ফলহারিণী ষোড়শীপুজো

জ্যৈষ্ঠমাসের অমাবস্যা তিথিতে বাংলার মন্দিরে-মন্দিরে ফলহারিণী কালীপুজোর আয়োজন করা হয়। আবার রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনে এই দিনটিকে ফলহারিণীপুজোর থেকে ষোড়শীপুজোর দিনরূপেই বেশি চিহ্নিত করা হয়। মূর্তি বা যন্ত্রতে নয়, স্বয়ং মানবশরীরকে এদিন আরাধনা করেন শ্রীরামকৃষ্ণ। লিখছেন পূর্বা সেনগুপ্ত

Must read

ধূপ-দীপ-গন্ধে সেদিন দক্ষিণেশ্বরের আকাশ পরিপূর্ণ হয়েছিল। সকলের অগোচরে ঘটে গেল এক আশ্চর্য যুগান্তকারী ঘটনা। এক সাধক তাঁর সহধর্মিণীকে পুজো করলেন মাতৃরূপে। সেদিন ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথি। বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে শক্তি আরাধনা বা দেবীপুজোর আয়োজন সর্বাধিক। এখনও অনেক অঞ্চল আছে যেখানে প্রতি অমাবস্যায় কালীপুজো অনুষ্ঠিত হয়। কথায় বলে যেখানে বাঙালি সেখানেই মাকালী। আমাদের বঙ্গদেশে শক্তিপুজোর চল বেশি। এই অঞ্চলে বেদের থেকে তাই তন্ত্রের আচার অধিক পালিত হয়। এ-প্রসঙ্গ আরও বিস্তারিত করলে বিভিন্ন কালীপুজোর রূপগুলি আমাদের কাছে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হবে।

আরও পড়ুন-মহানগর নয়, চারুলতাই মানিককাকুর সেরা ছবি : জয়া বচ্চন

বাংলাকে শাক্তধর্মের দেশ বা ‘শক্তিপ্রধান’ দেশ বলে চিহ্নিত করা হয়। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারোর যুগ থেকে বেদ, উপনিষদ ও তন্ত্রের মধ্যে এই শক্তি-আরাধনার কথা বলা হয়েছে। ভারতে মাতৃসাধনার যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে তা বিন্ধ্যপর্বতকে কেন্দ্র করে উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বে প্রধানত তিনটি ধারায় প্রবাহিত। বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণাংশ ‘অশ্বক্রান্তা’ নামে, বিন্ধ্যপর্বতের উত্তরে কাশ্মীর পর্যন্ত ‘রথক্রান্তা’ নামে এবং বিন্ধ্যপর্বত থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ‘বিষ্ণুক্রান্তা’ নামে পরিচিত। বিষ্ণুক্রান্তার অন্তর্ভুক্ত বঙ্গদেশে শক্তিসাধনা ‘কালীকুল’ নামে এক বিশেষ ধর্মসাধনায় রূপ লাভ করেছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের মাতৃসাধনা সেই সাধনারই ধারাবাহী। ফলহারিণী কালীপুজো ও শ্রীরামকৃষ্ণের সারদা আরাধনার বিস্তৃত আলোচনায় শক্তিপুজোর ধারাটিকে তুলে ধরা খুবই প্রয়োজনীয়।

আরও পড়ুন-ভগ্নপ্রায় রাজবাড়িতে বায়োপার্ক, কটেজ গড়বে প্রশাসন

জ্যৈষ্ঠমাসের অমাবস্যা তিথিতে বাংলার মন্দিরে-মন্দিরে ফলহারিণী কালিকা পুজোর আয়োজন চলে। এই কালীপুজো একেবারেই বাংলার লোকায়ত ধারার সঙ্গে যুক্ত। দেবীর ফলহারিণী রূপের কোনও পৌরাণিক কাহিনি আমরা পাই না। পুরাণে এই দেবীর কোনও বিশেষ রূপবর্ণনার দেখাও পাওয়া যায় না। তবু বাংলায় এই রূপে দেবী পূজিতা হন। কালীরূপ অনেক— দক্ষিণাকালী, বামাকালীর সঙ্গে বিভিন্ন রূপে পূজিতা হন দেবী। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে আমরা দেখি শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, ‘তিনি নানাভাবে লীলা করছেন। মহাকালী, নিত্যকালী, শ্মশানকালী, রক্ষাকালী, শ্যামাকালী।’ ফলহারিণীকালী এইসব কালীরূপের মতো বিশেষ কোনও রূপ নয়। সাধারণ ভাবে বলা হয় দেবী সাধকের সমস্ত কর্মফল হরণ করেন। তাই তিনি ফলহারিণী।

আরও পড়ুন-হোমস্টে মার্ডারস

জ্যৈষ্ঠ মাসে অমাবস্যায় কালীপুজোটি বিশেষভাবে সম্পন্ন করা হয়। এই পুজো বাংলার সমস্ত দেবীমন্দিরে পালিত হয়। বঙ্গে যে সমস্ত শক্তিপীঠ বর্তমান সেখানেও বিশেষ পুজোর আয়োজন হতে দেখা যায়। কিন্তু পুজোপদ্ধতি অনুসরণ করলে বোঝা যায়, এইদিনের পুজোয় কোনও বিশেষ পুজোপদ্ধতির কথা বলা হয়নি। সাধারণত দক্ষিণাকালী যে মন্ত্রে ও যে আচারে পূজিতা হন, ঠিক সেই আচারে ও মন্ত্রে ফলহারিণী কালিকাপুজো সম্পন্ন করা হয়। তবু পৃথক একটি আচার আছে, সেটিকে বিশেষ আচারও বলা যেতে পারে। এই পুজোর সময় দেবীকে নানারকম ফল দান করতে হয়। শব্দকল্পদ্রুমে বলা হয়েছে, ‘জ্যৈষ্ঠ-পঞ্চদশ্যাং বহুফলাদ্যুপহারৈঃ পূজনীয়া’— অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠমাসের অমাবস্যায় সাধক নানাবিধ ফলের উপহার সহযোগে দেবীর পুজো করবেন। আবার অন্য একটি বিধানে ক্রিয়াকাণ্ড বারিধিতে বলা হয়েছে, ‘জ্যৈষ্ঠে মাসি তথামায়াং সফলং কালিকার্চনম— জ্যৈষ্ঠমাসের অমাবস্যায় বিশেষভাবে নানাবিধ ফল দিয়ে কালিকাদেবীর পূজা করতে হয়।’ এ-প্রসঙ্গে মায়াতন্ত্রের সতেরো পর্বে আরও স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে,
‘জ্যৈষ্ঠ মাসি অমায়াং বৈ মধ্যরাত্রে মহেশ্বরি।

আরও পড়ুন-ইস্টবেঙ্গলে আজ সলমন

পূজয়েত কালিকাং দেবীং নানাদ্রব্যোপহারকৈঃ।।’ অর্থাৎ, জ্যৈষ্ঠমাসের অমাবস্যা তিথির মহানিশায় সাধক নানা দ্রব্যের উপহার সহযোগে শ্রীশ্রীকালিকাদেবীর জ্যৈষ্ঠ করবেন। এখানে মহানিশা কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ফলহারিণী কালীপূজা অবশ্যই গভীর রাত্রে করতে হয়।
আমাদের সব থেকে কাছের শক্তিপীঠ হল কালীঘাট। সেখানে এই বিশেষ অমাবস্যার দিন গর্ভমন্দিরের ঠিক সামনে, প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের সম্মুখে বিরাট রুপোর থালায় সাজিয়ে দেওয়া হয় নানা ফলের রাশি। দেবীও সেদিন রুপোর সাজে সজ্জিতা হন। তাঁর বিরাট লোলজিহ্বাটিও রূপার হয়, মাথায় রুপো দিয়ে তৈরি বিরাট মুকুট। সেইদিন রাত্রে দেবীর সম্মুখে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। ফলহারিণী কালীপুজোর আয়োজন দেখলে আমাদের মনে হয় জ্যৈষ্ঠমাস বাংলার বাগানের নানা ফলের সম্ভারে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আম, জাম, কাঁঠাল থেকে শুরু করে নানাবিধ ফলের গন্ধে গৃহস্থের গৃহ ম-ম করে। সেই ফলের সম্ভারের জন্যই এই মাসে জামাইষষ্ঠীর আয়োজন। সুতরাং বাঙালির জীবনে যে দেবী ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন তাঁকে ফলদান না করে কি থাকা যায়? এই ঋতুতে বিশেষ ভাবে যে দেবীর পুজো হয় তাকে ফলহারিণী নামে পরিচিত হতেই হবে। আর তার সঙ্গে কর্মফল হরণের কাহিনি তো আসবেই। ফলহারিণী কালীপুজো বাংলার রক্ষাকালী পুজোর মতো খানিকটা। রক্ষাকালীদেবী যেদিন নির্মিত হন সেদিনই পূজিতা ও বিসর্জিতা হন। কিন্তু ফলহারিণী কালীপুজো সেখানেই সম্পন্ন হয়, যেখানে দেবী স্থায়ী বিগ্রহে স্থাপিত ও বারোমাস পূজিত। আবার কালীমন্দির, সিদ্ধপীঠ ও শক্তিপীঠ— সব স্থানেই আমরা ফলহারিণী কালীপুজো অনুষ্ঠিত হতে দেখি। এই পূজা লোকায়ত ধারায় গড়ে উঠলেও তা তন্ত্রমতে শুদ্ধাচারে দক্ষিণাকালী রূপে পুজো সম্পন্ন করা হয়। এই হল বাংলায় ফলহারিণী কালীপুজোর ইতিহাস। এই পুজো বাংলায় আরও বেশি মাহাত্ম্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে দক্ষিণেশ্বরে রানি রাসমণির প্রতিষ্ঠিত ভবতারিণী দেবীর বিশেষ পুজোর দিনটিতে। সেদিনও ছিল ফলহারিণী কালীপুজো।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

১২৮০ বঙ্গাব্দ। সাধারণত অমাবস্যা তিথিতে মন্দিরে দেবীপুজোর আয়োজন করা হয়। দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে সেই ধারা অনুসরণ করেই সেদিন ফলহারিণী কালীপুজোর আয়োজন করা হয়েছিল। সকলে গভীর রাত্রিতে অনুষ্ঠিত এই পুজোর জন্য ব্যস্ত। রানির প্রতিষ্ঠিত দেবীপুজোর আয়োজন তো কম নয়! কিন্তু এই পুজোর আয়োজনের আড়ালে আরেকটি পুজোর প্রস্তুতি শুরু হচ্ছিল নিভৃতে। কালীমন্দিরের এক কোণে পূজারি ছোট ভটচায শ্রীরামকৃষ্ণের থাকার ঘর। কয়েকমাস আগেই জয়রামবাটি থেকে দক্ষিণেশ্বরে এসেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ-পত্নী শ্রীমা সারদা দেবী। পাশেই নহবতে বাস করছেন শ্রীরামকৃষ্ণ-জননী চন্দ্রাদেবী। তবু সেদিন কী হতে যাচ্ছে সে-সম্বন্ধে ধারণা ছিল না কারওর। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের ঘরে দেবী আরাধনার সমস্ত উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। দেবীর জন্য পরনের নতুন কাপড়ও জোগাড় করেছেন ইহবিমুখ সাধক শ্রীরামকৃষ্ণ। সেদিন গভীররাতে তিনি পুজোর আসনে বসলেন পূজারি হয়ে, সম্মুখে জ্যান্ত প্রতিমা শ্রীশ্রীমা সারদা দেবী। আগে থেকে শ্রীমাকেও কিছু বলেননি শ্রীরামকৃষ্ণ। বোধহয়, দেবাসনে বসেই ধ্যানমগ্ন হন সারদা। পুজোর সময় তাঁকে নববস্ত্র পরানো হয়। লজ্জাশীলা শ্রীমা কীভাবে বস্ত্র পরিবর্তন করলেন এ-কথা পরবর্তী কালে কোনও ভক্ত মহিলা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন। তখন শ্রীমা উত্তর দেন, ‘‘তখন আমি কেমন যেন হয়ে গেছলুম।’’ অর্থাৎ তাঁর বাহ্যজ্ঞান ছিল না। কিন্তু সেদিন শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে দেবী কালিকারূপে পুজো করেননি। তিনি দশমহাবিদ্যার অন্যতম বিদ্যা ষোড়শী রূপে পুজো করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, ষোড়শী হল দশমহাবিদ্যার উল্লেখযোগ্য রূপ। শ্রীরামকৃষ্ণ সাধনার সময় জগন্মাতার নানা রূপের দর্শন লাভ করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে অন্য কোনও রূপেই তিনি সারদাকে পুজো করেননি। এর কারণস্বরূপ কখনও তিনি বলতেন, ‘‘ঐ মূর্তিসমূহের সকলগুলিই অপূর্ব সুরূপা হইলেও শ্রীশ্রীরাজরাজেশ্বরী বা ষোড়শী মূর্তির সৌন্দর্যের সহিত তাঁহাদিগের তুলনা হয় না।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘ষোড়শী বা ত্রিপুরামূর্তির অঙ্গ হইতে রূপ-সৌন্দর্য গলিত হইয়া চতুর্দিকে পতিত ও বিচ্ছুরিত হইতে দেখিয়াছিলাম।’’ সেই রূপমহিমায় গৌরবান্বিত দেবী পূজিতা হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-টানা তিনবার সেরা বাঙ্গুর

সেদিন শ্রীরামকৃষ্ণ কীভাবে পূজা করেছিলেন তা উল্লেখ করে শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনীকার বলছেন, ‘আপনার সহিত সাধনার ফল এবং জপের মালা প্রভৃতি সর্বস্ব শ্রীশ্রীদেবীপাদপদ্মে চিরকালের নিমিত্ত বিসর্জনপূর্বক মন্ত্রোচ্চারণ করিতে করিতে তাঁহাকে প্রণাম করিলেন।’ অর্থাৎ পুজোর পরে মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে নিজ স্ত্রীকে দেবীজ্ঞানে প্রথমে নিজেকে, পরে নিজের সাধনফল, জপমালা সমেত সমর্পণ করেছিলেন তাঁর পায়ে। তার সঙ্গে তাঁকে প্রণামও নিবেদন করলেন। সত্যিই সে ছিল এক অদ্ভুত ঘটনা। একজন স্বামী তাঁর স্ত্রীকে পুজো করেছেন এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। সেদিন পুজোকালে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্ত্রপূত জল দিয়ে শ্রীশ্রীমাকে অভিষিক্ত করে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘হে বালে, হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মাতঃ ত্রিপুরাসুন্দরি, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত কর, ইঁহার (শ্রীমার) শরীর মনকে পবিত্র করিয়া ইঁহাতে আবির্ভূতা হইয়া সর্বকল্যাণ সাধন কর।’ আমাদের এই তথ্যপাঠে বিস্ময় জাগে, তার সঙ্গে কৌতূহল সৃষ্টি হয়, এইভাবে স্ত্রীকে পুজো করার দরকার ছিল কী? কিংবা তিনি ফলহারিণী পুজোর দিন ষোড়শী রূপে কেন পূজা করতে গেলেন?

আরও পড়ুন-নিশীথকে মিছিলে জবাব উদয়নের

এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ কৃত কোনও কাজই নিরর্থক নয়। আমাদের আধ্যাত্মিক সভ্যতার ইতিহাস জানায় শঙ্করাচার্য সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে দশটি ভাগে বিভাজিত করেছিলেন। আর দশটি সম্প্রদায়কে রক্ষণেরও সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা করে গিয়েছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন ভারতের চারটি প্রান্তে চার মঠ। দক্ষিণে তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে শৃঙ্গেরীমঠ, পূর্বে পুরীতে গোবর্ধনমঠ, পশ্চিমে দ্বারকায় সারদা মঠ এবং বদরিকা আশ্রমের কাছে জ্যোতির্মঠ। চারটি মঠ কেবল স্থাপন করেননি, নিজের চারজন সুযোগ্য শিষ্যকে চারটি মঠের দায়িত্বভার প্রদান করেন। শিষ্যদের প্রতি আচার্যের নির্দেশ ছিল, দ্বারকাধাম, পুরীধাম, জ্যোতির্ধাম ও রামেশ্বরধাম যথাক্রমে শারদামঠ, গোবর্ধনমঠ, জ্যোতির্মঠ ও শৃঙ্গেরীমঠ নামে পরিচিত হবে। আর দশ সম্প্রদায়ের সাধুদের তিনি দশটি নামে চিহ্নিত করেন। এঁরা— পুরী, গিরি, ভারতী, তীর্থ, বন, অরণ্য, পর্বত, আশ্রম, সাগর ও সরস্বতী নামে চিহ্নিত হন। এঁরা সংখ্যায় দশ বলে ‘দশনামী সম্প্রদায়’ হিসেবে খ্যাত। শ্রীরামকৃষ্ণ তোতাপুরীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। তাই প্রথাগতভাবে তিনি ছিলেন পুরী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী। পুরী সম্প্রদায়ের মূল মঠ শৃঙ্গেরীতে। শৃঙ্গেরীমঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন কামাক্ষী। কামাক্ষী দেবীর মন্দির কাঞ্চীপুরমে অবস্থিত। কাঞ্চীপুরমে যে দেবী পূজিতা হন তিনি হলেন ষোড়শী দেবী। তিনি শ্রীবিদ্যা রূপে যন্ত্রে পূজিতা।

আরও পড়ুন-সুপ্রিম-নির্দেশ মেনে পথদুর্ঘটনায় রাজ্যের ৭ দফা গাইডলাইন, আহতের উদ্ধারকারীকে হয়রানি নয়

শ্রীরামকৃষ্ণ নিজ সম্প্রদায়ের আরাধ্যা দেবীকে নিজের ভবিষ্যৎ ধর্ম আন্দোলনের আরাধ্যা দেবী রূপে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যখন তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি অতিবাহিত করছেন তখন তিনি সারদা দেবীকে নিজের শরীর দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এ আর কি করেছে! তোমাকে আরও বেশী করতে হবে।’ তাই আমরা দেখি শ্রীরামকৃষ্ণ (১৮৮৬) চলে যাওয়ার পর প্রায় চৌত্রিশ বছর এ-জগতে অতিবাহিত করেছিলেন সারদা দেবী (১৯২০)। তাঁর সম্মুখে গঠিত হয়েছে রামকৃষ্ণমঠ ও মিশন। তিনিই ছিলেন এই সন্ন্যাসীসংঘের সংঘজননী। সুতরাং সেই ফলহারিণী কালীপুজোর দিনটি ছিল রামকৃষ্ণ আন্দোলনের এক বিশেষ ক্ষণ। রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনে জ্যৈষ্ঠমাসের অমাবস্যার দিনটিকে ফলহারিণী পুজোর থেকে ষোড়শী পুজোর দিনরূপেই বেশি করে চিহ্নিত করা হয়। মূর্তিতে বা যন্ত্রতে পুজো করার পরিবর্তে স্বয়ং মানবশরীরকে আরাধনা করে শ্রীরামকৃষ্ণ এক বিরল ঘটনার জন্ম দিলেন যা ইতিহাসের পাতায় চিরকাল পবিত্রতার অক্ষরে লেখা থাকবে। সেদিন দক্ষিণেশ্বরের মন্দির, গভীর রাতের সেই আকাশ, গঙ্গা থেকে বয়ে আসা মিঠে বাতাস— সবই অমৃতময় হয়ে উঠেছিল। নারীকে এতবড় সম্মান আর কে দিয়েছে? সীতা, সাবিত্রী আর গার্গী, মৈত্রেয়ীর সঙ্গে আরেক নাম সংযোজিত হল, সেই নাম শ্রীরামকৃষ্ণ-পত্নী সারদার। সেই পুণ্যদিন যে ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিল তা ভারতের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে নতুন, মৌলিক আর অভিনব। সে ছিল এক ফলহারিণী কালীপুজোর দিন।

Latest article