অক্ষয় তৃতীয়া হল চান্দ্র বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষের তৃতীয়া তিথি। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এই তিথি। বলা হয়ে থাকে, এই পবিত্র তিথিতে কোনও শুভকার্য সম্পন্ন হলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে।
অক্ষয় শব্দের অর্থ হল যা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। সমস্ত পুণ্যকর্মের অক্ষয় ফল লাভ হয় এই বিশেষ দিনে।
তবে অক্ষয় তৃতীয়া নিয়ে নানা জনপ্রিয় পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির একবার মহামুনি শতানিককে অক্ষয় তৃতীয়া তিথির মাহাত্ম্য কীর্তন করতে বললে জানা যায় এই কাহিনি।
আরও পড়ুন-মাটির কোলে মিশবে মাটি
পুরাকালে খুব ক্রোধী, নিষ্ঠুর ও স্বার্থসর্বস্ব এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। ধর্মে-কর্মে তাঁর তেমন মতি ছিল না। একদিন এক দরিদ্র ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণ অন্ন-জল ভিক্ষা চাইলে রেগে উগ্রমূর্তি ধরে তাঁকে তাড়িয়ে দেন। খিদে-তৃষ্ণায় কাতর সেই দরিদ্র ব্রাহ্মণ চলে যেতে উদ্যত হলে ব্রাহ্মণ-পত্নী সুশীলা ছুটে এসে সংসারের অমঙ্গল আশঙ্কায় ওই দরিদ্র ব্রাহ্মণকে সসম্মানে বসিয়ে অন্ন-জলের সুব্যবস্থা করেন। পিপাসার্ত ও ক্ষুধার্ত দরিদ্র অসহায় ব্রাহ্মণ সন্তুষ্ট হয়ে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন ওই রাগী ব্রাহ্মণ-পত্নী সুশীলাকে। এবং সুশীলার এই অন্ন-জল দানকে অক্ষয় দান হিসাবে বলেন।
কালের নিয়মে সময় চলে গিয়েছে। বহু বছর কেটেছে, সেই নিষ্ঠুর ব্রাহ্মণ বৃদ্ধ হয়েছেন। এবং তাঁর মৃত্যু আসন্ন। তাঁকে নিয়ে যেতে হাজির একইসঙ্গে বিষ্ণুদূত এবং যমদূতের দল। একদল বলছে তাঁকে বিষ্ণুলোকে নিয়ে যাবে, আরেক দল নরকে। এদিকে তৃষ্ণায় সেই ব্রাহ্মণ কাতর হয়ে যমদূতদের কাছে জল চাইলে তখন যমদূতরা তাঁকে তাঁর পূর্বকথা স্মরণ করায় এই বলে যে— ‘মনে পড়ে একদিন তুমি তোমার গৃহ থেকে পিপাসার্ত এক হতদরিদ্র ব্রাহ্মণকে নির্জলা বিদায় দিয়েছিলে?’ এই বলে তারা টানতে টানতে ধর্মরাজের কাছে নিয়ে যায়।
আরও পড়ুন-যামিনী রায়ের দুই বাড়ি, একদিকে আলো, অন্যদিকে অন্ধকার
ধর্মরাজ বলে, একে কেন আমার কাছে এনেছ? ইনি তো মহাপুণ্যবান ব্যক্তি। ওঁর স্ত্রী বৈশাখ মাসে অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে তৃষ্ণার্ত অতিথিকে অন্নজল দান করেছেন। সেই পুণ্যে উনিও পুণ্যাত্মা। আর সেই পুণ্যফলেই নরক-গমন হবে না। তোমরা এবার ওঁকে জল দাও। উনি এবার স্বর্গে গমন করবেন।
বিষ্ণুলোকে পৌঁছনোর পরে ভগবান বিষ্ণু সেই ব্রাহ্মণকে বললেন, তাঁর স্ত্রী একবারমাত্র অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে ব্রাহ্মণকে অন্নজল দান করেছেন। এটা আটবার করতে হবে। তবেই অক্ষয় পুণ্যলাভ সম্ভব। বিষ্ণু ব্রাহ্মণকে মর্ত্যে পাঠিয়ে দিলেন।
এরপর তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিলে আরও সাতবার অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে ভগবান বিষ্ণুর বলে দেওয়া নিয়মে অক্ষয় ব্রত পালন করলেন। এবং এই ঘটনা থেকেই শুক্লা তৃতীয়ার দিনে ব্রাহ্মণকে অন্নজল দান করার রীতি।
আরও পড়ুন-আহা গন্ধ আহা স্পর্শ
এ তো গেল জনপ্রিয় পৌরাণিক কাহিনিটি। এ-ছাড়াও অক্ষয় তৃতীয়াকে ঘিরে রয়েছে অজস্র পৌরাণিক কাহিনি। দেখে নেওয়া যাক সেগুলি কী?
মহাভারতের আরেকটি বহুল প্রচারিত কাহিনি— কৌরবদের কাছে পাশাখেলায় হেরে পাণ্ডবদের বারো বছরের জন্য বনবাস ও এক বছরের অজ্ঞাতবাসে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। বনবাসে থাকাকালীন কৌরবদের চক্রান্তে একদিন হঠাৎ করেই উপস্থিত হয়ে মুনি দুর্বাসা তাঁর অনেক শিষ্যদের নিয়ে পাণ্ডবদের কাছে আশ্রয় চান। দুর্বাসা অত্যন্ত তেজি ও ক্রোধী মুনি। এদিক-ওদিক হলেই অভিশাপ দিতে কসুর করেন না। ভয়ঙ্কর সেই অভিশাপ! দ্রৌপদী-সহ পাণ্ডবরা অত্যন্ত ভীত। দুর্বাসার আগমনে কী করবেন এই বনবাসকালে বুঝে উঠতে পারছেন না। ঘরে কোনও অন্ন নেই যা দিয়ে তাঁরা মুনিকে তুষ্ট করবেন। সেই বিপন্ন সময়ে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ উপস্থিত হন। শ্রীকৃষ্ণ উপস্থিত হয়ে ব্যাপারটা বুঝেই হাঁড়ির কোণে পড়ে থাকা একটি মাত্র চালের দানা খেয়ে নিলে তাঁর লীলায় দুর্বাসা ও তাঁর শিষ্যদের পেট ভরে গিয়েছিল। দুর্বাসার অভিশাপ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন পাণ্ডবরা কৃষ্ণের সহায়তায়। তৃতীয়া তিথি অর্থাৎ অক্ষয় তৃতীয়ার দিনেই। তাই দিনটিকে শুভ বলে মানা হয়।
আরও পড়ুন-রবিবার রাতেও মিলবে বিশেষ মেট্রো
এইরকম অসংখ্য পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে এই বিশেষ দিনটিকে ঘিরে।
যদিও মতান্তর, মনান্তর রয়েছে। কোনও প্রমাণও নেই। তবে কাহিনিগুলোও মানুষের বিশ্বাসে রয়ে গিয়েছে।
দ্বাপর যুগের কথা। বাল্যসখা সুদামা কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে এলেন সুদূর বৃন্দাবন থেকে দ্বারকায়। ভেবেছিলেন নিজের দারিদ্রের কথা জানিয়ে সাহায্য নেবেন সখার থেকে। কিন্তু সুদামা বন্ধুর কাছে যে আছে অকৃত্রিম আত্মীয়তা, যে নিখাদ ভালবাসা ও দুর্লভ সম্মান পান তখন লজ্জায় সুদামা আর নিজের দারিদ্রের কথা বলতে পারেননি। এবং দ্বাপরের কৃষ্ণের সম্পদ দেখে বন্ধুর জন্য আনা কাপড়ে বাঁধা চালভাজাটুকুও লজ্জায় দিতে পারেননি। অন্তর্যামী সখা সব বুঝে সানন্দে তা গ্রহণ করলেন। সখার সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দে আত্মহারা সুদামা মনে খুব খুশি নিয়েই ঘরে ফিরলেন।
আরও পড়ুন-রিজওয়ানুরের বাড়িতে মুখ্যমন্ত্রী, সঙ্গে ছিলেন অভিষেক-বাবুল
কিন্তু একি! তিনি তো তাঁর পরিচিত ঘর খুঁজে পাচ্ছেন না? তার পর্ণকুটির কোথায়? বরং সে-জায়গায় এক সুরম্য বাসগৃহ। স্ত্রী বসুন্ধরা আর সন্তানরা মহানন্দে রয়েছেন সেখানে। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে সুদামার দারিদ্রমোচন করেন স্বয়ং সখা শ্রীকৃষ্ণ।
মহাদেবকে দীর্ঘ তপস্যায় প্রসন্ন করে যক্ষরাজ কুবের ধনসম্পত্তির দেবতা হন এই তিথিতেই। মা অন্নপূর্ণা এই তিথিতেই আবির্ভূতা হয়ে মহাদেবকে অন্ন ভিক্ষা দেন। তারপর থেকে অন্নের অক্ষয় উৎসবস্বরূপা দেবী পূজিতা হন।
এই শুভ তিথিতেই পুণ্যসলিলা পাপহারিণী, পুণ্যতোয়া গঙ্গা মর্ত্যে অবতরণ করেন। সেই থেকে আজ অবধি নিরবচ্ছিন্নভাবে অক্ষয় জলস্রোত নিয়ে মর্ত্যবাসীর জীবনদায়িনী হয়ে বহমান।
আরও পড়ুন-অডিও ক্লিপে ফাঁস গরু পাচার করছেন বিজেপি বিধায়কের পুত্র, জড়িত নেতারাও
ভগবানের দশ অবতারের অন্যতম পরশুরাম এই তিথিতেই আবির্ভূত হন। বলা হয় এই তিথিতেই ব্যাসদেব মহাভারত রচনা শুরু করেন। মহাভারতের মধ্যে পঁচিশ থেকে বিয়াল্লিশ পর্যন্ত আঠারো অধ্যায় গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী রয়েছে। যা আদি অনন্তকাল হতে আমাদের জীবনদর্শন উত্তোলনের অক্ষয় পথপ্রদর্শক।
অক্ষয় তৃতীয়া তাই শুভ ফল দানকারী একটি তিথি। প্রাচীন কাল থেকে এই দিনে নানা শুভ কাজ সুসম্পন্ন করার বিধান শাস্ত্রে রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যেরও আলাদা গুরুত্ব রয়েছে এই দিনে। ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক স্থাপন অর্থাৎ দোকানে হালখাতা হয়। এ-ছাড়াও ব্যবসার স্থানে সিদ্ধিদাতা গণেশ ও ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর পুজো হয়।
আরও পড়ুন-গিরিরাজের নাটক, নিজের চিঠি নিজেকেই ফরোয়ার্ড!
লোক-বিশ্বাস আজও গভীরভাবে প্রোথিত মানুষের মনে এই যে, ব্রাহ্মণকে পাখা, ছাতা, ফল, অন্ন, জল দান করলে অক্ষয় পুণ্যলাভ হয় এই দিনে।
বেশ কিছু বনেদি পরিবারে আজও মানা হয় সাবেকি রীতিনীতি। লক্ষ্মী-গণেশের অথবা জনার্দনের বা গোপীনাথজিউর পুজো হয়। শাস্ত্রপাঠ চলে দিনভর। বাড়ির মেয়ে-বউরা নতুন শাড়ি পরে ভোগরাগ রান্না করে ঠাকুরকে নিবেদন করেন ও অক্ষয় ব্রতকথা শোনেন ঠাকুর দালানে বসে।
যুগের পর যুগ গিয়েছে, বদল ঘটেছে অনেক কিছুর। তবু আজও জনমানসে তাৎপর্যপূর্ণ এই অক্ষয় তিথিটি চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে।