‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’— গানটির পাঁচটি স্তবক। প্রথম স্তবকটি গৃহীত হয়েছিল আমাদের ‘জাতীয় সংগীত’ হিসেবে। দ্বিতীয় স্তবকে রবীন্দ্রনাথ ভারত তথা বাঙালি সংস্কৃতি নির্মাণের একটি জরুরি অভিমুখকে চিহ্নিত করেছেন। একে বলা যেতে পারে, মিলনের বহুবিচিত্র প্রবাহের জয়গান। পয়লা বৈশাখের উদ্যাপন, আমার মনে হয়, সেই ঔদার্যের বঙ্গ-সংস্কৃতি। বিশ্ব আর বাংলার নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ-সহযোগের ইতিবৃত্ত। গানটির দিকে লক্ষ্য করা যাক। ‘অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী’ আর তার পরে, আরও নির্দিষ্টভাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘পূরব পশ্চিম আসে/তব সিংহাসন-পাশে / প্রেমহার হয় গাঁথা।’ বাঙালিত্বের নির্মাণ এমনই এক প্রেমময়, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের নানা ধর্ম-দেশ-সংস্কৃতির মিলনে সম্ভব হয়েছে। অনেক তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাতেও যেন সেই দিব্যতাকে আমরা খুঁজে পাব।
আরও পড়ুন-সিউড়িতে শাহি মিথ্যাচারের জবাব দিতে, ফিরহাদের সভা কাল
১৯৩১ সালে তৎকালীন কলকাতার মেয়র বিধানচন্দ্র রায়কে একটি চিঠি লেখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই চিঠিতে তিনি জানান যে, ‘শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসু’র সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা হয়েছে। জাপান থেকে এসেছেন অধ্যাপক তাকাগাকি। তিনি একজন যুযুৎসু বিশারদ। এই আত্মরক্ষার পদ্ধতিটি খুবই কার্যকর বলে মনে করেন রবীন্দ্রনাথ। সে কারণে মিস্টার তাকাগাকিকে তিনি নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দু-বছর প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। তাঁর এদেশে আসা এবং থাকার সমস্ত ব্যয় রবীন্দ্রনাথ নিজেই বহন করেছেন। তাকাগাকি শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের খুবই যত্নের সঙ্গে যুযুৎসু শিখিয়েছেন। কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীরা যুযুৎসু কৌশলের প্রদর্শন করেছে। সেখানে, কলকাতা কর্পোরেশনের প্রতিনিধিরা অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। বর্তমানে, তাঁকে হয়তো জাপানে ফেরত পাঠিয়ে দিতে হবে। সে কারণে সুভাষচন্দ্র এবং বিধানচন্দ্র রায়কে রবীন্দ্রনাথ অনুরোধ করছেন, যাতে কলকাতা কর্পোরেশন অধ্যাপক তাকাগাকির দায়িত্ব নেয়। বাংলার ছাত্রসমাজকে এই শারীরিক কসরত এবং আত্মরক্ষার কৌশল তিনি শেখাতে পারেন। ফলে, ছাত্রসমাজের প্রভূত উন্নতি হবে এবং শিক্ষার ভিন্ন একটি দিকও পরিচর্যা পাবে। মিস্টার তাকাগাকি এ-কাজ করতে সম্মতও আছেন।
আরও পড়ুন-প্রতীচীর গায়ে উচ্ছেদ নোটিশ বিশ্বভারতীর
এ চিঠির পর ঠিক কী ঘটেছিল, আমরা জানি না। সামান্য ঘটনা হিসেবে আমরা একে বিস্মৃতির গর্ভে ফেলে দিয়েছি। চমক লাগে অন্যত্র। সত্যজিৎ রায়ের ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ে আবার আবির্ভূত হন প্রশিক্ষক তাকাগাকি। সালটা সম্ভবত ১৯৩৪। ছোটকাকা সুবিমল রায়ের সঙ্গে বালক মানিক গেল সুইন্হো স্ট্রিটে ‘জুদো’ শিখতে। সত্যজিৎ রায়ের ভাষায় ‘জুদো-নবিশ’ তাকাগাকির কাছে। সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে বর্ণনাটি শোনা যাক। ‘ভদ্রলোকের বয়স আন্দাজ চল্লিশ, কুচকুচে কালো কদমছাঁট চুলের সঙ্গে মানানসই ঘন কালো ভুরু আর গোঁফ’। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন বিদ্যাটির নাম ‘যুযুৎসু’ আর সত্যজিৎ বলেছেন ‘জুদো’। অনুমান করি, রবীন্দ্রনাথের চিঠি বা শান্তিনিকেতনে অধ্যাপক তাকাগাকির অবস্থান বিষয়ে সত্যজিৎ বা তাঁর ছোটকাকা সুবিমল কিছু জানতেন না। অন্যদিকে, এ-কথাও জানিয়েছেন সত্যজিৎ রায়, যে, সেই দলে জুদো শিখতে আসতেন কলকাতার লাইট হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন সোনালি চুলের ক্যাপ্টেন হিউজ (Hughes)। প্রশিক্ষণ শেষে জুদো-ওস্তাদ তাকাগাকি তাঁদের খাওয়াতেন ওভালটিন।
আরও পড়ুন-১৭ এপ্রিল পর্যন্ত তাপপ্রবাহের পূর্বাভাস
অধ্যাপক তাকাগাকি এইভাবে মিলে গেলেন বাংলার দুই অগ্রগণ্য মনীষার সঙ্গে। সেটা শুধু নয়, যুযুৎসু বা জুদোর প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রথমে লক্ষ্য করব আমরা। জাপানের এই শারীরবিদ্যাকে তিনি গুরুত্ব দিয়ে মেলাতে চাইলেন বঙ্গ-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের সঙ্গে। শুধু মেলাতে চাইলেন না, কাতর প্রার্থনা জানালেন কলকাতা কর্পোরেশনের কাছে। অধ্যাপক তাকাগাকির বিদ্যা যেন আরও বড় পরিসরে শিক্ষার অঙ্গনে প্রবেশ করতে পারে। মিলনের এই উদার বাণীতে বঙ্গ-সংস্কৃতি নতুন এক উপাদানকে আত্মস্থ করবে। অন্যদিকে, সত্যজিৎ রায় সেই প্রশিক্ষণে নিজেকে জুড়ে ফেললেন। পরবর্তীকালে ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ উপন্যাসে ফেলুদা ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ সিনেমা দেখে কুং-ফু প্র্যাকটিস করে। তার কি কোনও সূত্র লুকিয়ে আছে তাকাগাকির বাল্যস্মৃতির সঙ্গে?
আরও পড়ুন-আকবরেরও পূর্বে বাংলা সনের অস্তিত্ব ছিল?
প্রশ্নটা হল, সংস্কৃতি-চর্চা কি সংকীর্ণতায় আটকে থাকবে, নাকি ‘পরকে আপন করে’ দৃষ্টিভঙ্গিতে ডানা প্রসারিত করবে? ওই যে কথাটি, ‘পূরব পশ্চিম আসে/তব সিংহাসন- পাশে’— সেটির তাৎপর্য। এই ঠুলি পরা বঙ্গ- সংস্কৃতি, ভারত-সংস্কৃতি নির্মাণের যুগে, উগ্র হিন্দুত্ববাদের ইতিহাস বিকৃতির যুগে, সেই উত্তর খোঁজা জরুরি।