জিনের বিবর্তন
এ-কথা একেবারেই অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, আমরা বাঁদরের বংশধর অর্থাৎ বানরজাতিই আমাদের পূর্বপুরুষ আর আমাদের সবচেয়ে নিকট আত্মীয় হল শিম্পাঞ্জি। যদিও কালের নিয়মে আর বিবর্তনের আনুকূল্যে আজ আমরা আধুনিক মানুষে পরিণত হয়েছি। কিন্তু আমরা যদি একবার আমাদের বিবর্তনের পথে ফিরে দেখি তাহলে দেখতে পাব এই বিবর্তন কিন্তু আসলে হয়েছিল জিনের— আর এই সূত্র ধরেই হবে আজ আমাদের আলোচনা। আমরা সেই ছোটবেলা থেকে জেনে বা পড়ে এসেছি যে কীভাবে বাঁদরের শারীরিক, চারিত্রিক, আচরণগত পরিবর্তনের দ্বারা আজকের মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। কীভাবে মানুষের মস্তিষ্ক ক্রমে জটিল হয়ে উঠেছে, বেড়েছে মানুষের বুদ্ধাঙ্ক—এইসবই এসেছে বিভিন্ন কালে ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। এই ঘটনাক্রম এই ধারাবাহিক পরিবর্তন সবটাই আমাদের কমবেশি জানা কিন্তু আমাদের যা জানা নেই তা হল, এই সমস্ত পরিবর্তনের পিছনে থাকা সেই নাটের গুরুর কথা— যে কিনা এই সমস্ত পরিবর্তনের পরিচায়ক— জিন (Gene), অস্ট্রালোপিথেকাস থেকে হোমো সেপিয়েন্সের— এই দীর্ঘ যাত্রাপথের একমাত্র কান্ডারি।
জানা চেনা জিন
মেন্ডেলের ‘ফ্যাক্টর’, যা কোনও জীবের গঠনের মূল পরিচায়ক, DNA-এতে থাকা একটি নির্দিষ্ট বেসসজ্জা যা নির্দিষ্ট একটি পলিপেপটাইড গঠন করতে পারে সেটিই জিন। জিন কী আর এর কাজই বা কী আজ প্রায় সবারই জানা। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বললে জিনকে (Gene) আমাদের দেহের বা যেকোনও জীবের দেহের ব্লু-প্রিন্ট বলা একেবারেই অত্যুক্তি করা হবে না। এই জিন যে বংশগতির বাহকও বটে— তা বুঝি জিন কথাটি শুনলে সবার আগে মনে পড়ে। জিন ছাড়া যে দেহের গঠন সম্ভবই না— এই কথাটির দিকেই আমারা দৃষ্টিপাত করব। তাহলে এর সূত্র ধরেই বলা যায় যে সেই বানর জাতি থেকে মানুষ হয়ে ওঠার যে সুদীর্ঘ পথ তা জিনের হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্ভব হত না। সাধারণত আমরা সবাই জানি যে মানুষ নাকি উন্নত জীব সমস্ত জীবের থেকে। তাহলে নিশ্চয়ই মানুষের দেহে জিনের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার কথা যদি আমরা এতক্ষণ ধরে যে জিনচর্চা করলাম তার ধারণা মাথায় রাখি তাহলে সবাই এটাই ভাববে বা এটাই হওয়া উচিত বলে সবার মনে হবে। কিন্তু হয় ঠিক এর উল্টো। এই উলট পুরাণেরই ব্যাখ্যা দিয়েছেন হার্ভাড ও ইয়েল ইনস্টিটিউটের কিছু গবেষক।
গবেষণার তথ্য
আসলে হার্ভাড ও ইয়েল ইনস্টিটিউটের কিছু গবেষক সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রে এটিই দাবি করেছেন যে আমাদের পূর্বপুরুষ যতই আমাদের থেকে অনুন্নত হোক না কেন আমাদের থেকে তাদের জিনের পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। আর আমাদের জিনের (Gene) এই ঘাটতিই নাকি আমাদের উন্নত গঠনের পরিচায়ক। ২৮ এপ্রিল প্রকশিত ওই গবেষণাপত্রে বলা হয় যে তারা মনুষ্যেতর প্রাণীর জিনোমের সঙ্গে মানুষের জিনোমের তুলনা করে দেখেছেন যে মানুষের জিনোমে তাদের পূর্বপুরুষের তুলনায় ১০,০০০ বিট জিন কম রয়েছে। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল, এই বিপুল জিনোম-কে পরীক্ষণের জন্য তারা যে যন্ত্রটি ব্যবহার করেছে সেটি হল- Massively Parallel Reporter Assays (MPRA), যা কিনা একই সঙ্গে হাজারেরও বেশি প্রজাতির জিনের পরিবর্তন তথা কাজ নিরীক্ষণ করার ক্ষমতা রাখে। এই যন্ত্রটিই নাকি এই জিনের ঘাটতির কথা জানান দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল এত বিপুল পরিমাণ জিনের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও আমরা কীভাবে উন্নত প্রজাতির তকমা পেলাম? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আগে কয়েকটি বিষয় সম্বন্ধে একটু পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার।
জিন খুইয়েও কেন উন্নত
আসলে আমাদের জিনগুলির সবটাই যে কোনও না কোনও প্রোটিন তৈরি করে সেই কথাটি সর্বাথে ঠিক হলেও প্রত্যেকটি প্রোটিনের সক্রিয়তা যে সর্বার্থে আমাদের খুব কাজের তা না-ও হতে পারে, অর্থাৎ কোনও প্রোটিন আবার অন্যান্য প্রোটিনের কাজে বাধা সৃষ্টি করার দ্বারা তাদের কার্যকারিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যাকে আমরা নিয়ন্ত্রক প্রোটিন বলি। এইগুলির জন্যও থাকে বিশেষ কিছু জিন। তাহলে, যদি এই বাধাদানকারী জিনগুলিকে সরানো যায় আমরা নিশ্চয়ই তখন অন্যান্য জিন (Gene) তথা প্রোটিনের কার্যকারিতাকে উন্মোচিত করতে পারব। ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছে মানবজাতির ক্ষেত্রেও। বানরজাতি থেকে মানুষ হয়ে ওঠার পথে বিবর্তনের জন্য তারা এমন কিছু জিন বিসর্জন দিয়েছে যেগুলি তাদের মস্তিষ্ক, বুদ্ধাঙ্ক, জ্ঞানভিত্তিক দক্ষতা ইত্যাদি প্রকাশের পথে প্রধান অন্তরায় ছিল। আসলে বিজ্ঞানীদের মতে ওই অতিরিক্ত জিন সাধারণত মস্তিষ্ক ও জ্ঞানভিত্তিক দক্ষতার গুণগুলিকে ‘সুইচ অফ’ করে রেখেছিল। এর সূত্র ধরেই ইয়েল ইন্সটিটিউশনের জেনেটিক্সের সহকারী অধ্যাপক স্টিভেন রেইলি বলেন— ‘প্রায়শই আমরা মনে করি নতুন জৈবিক ক্রিয়াকলাপের জন্য আমাদের নতুন DNA-এর টুকরো প্রয়োজন, কিন্তু এই গবেষণা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে জেনেটিক কোড মুছে ফেলা সত্ত্বেও আমরা স্বতন্ত্র প্রজাতি হিসেবে কিন্তু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী উঠেছি।’ তিনি একটি খুব সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বলেছেন— যদি আমরা isn’t থেকে n’t বাদ দিয়ে দিই তবে শুধু is পড়ে থাকে অর্থাৎ হয় না থেকে হয়। এর ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটে।
আরও পড়ুন-সুদানে যুদ্ধ: খাদ্য, ওষুধের সংকট দেশজুড়ে
ইয়েলের গবেষকগণ তাঁদের পরীক্ষায় দেখেছেন যে DNA-এর এই ১০,০০০ টুকরোর ঘাটতি সমগ্র মানবজাতির ক্ষেত্রেই রয়েছে। এমনকী তাঁরা পরীক্ষা করে এ-ও জানতে পেরেছেন যে শুধু এগুলোই নয়, এমন অনেক জিনোম সিকোয়েন্স রয়েছে যা ইঁদুর থেকে তিমি সবার ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকলেও একমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই সেটি নেই। তারা প্রায় ২৪০টি স্তন্যপায়ী প্রজাতির DNA সিকোয়েন্স পরীক্ষা করেছেন এবং দেখেছেন মনুষ্যেতর প্রাণীদের ক্ষেত্রে DNA-এর পরিমাণ মানুষের থেকে বেশি। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এই বিপুল DNA-এর ঘাটতি কিন্তু এমনভাবে কাজ করেছে যে মানুষের মস্তিষ্কের দক্ষতা গেছে বেড়ে, জটিল জ্ঞানভিত্তিক ক্রিয়াকলাপে তারা হয়ে উঠেছে পারদর্শী, আরও একটি স্বতন্ত্র গুণ যা মানুষের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে সেটি হল কথা বলার ক্ষমতা, তা-ও এসেছে এই জিন খুইয়েই। এক কথায় বলতে গেলে এভাবে বলা যায়, যে বানর-রা তাদের জিন খুইয়েই মানুষ হয়ে উঠেছে।