প্রতিবেদন : সুদিন আসছে’৷ এই আশ্বাস দিয়ে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে মোদি-জমানার শুরু৷ সাত বছর অতিক্রান্ত৷ সুদিনের ‘সু’ও ভারতবাসী দেখতে পায়নি৷ ক্রমে ক্রমে দুর্দিনের করাল ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে আমার দেশ৷ এটাই আমরা দেখছি৷ এ-এক ভয়ঙ্কর সময়৷ মোদি-জমানায় আরএসএস–বিজেপির বন্ধ খামের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ছে তাদের একের পর এক গোপন অ্যাজেন্ডা৷ বেরিয়ে পড়ছে তাদের ভয়-পাইয়ে-দেওয়া মতাদর্শ৷ আসলে যা ভারত নামের দেশটাকে পর্যুদস্ত করার মতাদর্শ৷ যা দেখেশুনে আমাদের অন্তরাত্মা বারবার কেঁপে-কেঁপে উঠছে৷
সুদিন আসেনি৷ ২০১৪ থেকে এ-পর্যন্ত দেশকে পিছনে ঠেলার এক অপচেষ্টা চলছে৷ যার ফলশ্রুতি, আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পশ্চাদ্গামী ও নীচ, অশিষ্ট, অমার্জিত ও অশ্লীলতায় ভরিয়ে তুলেছে৷ এই অশ্লীল রীতিনীতির দৌলতে রাজনীতি, জননীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘গিমিক’সর্বস্বতায় পরিণত হয়েছে৷ প্রতিশ্রুতির অপর নাম হয়েছে ‘জুমলা’ (কথার কথা)৷
আরও পড়ুন : লখিমপুরকাণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ সুপ্রিম কোর্টের, স্টেটাস রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ যোগী সরকারকে
কথার কথায় কী আর সুদিন আসে? এই জুমলাপ্রিয় মোদি-জমানাতে তাই ওদের রাজনীতিও হয়ে পড়েছে জুমলাশ্রয়ী৷ নোটবন্দি, জিএসটি, প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা, সুদিন আসছে, দেশপ্রেম, জাতীয়তা, নতুন ভারত, আত্মনির্ভর ভারত, শক্তিশালী ভারত, উন্নত গণতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে মোদি যা বলেছেন— সে-সবই কথার কথা৷ তাই সুদিন আসেনি৷ সুদিন মানে তো সুশাসন৷ সুদিন মানে আম-পাবলিকের জীবন–জীবিকার সুরক্ষা৷ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, সুশিক্ষা ও সুস্বাস্থ্যের ব্যবস্থার মাধ্যমেই তো সুদিন আসে৷ সাত বছরের বিজেপি শাসনে সর্ববিষয়েই দেশ পিছিয়ে পড়েছে৷
শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও বিরোধী শক্তি আজ চরম হুমকির মুখে বিপর্যস্ত৷ গণতন্ত্র ভূ-লুণ্ঠিত৷ বহুত্ববাদী ভারতে আজ একাধিপত্যের অসহ্য দাপট৷ সাত বছরে সংবিধান দ্বারা গঠিত সংস্থাগুলির স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও একাত্মতা মারাত্মকভাবে অবক্ষয়ের শিকার৷ বিচারব্যবস্থা পর্যন্ত এর হাত থেকে বাঁচেনি৷ নির্বাচন কমিশন, সিবিআই ও ইডি-আদি তদন্তকারী সংস্থা থেকে শুরু করে শিক্ষা পরিচালনকারী সংস্থাগুলি পর্যন্ত শাসকদের দখলে৷ ‘সংগরিষ্ঠের শাসন’–এর নামে সংখ্যালঘুর গণতান্ত্রিক অধিকারকে সর্বক্ষেত্রে গলা টিপে মারার ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে৷ বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের জায়গায় এ–কী এক রাজতন্ত্রের পুনরুত্থানের দিকে যাচ্ছি আমরা?
আরও পড়ুন : মন্দিরে পুজো দিয়ে খড়দহ উপনির্বাচনে মনোয়ন পত্র পেশ করলেন শোভনদেব
‘মেইনস্ট্রিম মিডিয়া’ বা মূলধারার সংবাদমাধ্যম অপছন্দের জায়গা অতিক্রম করে এক বিপজ্জনক দিকে মোড় নিয়েছে৷ কেন্দ্রীয় শাসক দলের সঙ্গে তাদের সখ্য ও অংশীদারিত্ব এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে সরকারকে প্রশ্ন করতেও তাদের ঘোরতর আপত্তি৷ দেশের সামাজিক বুনন (সোশ্যাল ফেব্রিক) প্রচণ্ড টানাটানিতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত৷ ভারতীয় জনতা পার্টি একনাগাড়ে তথাকথিত এক ‘হিন্দু রাষ্ট্র’–এর দিকে ঠেলছে দেশকে৷ তাদের সাংস্কৃতিক প্রহরীরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অন্য মত, অন্য জীবনাচরণকে নিয়ন্ত্রিত করছে রাষ্ট্রীয় মদতে৷ মানুষের খাওয়া, পরা, ধর্মাচরণ— সবকিছুর ঠিকা তাদের হাতে৷ সাম্য, স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায়, সবকিছুই চরম আগ্রাসনের মুখে বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত৷
সঙ্কটাপন্ন দেশের অর্থনীতি৷ ক্রমশই তা কর্পোরেট-নির্ভর এক বিকৃত অর্থনীতির দিকে এগিয়ে চলেছে৷ যার ফলে লাভবান হচ্ছে দেশের হাতে-গোনা কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলি৷ মানুষের হাতে নগদ অর্থ জোগানের বিশেষজ্ঞ পরামর্শদাতাদের কথা শোনা হচ্ছে না৷ ফলে দারিদ্র, বেকারি, বি–শিল্পায়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ জলের দরে বেচে দেওয়ার যে–সব চিত্র আমরা দেখছি তা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে৷ নীতি–আয়োগ আসলে হয়ে উঠেছে মোদি–আয়োগ৷ তিনিই সব৷ তাঁর কথাই শেষ কথা৷ কথায় বলে দেশ চালানো সোজা কথা নয়৷ তার জন্য বিদ্যে লাগে৷ সেই বিদ্যার বড়ই অভাব৷ কিন্তু ঔদ্ধত্যের তিল-পরিমাণ ঘাটতি নেই৷ মোদি-জমানার প্রথম পর্যায়ে যে অনেক আপত্তিকর ঘটনা ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই৷ কিন্তু দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর যা-যা ঘটছে তা দেশের পক্ষে শুধু আপত্তিকর নয়, সেগুলি দেশের মধ্যে অন্তর্ঘাতের সমান৷ এ-ভাবে চললে সর্বনাশ হবে দেশের ও দেশবাসীর৷
আজ প্রয়োজন দেশব্যাপী আমাদের যৌথ চিন্তা–চেতনার মধ্যে সাত বছরের এই ভয়ঙ্কর স্মৃতিগুলিকে ধরে রাখা৷ পর্যালোচনা করে দেখা, এই সময়কালে দেশ কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছে এবং তার জন্য কোন ব্যক্তিরা দায়ী৷ আজ আমাদের দেশের অর্থনীতির পেট–কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে নেওয়া হচ্ছে৷ কৃষি আইন ও শ্রম কোডগুলি শ্রমজীবী মানুষের জীবনও জীবিকার ওপর মারণ-আঘাত নামিয়ে আনবে৷ আমাদের সমাজ-বুনটকে ছিঁড়ে ফেলার সর্বনেশে অপচেষ্টা চলছে দিন–রাত সমানভাবে৷ সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে৷ সীমান্তরক্ষার গাফিলতি ও ব্যর্থতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ গরিবি–রেখার ওপরে উঠে-আসা লক্ষ লক্ষ মানুষকে পুনরায় চরম দারিদ্রের অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে৷ মিথ্যা-ঘৃণা-হত্যার এক আবহ তৈরি হয়েছে৷ এ-সবই মোদি–জমানার দুর্দিন–নামা৷ যখন প্রতিদিন বেড়ে চলেছে আমাদের বিড়ম্বনা, আমাদের ক্লেদাক্ত হওয়া এবং আমাদের ক্লেশ৷ বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করা হচ্ছে প্রতিবাদী মানসিকতাকে৷
একদিকে অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করেছে মানুষ, অন্যদিকে চলেছে রাজকীয় সেন্ট্রাল ভিস্টার সৌধ–সড়ক নির্মাণের রাজকীয় উদ্যোগ৷ করোনা-আক্রান্ত মানুষের লাশে ভেসেছে গঙ্গা–ভাগীরথী৷ ঘটেছে আরও অনেক কিছু৷ স্মৃতিপটে ধরে রাখতে হবে সব কিছুই৷
আরও পড়ুন : ১০২ বছরের রহস্য, মাঝ সমুদ্রে উধাও অভিনেত্রী
তারপর যখনই যুক্তি ও ন্যায্যতা ফিরে আসবে, তখনই এই ব্যক্তিদের জনতার দরবারে উঠতে হবে বিচারের কাঠগড়ায়৷ যারা আমাদের দেশের গর্বকে ধুলোয় নামিয়েছে, যারা বহু মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী, যাদের বর্বর-সুলভ আক্রমণের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে অগণিত মানুষ, যাদের বিশ্বাস করে ঠকেছে মানুষ— তাদের নাম ও তাদের কাজ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যাবে ইতিহাসের পাতায় কালো অক্ষরে৷ সেই সময় আসছে৷ সেই সময় আসবে৷ সেদিন আসবে সুদিন৷ জুমলায় নয়৷ বাস্তবে।