঝল সেটাই বড় কথা।’ বিজ্ঞানের মতো বিষয়কে সাধারণের মতো করে উপস্থাপন করাটাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
খুব মৃদু এবং নম্রভাষী এই মানুষটি জনবিজ্ঞান প্রচারের ক্ষেত্রে সকলের বোঝার মতো ভাষায় বক্তব্য রাখতে পছন্দ করতেন। ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দিতেন। বড় বড় বক্তৃতায় যাওয়া উনি পছন্দ করতেন না।
তাঁর লেখা বই
তাঁর লেখা ‘এক আকাশ তারা’, ‘আকাশ দেখার হাতেখড়ি’ (খালি চোখে ও বাইনোকুলারে), ‘আকাশ দেখা’ (টেলিস্কোপে), ‘ক্যালেন্ডার কথা’ ইত্যাদি বইগুলি শিশু থেকে বড়, সকলের জন্যেই সুপাঠ্য। নিজের মতাদর্শকে জীবনে প্রতিফলিত করেছিলেন যা খুব কম মানুষই পারেন। ওঁর সর্বশেষ বই যেটা এখনও ছাপা হয়নি সেটি হল ‘জ্যোতিষ কেন বিজ্ঞান নয়’।
তথ্য সৌজন্য : দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, বাসুদেব ভট্টাচার্য, প্রেসিডেন্ট স্কাই ওয়াচার্স অ্যাসোসিয়েশন