নারী সমাজের আদর্শ
সাল ১৯২৩। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন সাড়া ফেলে দিয়েছে। লন্ডনে বসে সেই খবর কানে আসে এক ভারতীয় নারীর। তিনি সেই মুহূর্তে মাতৃভূমির সেবা করার সিদ্ধান্ত নেন। সুপ্রতিষ্ঠিত গান্ধী-সংগঠন সেবা দল-এ যোগদান করার জন্য নিজের দেশে ফিরে আসেন। দলের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সাধারণ নারীদের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলতে শুরু করেন। অল্প সময়েই হয়ে ওঠেন নারী সমাজের কাছে আদর্শ। বক্তব্য রাখতেন চমৎকার। যেখানে যেতেন তাঁর কথা শোনার জন্য ভিড় জমে যেত। এইভাবে ঘটিয়েছিলেন নারী জাগরণ। তিনি কমলাদেবী।
আরও পড়ুন-কনের খোঁজে
ধারেশ্বর থেকে চট্টোপাধ্যায়
চট্টোপাধ্যায় ছিল কমলাদেবীর পদবি। তবে জন্মসূত্রে নয়, বিবাহসূত্রে। বাঙালি নন, তিনি ছিলেন দক্ষিণ ভারতীয়, কন্নড়। ১৯০৩ সালের ৩ এপ্রিল ম্যাঙ্গালোরের একটি শিক্ষিত ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। পৈতৃক পদবি ছিল ধারেশ্বর। বাবার নাম আন্নানথায়া। মা গিরিজাবা। বাবা ছিলেন সিনিয়র সিভিল সার্ভেন্ট। কমলাদেবী ছিলেন মা-বাবার চতুর্থ এবং কনিষ্ঠ কন্যাসন্তান।
তিনি যে অন্য ধাতে গড়া বোঝা গিয়েছিল শুরু থেকেই। পড়াশোনার প্রতি ছিল গভীর মনোযোগ। পড়তেন দেশবিদেশের বিভিন্ন ধরনের বই। অজানাকে জানতে চাইতেন, পাশাপাশি চাইতেন অচেনাকে চিনতে। প্রশ্ন সাজিয়ে দিতেন ক্রমাগত। একটার পর একটা। উত্তর পেলে মুহূর্তে বেড়ে যেত জানবার খিদে। এইভাবেই বাড়িয়ে তুলতেন নিজের জ্ঞান ভাণ্ডার। বাবা-মা ছিলেন উদার মনের মানুষ। দু’জনেই ছিলেন মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, রামাবাই রানাডে এবং অ্যানি বেসন্তের মতো বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের ঘনিষ্ঠ। চোখে দেখার আগেই কমলাদেবী শুনে আসছিলেন এঁদের কথা। এইভাবেই ধীরে ধীরে স্বদেশি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি গভীরভাবে উৎসাহী হয়ে উঠছিলেন।
আরও পড়ুন-ভূমিকন্যা
সে ছিল এক সংগ্রামের সময়
অল্প বয়স থেকেই কমলাদেবী ছিলেন দৃঢ়চেতা এবং সাহসী। বুদ্ধি এবং মেধায় টেক্কা দিতে পারতেন বহু পুরুষকেও। দিদি সগুনা আগলে রাখতেন আদরের ছোট বোনকে। কমলাদেবীর শৈশবের দীর্ঘ সময় কেটেছে সগুনার স্নেহছায়ায়। তবে একটা সময় এই স্নেহ থেকে বঞ্চিত হতে হয় কমলাদেবীকে। বিয়ের কিছুদিন পর সগুনার অকালমৃত্যু ঘটে। এই আঘাত সহ্য করতে পারেননি কমলাদেবী।
দ্বিতীয় ধাক্কা আসে, যখন তাঁর ৭ বছর বয়স। অকালে চলে যান বাবা। মহা বিপাকে পড়ে পরিবার। বাধ্য হয়ে তাঁরা আশ্রয় নেন মামার বাড়িতে। সে ছিল এক সংগ্রামের সময়। মুখ বুজে সমস্ত পরিস্থিতি সামলেছেন।
আরও পড়ুন-“মহানায়ক আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন”
আঁধার সরিয়ে আলো
১৯১৭ সাল। কমলাদেবী তখন ১৪। হঠাৎ বদলে যায় জীবন। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন কৃষ্ণ রাওয়ের সঙ্গে। প্রথম প্রথম সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। সংসারে লেগেছিল সুখ ও শান্তির ছোঁয়া। কিন্তু বিয়ের দুই বছরের মাথায় ঘটে গেল মস্তবড় অঘটন। ১৯১৯ সালে মারা গেলেন স্বামী। মাত্র ১৬ বছর বয়সে কমলাদেবী হলেন বিধবা। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় সযত্নে লালন করা স্বপ্ন।
অবশ্য ধীরে ধীরে চরম ধাক্কা সামলে উঠেছিলেন। নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন দেবী সরস্বতীর চরণে। ভর্তি হন চেন্নাইয়ে রানি মেরি কলেজে। আঁধার সরিয়ে খুঁজে পাচ্ছিলেন আলোর মুখ। সান্নিধ্যে আসছিলেন বহু গুণী মানুষের। নিবিড় আলাপচারিতার মধ্যে দিয়ে বাড়াচ্ছিলেন জ্ঞান।
আরও পড়ুন-“মহানায়ক আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন”
নতুন সম্পর্ক
এইসময় তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় সরোজিনী নাইডুর ছোট বোন সুহাসিনী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। অল্প সময়েই দু’জনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সুহাসিনীর ভাই ছিলেন হরিন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। কবি-নাট্যকার-অভিনেতা। সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে সিধু জ্যাঠার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সেটা অবশ্য অনেক পরে। সুহাসিনীর মাধ্যমেই হরিন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ হয় কমলাদেবীর। ক্রমেই গাঢ় হয় সম্পর্ক। কারণ দু’জনেই ছিলেন সাহিত্য, সংগীত এবং থিয়েটার অন্তপ্রাণ। তাঁদের আলোচনায় বারবার উঠে আসত এই তিনটি বিষয়। পাশাপাশি দু’জনেই ছিলেন সমাজ সচেতন।
১৯২৩ সাল। কমলাদেবীর বয়স যখন ২০, হরিন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরের বছর জন্ম নেয় ফুটফুটে এক পুত্রসন্তান। নাম রাখা হয় রাম। ভালয়-মন্দে কাটতে থাকে দিনগুলো।
একটা সময় লন্ডনে চলে যান হরিন্দ্রনাথ। কিছুদিন পর পিছু নেন কমলাদেবীও। সেখানে গিয়ে কমলাদেবী লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেডফোর্ড কলেজে ভর্তি হন। পরে ডিপ্লোমা অর্জন করেন সমাজবিজ্ঞানে। দারুণ কাটছিল দিনগুলো।
এইসময়ই তিনি মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পারেন এবং দেশে ফিরে আসেন। কমলাদেবী উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বহু মহিলাকে। তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশের সেবায়, পেতে চাইছিলেন স্বাধীনতার স্বাদ। সমস্ত আগেই উল্লেখিত হয়েছে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
বিধানসভা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
১৯২৬ সাল। মাদ্রাজের প্রাদেশিক বিধানসভায় অংশ নেওয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করেন কমলাদেবী। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য তিনি মার্গারেট ই ক্যাসিন্সের সঙ্গে দেখা করেন। আলোচনা সারেন। মার্গারেট ছিলেন ‘অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা। সিদ্ধান্ত হয়, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কমলাদেবী। পাশে পেয়ে যান অনেককেই। তবে বিভিন্ন কারণে তিনি খুব বেশিদিন প্রচার করতে পারেননি। ফলাফল প্রকাশিত হলে জানা যায়, পরাজিত হয়েছেন। মাত্র ৫৫টি ভোটের ব্যবধানে। তবুও কমলাদেবী স্থাপন করেছিলেন একটা দৃষ্টান্ত। তিনিই ছিলেন বিধানসভা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা প্রথম কোনও ভারতীয় নারী। পরবর্তী সময়ে সমাজকর্মী হিসেবে কমলাদেবী এই ‘অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্সে’র কাজকর্মের সঙ্গেও বিপুল ভাবে জড়িয়ে পড়েন।
আরও পড়ুন-গিল ধামাকায় হার্দিকদের জয়
ব্যতিক্রমী কাজকর্ম
বিচিত্র জীবন ছিল তাঁর। একটা সময় গ্রেফতার হয়েছিলেন। জানা যায়, ব্রিটিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া প্রথম ভারতীয় নারী তিনিই। এইভাবেই বারবার বিবিধ ব্যতিক্রমী কাজকর্মের মাধ্যমে তৎকালীন সময়ের চলতি সামাজিক প্রথাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
সৃজনীর অঙ্গনে কমলাদেবীর অবদান কম নয়। যে সময় দেশ ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির ছোঁয়ায় একটু একটু করে নিজের স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিয়েছে, সেই সময় দেশকে আবার সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতায় পৌঁছে দিয়েছেন এই মহিয়সী নারী। ভারতের নিজস্ব সম্পদ হস্তশিল্প। সেই সম্পদকে দিয়েছেন গুরুত্ব। হ্যান্ডলুমও যে শিল্প-বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে, তাও সারা দেশকে দেখিয়েছেন কমলাদেবীই। ভারতীয় মহিলাদের আর্থ-সামাজিক স্তরকে সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে আসতেও নিরলস পরিশ্রম করেছেন তিনি। সোচ্চার হয়েছেন বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে। বক্তৃতার ডালি নিয়ে গেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। যেখানে গেছেন, ঝড় তুলেছেন।
আরও পড়ুন-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরেই অনুমতি ছাড়া প্ররোচনার মিছিল
থিয়েটারে নবজাগরণ
তাঁর বিপুল আগ্রহ ছিল রঙ্গমঞ্চের প্রতি। সারাক্ষণ এই শিল্প মাধ্যমের উন্নতির কথা চিন্তা করতেন। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, মানব অভিব্যক্তির উন্মুখ বাতায়ন হল থিয়েটার। নিজে নাটকে অভিনয় করেছেন। অভিনয়ের দল নিয়ে ঘুরেছেন সারা দেশে। পাশাপাশি অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রে। মূলত নির্বাক ছবিতে। বলা যায়, দেশীয় থিয়েটার শিল্পে নবজাগরণ ঘটেছিল কমলাদেবীর হাত ধরেই। ভারতীয় পণ্য নিয়ে ব্রিটিশ-ভারতে আন্দোলন এবং থিয়েটার নিয়ে স্বাধীন ভারতে তাঁর আন্দোলন কোনওভাবেই ভোলার নয়।
বিবিধ বিষয়ে লিখেছেন কয়েকটি বই। প্রতিটি বই সমাদৃত হয়েছে বোদ্ধা পাঠক মহলে। তাঁকে নিয়েও কয়েকটি বই লেখা হয়েছে।
আরও পড়ুন-দুশ্চিন্তায় সাধারণ মানুষ, জীবনদায়ী ওষুধের দাম একলাফে বাড়ছে ১২ শতাংশ
পুরস্কার সম্মাননা
অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন কমলাদেবী। ১৯৫৫ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ এবং ১৯৮৭ সালে পদ্মবিভূষণে সম্মানিত করে। ১৯৬৬ সালে কমিউনিটি লিডারশিপের জন্য রামন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেন। পেয়েছেন সংগীত নাটক একাডেমি ফেলোশিপ।
প্রকৃতপক্ষে দেশগঠন এবং নারী সমাজের উন্নয়নের লক্ষ্যে সারা জীবন নানারকম কাজ করেছেন কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়। করেছেন অক্লান্ত পরিশ্রম। নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ এবং উৎসাহিত করেছেন।
১৯৮৮-এর ২৯ অক্টোবর ৮৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি নেই, তবে থেকে গেছে তাঁর কাজ। আজও বহু নারীর কাছে তিনি আদর্শ।