জ্বলন্ত বইয়ের আগুন এখনও দুঃস্বপ্নে তাড়া করে বেড়াচ্ছে মহম্মদ শাকিরকে। তিনি বিহারশরিফে (Bihar Sharif) আজিজিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। তিনি অবশ্য ১৯৩০-এর নাৎসি জার্মানির বইয়ের বহ্ন্যুৎসবের সম্পর্কে কতটা অবহিত, সেটা বলা যাচ্ছে না। তাঁর দুঃস্বপ্নের কারণ অন্য। প্রায় ২৬ দিন আগেকার অভিজ্ঞতা। সেই অগ্নিময় অভিজ্ঞতা এখনও তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ২৬ দিন আগে দাঙ্গাবাজরা তাঁর ১১৩ বছরের প্রাচীন মাদ্রাসার গ্রন্থাগারের বইপত্র পুড়িয়ে দেয়।
৩১ মার্চ, ২০২৩। রামনবমীতে বিহারশরিফে (Bihar Sharif) শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল। তারপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা গ্রাস করে বিহারের এই অঞ্চলকে। বিবিসির রিপোর্ট বলছে, সেই দাঙ্গার সূত্রে অগ্নি সংযোজিত হয় মাদ্রাসা আজিজিয়ার লাইব্রেরিতে। চারদিন ধরে জ্বলেছে সেখানকার বইগুলো। ধিকধিক করে জ্বলতে থাকা আগুন নেভেনি।
প্রায় সাড়ে চার হাজার বই ছিল ওই গ্রন্থাগারে। তার মধ্যে অন্তত আড়াইশোটা বই বেশ প্রাচীন, বিরলও বটে। এই বইগুলোর মধ্যে ছিল কিছু কিছু হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি। ইউনানি পদ্ধতিতে চিকিৎসার ওষুধ-বিষয়ক পাণ্ডুলিপি যেমন ছিল তেমনই ছিল ফারসি, আরবি ও উর্দু ভাষায় লেখা বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য পুঁথি।
সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মহম্মদ শাকির বারবার বলছেন, বইগুলোকে না পুড়িয়ে ওরা আমাকে পুড়িয়ে মারলে ভাল হত।
এরকম ইচ্ছা প্রকাশ করাটা যে কোনও বিদ্যোৎসাহীর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। যে বইগুলো পুড়ে ছাই হল সেগুলোর বেশিরভাগেরই কোনও প্রতিলিপি বা ফটো নেই, ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষিতও হয়নি কোনওটাই। উত্তরকালের কোনও গবেষক নাগাল কিংবা হদিশ পাবে না বইগুলোর।
বই পুড়লেও মানুষ মরেনি। এই বহ্ন্যুৎসবের শেষে মাদ্রাসা-চত্বরে পাওয়া যায়নি কোনও পোড়া লাশ। কারণ, সেখানে পাঁচ শতাধিক আবাসিক থাকলেও সে-সময় রমজান উপলক্ষে এক মাসের ছুটি থাকায় আবাসিকরা সব হোস্টেল ছেড়ে যে যার বাড়িতে গিয়েছিল। দিনটি শুক্রবার হওয়ায় সাপ্তাহিক ছুটিতে চত্বরে ছিলেন না মাদ্রাসার কর্মচারীরাও। অল্প যে কয়েকজন ছিলেন, তাঁরা দাঙ্গাবাজদের দেখে গা-ঢাকা দিতে সফল হয়েছিলেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে যাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী তাঁরা জানিয়েছেন, লাঠি, পাথর আর পেট্রোল বোমা নিয়ে প্ররোচনামূলক স্লোগান দিতে দিতে মাদ্রাসা ভবনে চড়াও হয় হামলাবাজেরা। প্রথমেই তারা হোস্টেলের ওপর আক্রমণ চালায়।
পুলিশ বলছে, আক্রমণকারীরা বজরং দলের সদস্য। এই ঘটনার জেরে তারা দেড়শো জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের ভেতর নালন্দা জেলায় বজরং দলের আহ্বায়ক কুন্দন কুমারের মতো ব্যক্তিও আছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিহার শরিফ নালন্দা জেলার অন্তর্গত। এটি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের জেলা।
এবারের ইদের দিনটা মাদ্রাসার পোড়া বইগুলো সরাতে আর দেওয়াল ও থামগুলো থেকে পোড়ার কালি মুছতে কেটে গিয়েছে মাদ্রাসার কর্মী-শিক্ষকদের। বিহারের এই অঞ্চলে তখন গরম ছিল ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি, কিন্তু মাদ্রাসায় অগ্নিকাণ্ডের জেরে ছিল না জল কিংবা বিদ্যুৎ সংযোগ।
এখন দুষ্প্রাপ্য বইগুলো ছাড়াই মাদ্রাসটাকে তার পুরনো চেহারায় ফিরিয়ে আনতে কমপক্ষে তিন কোটি টাকা খরচ হবে। কে বহন করবে এই বিপুল ব্যয়ভার? সরকারি অধিকারিকদের কাছে পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে আবেদন করা হয়েছে আর্থিক সাহায্যের জন্য। কিন্তু এখনও অবধি কোনও তরফ থেকেই সাহায্যের নিশ্চিত আশ্বাস পাওয়া যায়নি। বিহার রাজ্য মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অবশ্য নিজস্ব উদ্যোগে আজিজিয়া মাদ্রাসা ও সেটির গ্রন্থাগারের সংস্কার করার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে জানা গিয়েছে। দুষ্প্রাপ্য বই তো আর পাওয়া যাবে না। তাই, প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক দিয়ে সাহায্য করার কথা ভাবছেন তাঁরা।
১৮৯৬ সালে বিবি সোগহারা নামের এক বিধবা মহিলা তাঁর পরলোকগত স্বামী আবদুল আজিজের স্মৃতিতে এই আজিজিয়া মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর গড়ে ওঠে গ্রন্থাগার। মাদ্রাসাটি প্রথমে চালু হয়েছিল পাটনায়। তারপর সেটি বিহার শরিফে স্থানান্তরিত হয়।
ইতিহাস বলছে, এই দাঙ্গাধ্বস্ত বিহারশহিফ (Bihar Sharif) একদা পাল রাজাদের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ছিল। পরবর্তিকালে কয়েক শতাব্দী জুড়ে এখানে বিকশিত হয়েছিল সুফি সাধনা।
ইতিহাস আরও বলছে ১৯৩০-এর দশকে জার্মানিতে নাৎসি প্রভাবিত ছাত্র সংসদগুলো বই পোড়ানোর ডাক দিয়েছিল। নাৎসি- দর্শনের বিরোধিতা করা হয়েছে কিংবা ইহুদিদের লেখা, এরকম বইগুলোই ছিল তাদের প্রধান টার্গেট। কমুনিস্ট, সমাজতন্ত্রী, নৈরাজ্যবাদী, উদারপন্থী, শান্তিকামী, কারোর বই-ই ছাড় পাইনি তাদের আগুন থেকে। যেসব বই পোড়ানো হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে ছিল আলবার্ট আইনস্টাইনের লেখা বইও।
দায়বর্জন বিবৃতি বা ডিসক্লেমার : ১৯৩০-এর জার্মানির সঙ্গে ২০২৩-এর বিহারশরিফের মিল যদি কেউ খুঁজে পান, সে-দায়িত্ব এই কলমচির নয়।
আরও পড়ুন: জীবন বাজি রেখে বন্দুকবাজ ধরল পুলিশ