মা মাটি মানুষ
এই তিনটে শব্দ মহামূল্যবান যুগে যুগে দেশে দেশে, কালে গণ্ডি পেরিয়েও। মাটিই মা, আবার মাটিই মানুষ। মৃত্তিকার উপরেই নির্ভর আবহমান সভ্যতা। তাই মৃত্তিকা বিজ্ঞানের পরিধিও অনন্ত। মৃত্তিকা বিজ্ঞানের প্রসঙ্গ এলেই যাঁর নাম শ্রদ্ধাবনত হয়ে স্মরণ করতে হয় তিনি হলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রসায়নবিদ জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁকে মৃত্তিকা-বিজ্ঞানী বলেই জানি আমরা।
কিন্তু মৃত্তিকা-বিজ্ঞানীকে জানতে হলে সবার আগে জানতে হবে মৃত্তিকা-বিজ্ঞানকে। কারণ এই শব্দটা অনেক মানুষেরই অজানা।
আরও পড়ুন-যামিনী রায়ের দুই বাড়ি, একদিকে আলো, অন্যদিকে অন্ধকার
অজানারে জানতে
একটু যদি পাশ্চাত্যের ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব হিপোক্রিটাস, থিওফ্রিটাস, ভেরো, লুক্রেটাস, ভিরজিল প্রমুখ ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা ষোড়শ শতাব্দীতেই অনুধাবন করেছিলেন যে, উদ্ভিদের সৃষ্টিতে মৃত্তিকার গুরুত্ব অপরিসীম। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী ভি ভি ডকুচেভ (V.V Dokuchaev) ও তাঁর কিছু সহকর্মী মৃত্তিকার উৎপত্তি নিয়ে প্রচুর গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যা বলেছিলেন তা হল মৃত্তিকা প্রাণী ও উদ্ভিদের মতোই প্রকৃতির একটি স্বতন্ত্র বস্তু, যেমন পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের জন্ম হয় ও জন্মের পর বৃদ্ধি ও পরিপূর্ণতা লাভ করে, তেমনি মৃত্তিকারও জন্ম হয়, সে ধীরে ধীরে গড়ে উঠে এবং শেষে পরিপূর্ণতা লাভ করে। এমনকী জীবের যেমন মৃত্যু হয়, তেমনি একটি মৃত্তিকার ধ্বংসও হতে পারে।
আরও পড়ুন-মধ্যাহ্ন ভোজন
তাহলে মৃত্তিকা-বিজ্ঞান কী?
সংক্ষেপে বলা যেতে পারে ভূত্বকের উপরে প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে মৃত্তিকার ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক ধর্ম এবং ফসল উৎপাদন ও পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কিত জ্ঞান চর্চাকে মৃত্তিকা-বিজ্ঞান বলে। এটি একটি স্বতন্ত্র বিষয়। এক কথায় বলা চলে জীবকুলের জীবনধারাকে যুগ যুগ ধরে বয়ে নিয়ে চলেছে মৃত্তিকা।
কেন খ্যাতি জ্ঞানেন্দ্রনাথের
জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় হলেন দেশের প্রথম ব্যক্তি যিনি কৃষির উন্নয়নের মাটির জরিপ কতটা জরুরি তা বুঝিয়েছিলেন, তার উপর জোর দিয়েছিলেন। ভারতের মাটির জরিপ, শ্রেণিবদ্ধকরণ এবং নামকরণের পদ্ধতির উপর গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। তাঁরই পরামর্শে ভারত সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়, মৃত্তিকা-বিজ্ঞান সংক্রান্ত কমিটি গঠন করে। ১৯৪৯ সালে তিনিই সেই কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। অসামান্য প্রতিভাধর মানুষটি রসায়নবিজ্ঞানের কলয়েড বিভাগের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রসায়নবিদ।
আরও পড়ুন-আহা গন্ধ আহা স্পর্শ
বরিশালের বাঙাল
ব্রিটিশ ভারতবর্ষের অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহি জেলার মহাদেবপুর গ্রামে তাঁর জন্ম বেড়ে ওঠা। পিতা দুর্গাদাস মুখোপাধ্যায় ছিলেন বরিশাল রাজচন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ। মাত্র বারো বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন। ছোটভাইয়ের সঙ্গেই পড়াশোনা করতেন। বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং জেলা থেকে বৃত্তি পান।
ছাত্রাবস্থাতেই গবেষণা শুরু
কলয়েড নিয়ে প্রথম গবেষণার কাজটি করেছিলেন যখন তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের এমএসসির ছাত্র। তাঁর এই গবেষণা ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। তরল পদার্থের মধ্যে অদ্রবণীয় পদার্থের ক্ষুদ্রকণা সমূহ প্রায় সর্বত্র বিরাজ। করে সেই দ্রবণকে কলয়েড দ্রবণ বলে। ওই বছরেই জ্ঞানেন্দ্রনাথ এমএসসি-তে উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯১৯-এ জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ এবং তিনি এফজি ডনাননের অধীনে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে ভৌতরসায়ন বিভাগে কাজে যোগ দেন। সেখানে গবেষণা শুরু হয় তাঁর। ‘ওরিজিন অ্যান্ড নিউট্রালাইজেশন অব দি চার্জ অব কোলাইডস’ সম্পর্কে এক গবেষণাপত্র পাঠ করে জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।
আরও পড়ুন-ইদের দিনেই মুসলিমদের হাতে দুর্গা প্রতিমার বায়না!
তাঁর গবেষণা
তড়িৎ রসায়নবিদ্যায় তাঁর কলয়েড সংক্রান্ত গবেষণা খুব তৎপর্যপূর্ণ। কলয়েড কণা ক্যাটাফোরেটিক গতি নির্ধারণের জন্য জ্ঞানেন্দ্রনাথ যে বাউন্ডারি মেথড বা সীমানা পদ্ধতি স্থির করেছিলেন। এটাই তাঁকে বিজ্ঞানীমহলে সুপরিচিতি দেয়।
বছরের পর বছর ধরে গবেষণায় লিপ্ত থেকে তিনি যেসব সরঞ্জাম ও পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিলেন সেগুলো মৃত্তিকা গবেষণায় ব্যবহারে সফলভাবে কাজে এসেছে। ১৯৪২ সালে তিনি এবং এন সি সেনগুপ্ত বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের জন্য সাধারণ ঘূর্ণমান ভিস্কোমিটার তৈরি করেন। ১৯৪৪ সালে ক্রোমাটোগ্রাফি ক্যাপিলারি অ্যানালিসিস এবং আল্ট্রা ভায়োলেট রে একধরনের বিকিরণের বা প্রতিপ্রভার ওপর ভিত্তি করে অপরিশোধিত তেলের গুণাগুণ স্থির করার পদ্ধতিটি তৈরি করেন।
আরও পড়ুন-রিজওয়ানুরের বাড়িতে মুখ্যমন্ত্রী, সঙ্গে ছিলেন অভিষেক-বাবুল
স্বনামধন্য অধ্যাপক এবং সহপাঠীরা
জ্ঞানেন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন খুব সমৃদ্ধ। এই পর্বে তিনি পেয়েছেন স্বনামধন্য অধ্যাপকদের সান্নিধ্য। যাঁদের নামটাই যথেষ্ট। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, শ্যামাদাস মুখোপাধ্যায়, নীলরতন ধর, সুবোধচন্দ্র মহলানবিশ প্রভৃতি। আর প্রথিতযশা সহপাঠীরা ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, প্রশান্ত মহলানবিশ, প্রাণকৃষ্ণ পারিজা প্রমুখ দিকপাল ব্যক্তিত্ব।
কৃষি গবেষণায় উল্লেখ্য তাঁর নাম
মৃত্তিকা বিজ্ঞানের পাশাপাশি কৃষি গবেষণা এবং শিক্ষা নিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি ভারতের কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের অধিকর্তা নিযুক্ত হন এবং সারাদেশ জুড়ে সেই কেন্দ্রটির গবেষণা এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রমের পুনর্গঠন শুরু করেন। মৃত্তিকা এবং উদ্ভিদের ক্ষুদ্র উপাদান সমূহের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্র এবং আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে মাটির মৃত্তিকা খনিজ বিজ্ঞানের উপর নিয়মিত গবেষণা শুরুর কৃতিত্ব তাঁরই। তিনি চেয়েছিলেন ভারতের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করতে। ইন্দো আমেরিকান টিমের সুপারিশ এবং রকফেলার ফাউন্ডেশনের সাহায্যে ১৯৫৮ সালে কৃষি গবেষণা ও শিক্ষা বিষয়ক স্নাতক স্তরের স্কুল ভারত সরকারের এই ইনস্টিটিউটে প্রতিষ্ঠিত হয়। যা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পেয়েছে।
আরও পড়ুন-রাজ্যের মানুষ শান্তি চায়, অন্যায় বরদাস্ত করা হবে না: রেড রোডের অনুষ্ঠান থেকে মুখ্যমন্ত্রী
তাঁর খ্যাতিচর্চা
ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির সভাপতি ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আর জ্ঞানেন্দ্রনাথ ছিলেন সম্পাদক। দশের দশকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর বিভাগ খোলা হয় সেখানে পঠন-পাঠনের দায়িত্ব কিছু নির্বাচিত মেধাবী তরুণদের উপর পড়ে। জ্ঞানেন্দ্রনাথ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ক্যালকাটা স্কুল অফ সায়েন্স তাঁর হাতেই গড়া। ১৯৩৪ সালে ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ সয়েল সায়েন্স প্রতিষ্ঠিত হয়। যার সভাপতিত্বের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডা-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞানী হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান বিষয়ক বহু কমিটির তিনি মধ্যমণি ছিলেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পরিচালক নিযুক্ত হন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট উপাধি দেয়। মৃত্তিকা বিজ্ঞানে তাঁর অবদানের জন্য তাকে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি ছাড়াও পেয়েছিলেন আরও পুরস্কার এবং সম্মান।
আরও পড়ুন-তছরুপের অভিযোগে ভাঙল যৌথ মঞ্চ, এফআইআরও
পদমর্যাদার অলঙ্কার
জ্ঞানেন্দ্রনাথ তাঁর এই বহুমুখী কর্মজীবনে আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক পদ। ভারতীয় কৃষি গবেষণা ইনস্টিউটের প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক ইত্যাদি। তাঁর বহুধা বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মমুখর জীবনবৃত্ত অনুপ্রেরণা জোগাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।