“মহানায়ক আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন”

প্রবীণ সংগীতশিল্পী দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়-সুরে গেয়েছেন দিকপাল শিল্পীরা। তিনিও গেয়েছেন প্রবাদপ্রতিমদের সুরে। দীর্ঘ সংগীত-জীবন। বহু ইতিহাসের সাক্ষী। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

কেমন আছেন?
বয়স ৮৩। যদিও সেটা সংখ্যা মাত্র। শরীরে-মনে মেদ জমতে দিইনি। এখনও বেঁধে চলেছি নতুন নতুন গান। নিয়মিত যাচ্ছি অনুষ্ঠানে। সবমিলিয়ে ভালই আছি।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

গানের জগতে এলেন কীভাবে?
গানের প্রতি আমার ভালবাসা আজন্ম। কলকাতার ভবানীপুরে আমার বড়পিসির বাড়িতে থাকতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছোট থেকেই হেমন্তদার স্নেহ পেয়েছি। ওঁর কাছে বেশ কিছুদিন শিখেছি গান। একটা সময় প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েন। চলে যান বম্বেতে। তারপর তালিম নিয়েছি সুধীরলাল চক্রবর্তী, অখিলবন্ধু ঘোষের কাছে। গান-বাজনার পাশাপাশি চালিয়ে গেছি পড়াশোনা। পেয়েছি অধ্যাপনার চাকরি। হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে। প্রসঙ্গত জানাই, হাওড়ার একটি বর্ষিষ্ণু পরিবারে আমার জন্ম। বাবা কৃষ্ণকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নেতাজি-নেহরুর সহকর্মী। হয়েছিলেন এমপি। মা মাধুরীদেবী। গান গাইতেন। সুচিত্রা মিত্র ছিলেন আমার মাসি।

আরও পড়ুন-ভিডিও ফাঁস, গেরুয়া বাহিনীর হাতে রিভলভার ও তরোয়াল

প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয় কবে?
১৯৬৫ সাল থেকে গাইছি কলকাতা বেতারে। তারপর অডিশনে পাশ করি এইচএমভিতে। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম রেকর্ড। গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কথায়-সুরে। ছিল দুটি গান— ‘যে গানখানি শুনিয়ে যাই’ এবং ‘যে আকাশে ঝরে বাদল’। অসম্ভব জনপ্রিয় হয়। আমার সৌভাগ্য, রেকর্ডে হারমোনিয়াম বাজিয়েছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ স্বয়ং। গান দুটিতে ছিল ক্লাসিকাল ছোঁয়া। শুরু থেকেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে আধুনিক বাংলা গান গাওয়ার ইচ্ছে ছিল। আমার মনের কথা শুনে রেকর্ড কোম্পানির কয়েকজন কর্মী নিরুৎসাহিত করেন। বলেন, ‘মগডালে মই বাঁধার চেষ্টা করছ। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।’ আমি দমে যাইনি। একদিন ফোন করি হেমন্তদাকে। তখন উনি বম্বেতে। জানাই ইচ্ছের কথা। সব শুনে বলেন, ‘কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতায় ফিরছি। দেখা কোরো।’

আরও পড়ুন-গিল ধামাকায় হার্দিকদের জয়

তারপর উনি এলেন?
হ্যাঁ। হেমন্তদা কলকাতায় এলেন। আমার ব্যাপারে কথা বললেন কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। রেকর্ড কোম্পানির যাঁরা আমাকে নিরুৎসাহিত করছিলেন, তাঁদের রীতিমতো ধমক দিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই হেমন্তদার সুরে রেকর্ড করলাম দুটি গান– ‘আমার মনে কী বেদনা’ এবং ‘যদি জানতাম’। গান দুটি লিখেছিলেন মুকুল দত্ত এবং প্রণব রায়। এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। পরে আমার মাসিমা সুচিত্রা মিত্রের তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করি। তারপর থেকে প্রতিবছর বেরোতে থাকে আমার রেকর্ড— শচীন দেববর্মন, রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজকুমার মল্লিক, অনল চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রবাদপ্রতিমদের সুরে।

আরও পড়ুন-ক্রনোলজি বুঝিয়ে অভিষেক বললেন, দিল্লিতে ‘শাহি’ সাক্ষাতেই তৈরি অশান্তির ব্লুপ্রিন্ট

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে আপনার সুরে গেয়েছেন?
হ্যাঁ। খুব কম বয়সে আকাশবাণীতে গীতিকার-সুরকার হিসেবে মনোনীত হই। সিদ্ধান্ত নিই রেডিওয় আমার কথায়-সুরে প্রথম গান গাইবেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আকাশবাণীর প্রেস্টিজিয়াস অনুষ্ঠান ছিল ‘এ মাসের গান’। সেই অনুষ্ঠানের জন্য দুটো গান তৈরি করে হেমন্তদাকে দিই। উনি গান দুটো নিয়ে বম্বে চলে যান। একদিন বম্বে থেকে ফিরে হঠাৎ আসেন আকাশবাণীতে। খোঁজ করেন আমার। সেদিন আমি যাইনি। খবর পেয়ে পরের দিন যাই ওঁর বাড়িতে। নির্ধারিত দিনে হেমন্তদা আকাশবাণীতে এসে রেকর্ড করেন আমার গান। একটি গান গাওয়ার কথা থাকলেও আমার অনুরোধে দুটি গান রেকর্ড করেছিলেন। ‘এ মাসের গান’ অনুষ্ঠানে গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম আমিও। সুর করেছিলেন মান্না দে, উত্তমকুমার, ভি বালসারা। আমার সুরেও মান্না দে কয়েকটি গান রেকর্ড করেছিলেন। তিনি বলতেন, ‘আপনি অধ্যাপক মানুষ। আপনার ভাবনাচিন্তা খুব উঁচু মানের।’ এ-ছাড়াও আমার সুরে গেয়েছেন অখিলবন্ধু ঘোষ, অনুপ জালোটা-সহ বহু শিল্পী। বেতার, দূরদর্শনে। গান তৈরি করেছিলাম লতা মঙ্গেশকরের জন্যও। উনি গাইবেন, কথা হয়েছিল। কিন্তু ওঁর অসুস্থতার কারণে পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়।

আরও পড়ুন-ফের চালু হয়েছে বিজেপির দাঙ্গাবাজি ফর্মুলা! রামনবমীতে অশান্তি নিয়ে বিস্ফোরক অভিষেক

‘বাঘ বন্দী খেলা’ আপনার সুরারোপিত একমাত্র ছায়াছবি। কাজটা এসেছিল কীভাবে?
মহানায়ক উত্তমকুমার এবং সুপ্রিয়াদেবী অভিনয় করেছিলেন ‘বাঘ বন্দী খেলা’ ছবিতে। মহানায়ক আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। ছবির প্রযোজক ছিলেন অসীমা ভট্টাচার্য। একটি কাজের ব্যাপারে তাঁকে আমি বিশেষ সহযোগিতা করেছিলাম। সেটা তিনি মনে রেখেছিলেন। সুযোগ দিয়েছিলেন ‘বাঘ বন্দী খেলা’য়। দুটি গানের সুর করেছিলাম। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন ‘আয় আয় আশমানি কবুতর’ গানটি। লিপ দিয়েছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার। মান্না দে-র কন্ঠে ছিল ‘টুকরো হাসির তোল ফোয়ারা’। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৫ সালে। ছবি এবং গান সুপার হিট হলেও, আর কোনও সিনেমায় সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব আমি পাইনি। কী কারণ, সেটা আজও অজানা। একবার সুচিত্রা সেনকে নিয়ে একটি বাংলা ছবি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। নায়ক হিসেবে ভাবা হয়েছিল সঞ্জীবকুমারকে। গান তৈরির কথা ছিল আমার। কিন্তু শ্যুটিং শুরুর আগেই সঞ্জীবকুমার মারা যান। বন্ধ হয়ে যায় কাজ।

আরও পড়ুন-‘মোদি হটাও, দেশ বাঁচাও’ পোস্টার এবার গুজরাতেই

কবিতা লেখেন। তাই কি কবিতার গানের প্রতি প্রবল আগ্রহ?
ঠিক তাই। গানের পাশাপাশি আমি কবিতাও লিখি। বিভিন্ন কবির কবিতা পড়ি। সলিল চৌধুরীর সুরে আমি রেকর্ড করেছি জীবনানন্দ দাশের কবিতা। যা এক ইতিহাস। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শতাব্দী রায়ের কবিতা আমার সুরেই প্রথম গান হয়। গান করেছি জসীমউদ্দীন, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিমলচন্দ্র ঘোষের কবিতা নিয়ে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ঠিকানা’ কবিতায় সুরারোপ করেছিলেন সলিল চৌধুরী। গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সুকান্তের ওই কবিতায় সুর করেছিলেন সুধীন দাশগুপ্তও। সবার অনুমতি নিয়ে সেই গানটি আমি রেকর্ড করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গান ইংরেজিতে অনুবাদ করে গেয়েছি। সেই রেকর্ডের চাহিদা ভালই।

আরও পড়ুন-ফের চালু হয়েছে বিজেপির দাঙ্গাবাজি ফর্মুলা! রামনবমীতে অশান্তি নিয়ে বিস্ফোরক অভিষেক

পুরস্কারের গুরুত্ব কতটা?
পুরস্কারের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। ‘বাঘ বন্দী খেলা’র জন্য আমি শ্রেষ্ঠ নবাগত সুরকারের পুরস্কার পেয়েছিলাম। পরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পুরস্কৃত এবং সম্মানিত করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমাকে দিয়েছে ‘সংগীত সম্মান’। বাংলা সংগীত মেলায় আমার হাতে পুরস্কার তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ষাট ছুঁই-ছুঁই সংগীত-জীবন। অসংখ্য গান গেয়েছি। পেয়েছি অগণিত মানুষের ভালবাসা। এই ভালবাসা পুরস্কারের থেকে কোনও অংশে কম নয়।

Latest article