পথে এবার…
সম্প্রতি একটি ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছে। ঘটনাটি দক্ষিণ ভারতের কর্নাটকের। সেখানকার একদল পুরুষ প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে যায় একটি মন্দিরে। প্রার্থনা জানায়, যাতে তাদের বিয়ে হয়। জোটে বউ।
বিষয়টি নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। কারও মনে জন্ম দিয়েছে হাস্যরস। তবে ঘটনাটা একেবারেই হালকা ভাবে নেওয়ার মতো নয়। এর মধ্যে দিয়ে ওই অঞ্চলের আর্থসামাজিক সংকটের করুণ ছবি ফুটে উঠেছে।
আরও পড়ুন-ভূমিকন্যা
জোট বাঁধো, তৈরি হও
জানা গেছে, হাঁটার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল ২০০-র বেশি যুবক। পদযাত্রাটি শুরু করেছিল ৩০ জনের একটি দল। শেষ পর্যন্ত অংশ নিয়েছে ৬০ জনের মতো। মূলত যার মধ্যে ছিলেন কৃষক সম্প্রদায়ের যুবকরা৷ বাকিরা দূরে সরে থেকেছে। চক্ষুলজ্জায়। সবাই ওই রাজ্যের মান্ডিয়া জেলার বাসিন্দা। কয়েক দশক ধরেই ওখানে নারী-পুরুষের অনুপাতের পার্থক্য বেড়েই চলেছে। তার জন্য অনেক পুরুষই বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজে পাচ্ছে না।
যারা পদযাত্রায় শামিল হয়েছে প্রত্যেকেই বিবাহযোগ্য। বিভিন্ন বয়সি। হাজার চেষ্টা করেও জোটাতে পারেনি পাত্রী। তাই বাধ্য হয়ে রাজপথে নেমেছে, প্রার্থনা জানিয়েছে মহাদ্বেশাওয়ারা মন্দিরে। তাদের পদযাত্রা অবিবাহিতদের পদযাত্রা বা ব্রহ্মচারিগালু পদযাত্রা নামে পরিচিতি পেয়েছে।
আরও পড়ুন-খেজুরিতে সোমবার সভা মুখ্যমন্ত্রীর
আরও একটি ঘটনা
পাত্রী সংকট দেখা দিয়েছে আগেও। মহারাষ্ট্রের সোলাপুরে। এলাকায় মেয়েদের সংখ্যা নেমেছিল তলানিতে। হতাশায় দিন কাটছিল আইবুড়োদের। বাধ্য হয়ে তারা একদিন বিয়ের পোশাকে রাস্তায় নামে। রীতিমতো মিছিল। দাবি ছিল একটাই, তারা বিবাহযোগ্য, তাই তাদের বিবাহযোগ্যা পাত্রী চাই। কিন্তু পাত্রী পাবে কোথায়? পুরুষ এবং নারীর সংখ্যার অনুপাতের বিচারে দেখা গিয়েছে, প্রতিটি পুরুষের বিয়ে করার জন্য নারী নেই। তাই আইবুড়ো জীবন কাটাতে হচ্ছে। বিষয়টি জনসমক্ষে তুলে ধরতেই পথে মিছিল করতে হয়েছিল অবিবাহিত পুরুষদের। তারা জানিয়েছিল, এলাকায় সার্বিকভাবে মেয়েদের সংখ্যা খুবই কমে গিয়েছে। রয়েছে বিবাহযোগ্যা কন্যার আকাল। রীতিমতো গুলিয়ে গিয়েছে নারী-পুরুষের অনুপাত। তাই মেয়ে খুঁজে দেওয়ার দাবিতে পথে নামা। বিবাহে ইচ্ছুক পুরুষদের ওই দলটির নাম দেওয়া হয় ব্রাইডগ্রুম মোর্চা। বাংলা করলে দাঁড়ায় বিবাহযোগ্য পাত্রের দল।
আরও পড়ুন-বিশ্বভারতীর অসভ্যতা, অমর্ত্য বিদেশে তবু দেখা করার নোটিশ
মিছিল এবং মিটিং
সোলাপুর শহরে জমজমাট মিছিল করেই থামেনি আইবুড়োর দল, জনসাধারণের কাছে নিজেদের বক্তব্য প্রকাশের জন্য একটি ছোট মিটিংও করে। মিটিং শেষে দলবেঁধে যায় জেলাশাসকের অফিসে। নিজেদের দাবি জানিয়ে একটি চিঠি জমা দেয়। কী ছিল চিঠিতে? মিছিলে যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজে দেওয়ার আর্জি। খোদ সরকার বাহাদুরের কাছে।
কেন এই অসাম্য?
সংগঠনের প্রতিনিধিরা এর জন্য সন্তান জন্মের আগে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের বেআইনি প্রক্রিয়াকেই দায়ী করেছিল। তাদের দাবি ছিল, আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করে অবিলম্বে এটি থামানো দরকার। না হলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সেই সময় মহারাষ্ট্রে প্রতি ১০০০ পুরুষের অনুপাতে নারীর সংখ্যা ছিল ৮৮৯। তাদের অভিযোগ ছিল, সরকারের গাফিলতির কারণেই এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কন্যাভ্রূণ হত্যা করা হয়। সরকার তা বন্ধ করতে পারেনি। সেই কারণেই রাজ্যে নারী-পুরুষের সংখ্যায় ভারসাম্য বজায় নেই।
আরও পড়ুন-গিল ধামাকায় হার্দিকদের জয়
আরও একটি রাজ্যে
কর্নাটক, মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি তামিলনাড়ুতেও দেখা দিয়েছিল কন্যা সংকট। কয়েক বছর আগে। বিয়ের জন্য পাওয়া যাচ্ছিল না উপযুক্ত পাত্রী। ৪০ হাজারের বেশি বিবাহযোগ্য পাত্রের জীবন হয়ে পড়ছিল বেসুরো। যদিও এর পিছনে কারণ ছিল কিছুটা ভিন্ন। জাতপাত। তারা মূলত খুঁজছিল ব্রাহ্মণ পাত্রী। গোটা রাজ্যে খোঁজ করেও কুমারী ব্রাহ্মণ পাত্রী পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই সময় তামিলনাড়ুতে নারী-পুরুষের অনুপাত অনুযায়ী, ১০ জন বিবাহযোগ্য ছেলের জন্য ছিল ৬ জন পাত্রী। তাদের মধ্যে হয়তো এক বা দুইজন ব্রাহ্মণ। ফলে বিয়ের জন্য মনের মতো পাত্রী পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছিল। অন্যজাতে বিয়ে করতে নারাজ ছিল ব্রাহ্মণ পাত্ররা। বাধ্য হয়ে আইবুড়োর দল বিবাহযোগ্যা কন্যার খোঁজে ছুটে যায় ভিনরাজ্যে। সমসম্প্রদায় ও একই জাতে বিয়ে করতে পাত্রীর খোঁজে এইভাবেই শুরু হয় তাদের বিশেষ অভিযান। পাশে দাঁড়ায় তামিলনাড়ুর একটি ব্রাহ্মণ সংঘ। বিবাহযোগ্য ব্রাহ্মণ পাত্রদের দুঃখ ঘোচাতে নিজেদের রাজ্য থেকে হাজার কিলোমিটার দূরের রাজ্যে পাত্রী সন্ধানে তারাও বেরিয়ে পড়ে। চেন্নাই থেকে দিল্লি, লখনউ, পটনা, রাঁচিতে চলেছিল পাত্রীর খোঁজ। এই অভিযানে নাকি এসেছিল সাফল্য। পটনা ও লখনউ থেকে এসেছিল বেশ কিছু যোগাযোগ। অনেকেই ব্রাহ্মণ সংঘের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছিল। পাশাপাশি হয়েছিল বিরূপ সমালোচনাও। জানা গেছে, সেই সময় শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ কন্যাই যে অপ্রতুল ছিল, তা নয়। বিয়ের জন্য কম পড়েছিল অন্য জাতের কন্যাও। এ এক মস্ত বড় সমস্যা।
আরও পড়ুন-ফের চালু হয়েছে বিজেপির দাঙ্গাবাজি ফর্মুলা! রামনবমীতে অশান্তি নিয়ে বিস্ফোরক অভিষেক
বিপরীত ছবি
নারীর পাশাপাশি দেখা গেছে পুরুষ সংকট। বিশ্বের কয়েকটি দেশে। দেশগুলো হল ইউরোপের রাশিয়া, লাটভিয়া, বেলারুশ, লিথুনিয়া, আর্মেনিয়া, ইউক্রেন। সেখানে মিলছে না বিয়ের পাত্র। মনমরা হয়ে দিন কাটছে নারীদের। এর কারণ পুরুষদের আত্মহত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং গড় আয়ু কমে যাওয়া। পরিসংখ্যান বলছে, এই দেশগুলোয় পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই বিয়ের জন্য পুরুষের সংকট দেখা দিয়েছে। দেওয়া যাক পরিসংখ্যান। লাটভিয়ায় প্রতি ১০০ জন পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা ১১৮.০। লিথুনিয়ায় প্রতি ১০০ জন পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা ১১৭.২। আর্মেনিয়ায় প্রতি ১০০ জন পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা ১১৫.৫। রাশিয়ায় প্রতি ১০০ জন পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা ১১৫.৩। বেলারুশে প্রতি ১০০ জন পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা ১১৫.২। ইউক্রেনে প্রতি ১০০ জন পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা ১১৫.৮৭।
আরও পড়ুন-স্কুলছাত্রীর যৌন নিগ্রহে দুই দোষী শিক্ষকের যাবজ্জীবন
সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন
লাটভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে এই ভারসাম্যহীনতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা ৫০ শতাংশ বেশি।
এই বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী বাইবা বেলা বলেছেন, মেয়েরা যে বয়সে সংসার গড়ার জন্য তৈরি হয়, দেখা গেছে সেই বয়সে নানা কারণে ছেলেদের মৃত্যু হচ্ছে। এইসব দেশে আত্মহত্যার সংখ্যা স্বাভাবিক মৃত্যুর চারগুণ। প্রথম ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সিদের মধ্যে বোঝা যায় নারী-পুরুষের ভারসাম্যহীনতা। কারণ ওই বয়সে যে ক’জন মেয়ে মারা যায়, তার চেয়ে তিনগুণ বেশি মারা যায় ছেলে। এর অর্থ হচ্ছে, ওই বয়সিদের মধ্যে গাড়ি দুর্ঘটনা, মাদকাসক্তি, কর্মস্থলে দুর্ঘটনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের ঝুঁকি ঢের বেশি। এইসব কারণে দেশগুলোয় দেখা যাচ্ছে পুরুষ সংকট, নারীদের বিয়ের জন্য পাত্র পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন-দুশ্চিন্তায় সাধারণ মানুষ, জীবনদায়ী ওষুধের দাম একলাফে বাড়ছে ১২ শতাংশ
ফেরা যাক কর্নাটকে
যে সমস্ত পুরুষরা পদযাত্রায় শামিল হয়েছিল, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই কৃষক। ঘাম ঝরায় কাদামাঠে। রোদ জল বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। তাদের বক্তব্য, যখন প্রেম করার বয়স ছিল, তখন মুখ বুজে কাজ করেছি। করেছি অর্থ উপার্জন। এখন সব আছে। কিন্তু বিয়ে করার জন্য পাত্রী নেই।
হায় হায় কমছে আয়
কর্নাটকের মান্ডিয়া একটি উর্বর কৃষি অঞ্চল। সবচেয়ে বেশি হয় আখ চাষ। সঙ্গে অন্যান্য ফসল। কিন্তু বর্তমান সময়ে কৃষি থেকে আয় কমে গেছে। তাই বহু মানুষ পেশার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। এখন অনেকের ধারণা, কৃষি পেশায় থাকা পরিবারগুলোর তরুণদের আয়-রোজগার অনিশ্চিত। তাই তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে নারীরা। জানা গেছে, গত কয়েক বছরে অন্তত ৩০ জন নারী একজন কৃষকের বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। অথচ ভাল পাত্রী জুটে যাচ্ছে চাকুরে এবং ব্যবসায়ীদের। কৃষকদের প্রতিবাদ-পদযাত্রা কিছুটা নারীদের উপেক্ষার বিরুদ্ধেও। আর একটি বিষয়, বর্তমান সময়ের মেয়েরা চাইছে অবাধ স্বাধীনতা। তাই পাত্র হিসেবে তাদের পছন্দ শহুরে যুবক। কারণ গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি স্বাধীনতা পাওয়া যায়। জীবনযাপন হয় শৌখিন, বিলাসবহুল, ঝলমলে।
আরও পড়ুন-এলেন নারিন, কাল মোহালিতে পাঞ্জাব ম্যাচ
আদমশুমারির তথ্য
একটা সময় শিশু জন্মের আগে লিঙ্গ পরিচয় জানা নিষিদ্ধ করা হয়। তবে গর্ভপাত অব্যাহত ছিল। তাই জটিল হয়েছে পরিস্থিতি। কর্নাটকের স্কুলের দিকে তাকালে বোঝা যাবে, সেখানে খেলার মাঠে ২০টি মেয়ের সঙ্গে খেলে ৮০টি ছেলে। আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী সেখানকার নারী-পুরুষ অনুপাত ২০১১ সালে ছিল ৯৬০ নারী : ১০০০ পুরুষ। ২০০১ সালে ছিল ৯৭১ নারী : ১০০০ পুরুষ। কর্নাটকের পাশাপাশি আরও কিছু জায়গায় কন্যা সংকটের সমস্যা বাড়ছে বলে খবর।
আরও পড়ুন-কর্নাটকে বিজেপির হারের স্পষ্ট পূর্বাভাস দিল প্রাক্ সমীক্ষা
হতে হবে সচেতন
বাংলায় এই সমস্যা এখনও দেখা দেয়নি। প্রত্যেকের জন্য কেউ না কেউ ঠিক অপেক্ষায় আছে। হেসেখেলে উপযুক্ত পাত্রী জুটে যায় সরকারি চাকুরে, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মাল্টিন্যাশনাল কর্মী থেকে শুরু করে কৃষক, মেথর, দিনমজুরের। তবে কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ুর ঘটনায় সচেতন হতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, কোথাও যেন কন্যাভ্রূণ হত্যা না হয়। বিষয়টাকে হালকা ভাবে নিলে ভবিষ্যতে সর্বত্র দেখা দেবে কন্যা সংকট। সমাজের পক্ষে সেটা একেবারেই মঙ্গলজনক হবে না।