কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে রাজার কর্তব্য সম্পর্কে বলেছিলেন, প্রত্যেকদিন রাজাকে সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযোগ শোনার জন্য অনেকটা সময় দিতে হবে। রাজা তখনই ‘রাজর্ষি’ হবেন যদি তিনি শুধু গোয়েন্দা রিপোর্ট আর মন্ত্রী-আমলাদের বদলে মানুষের কথা শোনেন। কৌটিল্য রাজার একটি প্রাত্যহিক রুটিন তৈরি করে করে দেন, সেখানে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাড়ে ৪ ঘণ্টা ঘুম, স্নান আর ভোজনের জন্য তিন ঘণ্টা বরাদ্দ। দেড়ঘণ্টা নিজের বিনোদনের জন্য কিন্তু দেড়ঘণ্টা আম-নাগরিকের সঙ্গে জনসম্পর্ক। এ-ছাড়া কৌটিল্য বলেন, রাজা মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়বেন নগরে-গ্রামে। এমনকী রাজা ছদ্মবেশেও ঘুরবেন। রাজা ধননন্দকে সরিয়ে খ্রিস্টপূর্ব ৩২১-এ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ক্ষমতাসীন হন। কিংবদন্তি, কৌটিল্য সাধারণ মানুষদের কাছ থেকেই প্রথম জানতে পারেন ধননন্দ রাজকোষের মোহর জঙ্গলের মাটিতে পুঁতে রাখেন রাতের অন্ধকারে।
ভারতের মতো এই বিশাল দেশে ১৯৩০ সালে গান্ধী প্রথম লবণযাত্রা করেন। এরপর অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধেও গান্ধী রাজ্যওয়ারি অভিযান চালান। আচার্য বিনোবা ভাবে ৫১ সালে ভূদান আন্দোলন চলার সময় দীর্ঘ পদযাত্রা করেন। জয়প্রকাশ নারায়ণও একদা ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যাত্রা করেন। লালকৃষ্ণ আদবানির রামরথ যাত্রাও আমরা দেখেছি।
পৃথিবী আজ রাজনীতির জগতে জনসংযোগের ক্ষেত্রেও অনেক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। সোশ্যাল মিডিয়া, ডিজিটাল ভিডিও প্রযুক্তি, এমনকী আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স পর্যন্ত এসে গিয়েছে। ভোটের সময় জনসভায় মানুষের সমাগম কমছে কারণ জনসভারও লাইভ টেলিকাস্ট মানুষ দেখছে ঘরে বসে। জনসভা হয়ে যাওয়ার পরও ইউটিউব বা অন্য মাধ্যমে পুরনো সভা পুরো দেখা যায়। এবু এত আধুনিক প্রযুক্তির রমরমার পরও এদেশে রাজ্যে রাজ্যে বিশেষত গ্রামে গ্রামে রাজনেতাদের সরাসরি জনসংযোগের কর্মসূচি আজও প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর।
এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় দু’মাস ধরে তৃণমূল কংগ্রেসের আজকের প্রধান রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী অধিনায়ক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লাগাতার ‘জনসংযোগ যাত্রা’র (Jono Sanjog Yatra- Abhishek Banerjee) বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন। ২৫ এপ্রিল থেকে এই অভিযান শুরু হয়েছে। অভিষেক এই দু’মাস কলকাতায় ফিরছেনই না, উত্তর থেকে দক্ষিণ এ বঙ্গদেশের প্রতিটি জেলা তিনি ঘুরছেন, জনসভা করছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বুঝতে চাইছেন রাজ্যের গ্রাউন্ড রিয়ালিটি।
অভিষেক ক্ষমতাসীন মন্ত্রী নন কিন্তু দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পর জেলায় জেলায় মানুষের এখনও কী কী সমস্যা আছে তা বোঝার চেষ্টা, জানার চেষ্টা। সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতা-অসন্তোষের খতিয়ান গ্রহণ— এটা শুভ উদ্যোগ। এটাই তো কৌটিল্য-প্রদর্শিত রাজর্ষির কাজ।
অভিষেক বয়সে নবীন। ৩৫ বছরের এক যুবক। নিজে প্রায় চার দশক সর্বভারতীয় রাজনীতি সভা করার দৌলতে আজ একথা দ্বিধাহীন ভাবে বলতে পারি, অভিষেক উত্তরপ্রদেশের অখিলেশ এমনকী রাহুল গান্ধীর চেয়েও বেশি ধারাবাহিক কনসিসটেন্ট পরিশ্রমী। ২৪x৭ রাজনীতি করেন। আজও জেলায় জেলায় গিয়ে জনসংযোগ স্থাপনায় এই মে মাসের আবহাওয়ায় আর যা-ই হোক খুব বিনোদনমূলক তো বলা যায় না। অভিষেক খুবই আধুনিক মনস্ক। তিনি ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেন পেশাদারি সমীক্ষা রিপোর্টে। অনেক সময় একটি নয় একাধিক এজেন্সি মারফত তিনি স্বল্পমেয়াদি চটজলদি সমীক্ষাও করে নেন বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে।
তৃণমূল কংগ্রেস যেমন একটি দলীয় সংগঠন তেমনি আজ বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় দলীয় সদস্যদের বাইরেও আছে এক বিপুল জনসমাজ। এই জনসমাজের মানুষেরা দলের ক্যাডার নন কিন্তু এই বাংলার আমজনতা। তারা কখনও তৃণমূলের সমর্থক, কখনও বিরোধী। এই জনসমাজ গণতন্ত্রের পক্ষে। পঞ্চায়েত ভোটের সময়ও তারা নির্বাচিত প্রতিনিধিকে যথার্থ সৎ, স্বচ্ছ তাদের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চান। সেজন্য অভিষেক দলের ভিতর দীর্ঘ শাসনে গজিয়ে ওঠা মৌরসি পাট্টার সামন্ততান্ত্রিক ট্রাডিশন ভেঙে মানুষের ভোটে প্রার্থী মনোনয়ন করতে চাইছেন। কাজটা সহজ নয়। দলের প্রভাব প্রতিপত্তি ক্লাযেন্টেল একদিকে, অন্যদিকে নাগরিক সমাজ-এর মধ্যে সংঘাত কাম্য নয়। অভিষেক এই লক্ষে অনড়। এই জেলাওয়ারি সফরে অভিষেকের এই চেষ্টার পক্ষেই সাধারণ মানুষ। দলীয় বিশৃঙ্খলা মারামারি ব্যালট কাগজ ছেড়াঁর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বরং অভিষেকের ব্যক্তিগত চেষ্টা ও তাঁর সংস্কারবাদী ভাবমূর্তিকেই আরও প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আরও পড়ুন- তিনদিনের মালদহ সফর, বুধবার যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী
সিবিআই-এনফোর্সমেন্ট যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Jono Sanjog Yatra- Abhishek Banerjee) কোনও রেহাই দিচ্ছে না সেটাও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অভিষেকের ঘনিষ্ঠ নেতাদের, ব্যক্তিদের একে একে টার্গেট করা হচ্ছে। তল্লাশি হচ্ছে। ২০২৪ ভোট যতই এগিয়ে আসবে বিজেপির টার্গেট অভিষেক-কৌশল ততই স্পষ্ট হবে। যেমনটা হয়েছিল ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের মুখে। তাতে অভিষেক যে ভীতসন্ত্রস্ত এবং আপসকামী নন সেটারও এক মস্ত বড় প্রমাণ এই দু মাসের লাগাতার জেলা সফর। তিনি যেভাবে প্রতিদিন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে আক্রমণ করছেন, যেভাবে তিনি বিজেপির ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব ফাঁস করে চলেছেন তাতে তাঁর আক্রমণাত্মক রাজনীতি দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
দিল্লির সর্বভারতীয় শীর্ষ বিজেপি নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ২০২৬ সালে ক্ষমতাচ্যুত করতে চান, ২০২৪ সালে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন যাতে ২০১৯ সালে পাওয়া আসনগুলোর কিছু অন্তত রক্ষা করা যায়। বিজেপি সর্বশক্তি দিয়ে মমতা-অভিষেক বিরোধিতা করবে এ তো স্বাভাবিক। বিজেপিকে বিজেপির কাজ করতে হবে। কিন্তু বিজেপির শীর্ষ নেতারা যাঁরা পরিণতমনস্ক তাঁরা স্বীকার করছেন পশ্চিমবঙ্গে মমতা-অভিষেক এই দ্বৈতশক্তি এক ‘ইউনিক’ রাজনৈতিক ফেনামেনন প্রমাণে তাঁরা মমতা বনাম অভিষেক দ্বৈরথের আলোচ্য রচনার চেষ্টা করেন। মিডিয়া-সোশ্যালমিডিয়ায় একদা সে-প্রচার কম হয়নি। এখন সেই নেতারাই বলছেন, প্রবীণ আর নবীনের এ এক ‘ডেডলি কম্বিনেশন’ মুলায়ম-অখিলেশ এমনকী সানিয়া-রাহুলের চেয়েও এই উত্তরাধিকারের রাজনীতি আরও কার্যকর। জ্যোতি বসু এবং অনিল বিশ্বাসের সময় আমরা রাইটার্স আর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের যৌথ রণকৌশল দেখেছি এমনকী উন্নততর বামফ্রন্টের স্লোগান নিয়ে দলকে পরে প্রচারাভিযানে নামতে দেখেছি ভোটের সময়। কিন্তু সেখানেও সরকার ও দলের সংঘাত ছিল। বহুক্ষেত্রে তা কদর্যভাবে প্রকাশ্যে আসে।
এখন মমতা-অভিষেকের দ্বৈত রাজনীতির ব্যাকরণ সুনির্দির্ষ্ট, সুপরিকল্পিত। অনেকে জানেন, অনেকে জানেন না— যুব নেতা কিন্তু প্রতি সপ্তাহে একদিন কালীঘাটে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সমস্ত তথ্য, সমস্ত ইনপুট দেন। সমস্ত ভষিষ্যৎ রণকৌশল তৈরির পিছনেও কাজ করে ‘দিদির’ মস্তিষ্ক। এই যৌথভাবনার ফসল এই জেলাওয়ারি লাগাতার প্রচার অভিযান।
শাসক দলের হেজেমনি আর মানুষের বিরোধ নতুন বিষয় নয়। চিনের কমিউনিস্ট পার্টির একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে মানুষ ধনী কর্পোরেট সমাজও ফুঁসছে যা ঘোচাতে আজ চিনও সক্রিয়। চিনে গণতন্ত্র নেই তাই পার্টি ও মানুষ মাছ আর জল বললেও বাস্তব তা নয়।
পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র আছে কিন্তু মানুষের মন বুঝতে গ্রামে যাওয়া অভিষেকের এক অসাধারণ রাজনীতি দর্শন। রবীন্দ্রনাথের গোরাও শহুরে হলেও গ্রামে গিয়ে নীল চাষিদের দুর্গতি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সিয়িং ইজ বিলিভিং। অভিষেকের নবীন দৃষ্টি ভবিষ্যৎ বাংলার চলার পাথেয়।